আফগান প্রশ্নে বৈশ্বিক মেরুকরণ, স্বীকৃতি কতদূর?

0

ড. মাহফুজ পারভেজ॥ আফগানিস্তানে তালেবান নিয়ন্ত্রিত সরকারকে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দেবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেবে জাতিসংঘের ‘ক্রেডেনশিয়ালস কমিটি’। এই কমিটির নয় সদস্যের মধ্যে অন্যতম রাশিয়া। রাশিয়া জানিয়েছে, ‘আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা তারা এখন ভাবতেই চায় না।’ রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী সের্গেই লাভরভ নিজেই বলেছেন, ‘তালেবান সরকারকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার যে প্রশ্ন, তা বর্তমান পরিস্থিতিতে ভাবার অবস্থা নেই।’ জাতিসংঘের ‘ক্রেডেনশিয়ালস কমিটি’র অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছে চীন ও আমেরিকা। চীন তালেবান সরকারকে সুযোগ দেওয়া কথা বললেও আমেরিকা আফগানিস্তানের মানবাধিকার ভঙ্গ নিয়ে চিন্তিত। এসব বিষয় নিয়ে শীগগিরই সামগ্রিকভাবে আলোচনার জন্য বৈঠকে বসার কথা কমিটির।
এদিকে, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস আগেই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, ‘তালেবানের উদ্দেশ্যসাধনের, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পাওয়ার একমাত্র উপায়, যথাযথ সরকার গঠন করতে হবে। এবং মানবাধিকার, বিশেষ করে মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে তালেবান সরকারকে।’ আফগানিস্তানে তালেবান কর্তৃপক্ষের পক্ষে-বিপক্ষে এমনই মেরুকরণ ঘটেছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। এমনকি, সদ্য-সমাপ্ত জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ সভায় অন্য অনেক বিষয় ছাপিয়ে প্রাধান্য পায় আফগানিস্তান প্রসঙ্গ। আফগান প্রশ্নে বৈশ্বিক মেরুকরণের ফলে তালেবানদের স্বীকৃতি প্রাপ্তির বিষয়টি নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পরে তালেবান সরকার তৈরি করলে আমেরিকা, ভারত-সহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশই সেই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে বন্ধ হয়েছে আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়ার পথ, যদিও চীন আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে আর তালেবানের জন্য সাহায্যের পথ খুলতে মাঠে নেমেছে ইসলামাবাদ।
তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানের জনগণের স্বার্থে আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের সামনে এখন একটাই পথ— আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারকে স্থিতিশীল এবং শক্তিশালী করা।’ আফগান জনগণের ‘স্বার্থের প্রসঙ্গ’ও এসেছে ইমরানের বক্তৃতায়। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি আফগানিস্তানকে অবহেলা করি, তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। কারণ, খোদ জাতিসংঘই জানিয়েছে, আফগানিস্তানের অর্ধেক মানুষ এখন সঙ্কটে আছে। পরিস্থিতি এমনই চলতে থাকলে আগামী এক বছরের মধ্যে ওই দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যাবেন।’ এর আগে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দাবি করেছিলেন, সার্ক (দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা)-এর বৈঠকে আফগানিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করুক তালেবান। কিন্তু সেই দাবি মানতে চায়নি ভারত-সহ সার্ক-এর অন্যান্য সদস্য-দেশ। তার ফলে জাতিসংঘের চলতি সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে নিউইয়র্কে ‘সার্ক’-এর পার্শ্ববৈঠক ভেস্তে যায়।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে পাকিস্তানের পাশাপাশি চীনও সক্রিয়। কূটনৈতিক মহলের ধারণা, আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সেনা চলে যাওয়ার পরে সেখানে বাণিজ্যিক তথা কৌশলগত আধিপত্য দখলে বেইজিং আগ্রহী। তালেবান সরকার গড়ার পর চীন তাদের স্বীকৃতি ও আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। পক্ষান্তরে আমেরিকা ও ভারত তালেবানের বিরোধিতা অব্যাহত রেখেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পরে তালেবান প্রসঙ্গে কড়া অবস্থান নিয়েছে দু’দেশ। জঙ্গি কার্যকলাপ নিয়ে যৌথ বিবৃতিতে তালেবানের উদ্দেশে বার্তা দিয়েছেন দুই রাষ্ট্রনেতা। শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর) হোয়াইট হাউসে বৈঠক করেন মোদী ও বাইডেন। তার পরেই একটি যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, ‘তালেবান যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেগুলো যাতে তারা মেনে চলে সেই বার্তা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও প্রধানমন্ত্রী মোদী। আফগানিস্তানে মহিলা, শিশু, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়-সহ সবার অধিকার রক্ষা করতে হবে তাদের। আফগানরা চাইলে দেশ ছাড়ার অনুমতি দিতে হবে। সেই সঙ্গে আফগানিস্তানের মাটি যাতে জঙ্গি কার্যকলাপে ব্যবহার না করা হয় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে তাদের। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা মেনে চলতে হবে তালেবানকে।’ জাতিসংঘের সাধারণ সভার অধিবেশন থেকেও নাম না করে পাকিস্তানকে নিশানা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার মতে, কয়েকটি দেশ সন্ত্রাসবাদকে ‘কূটনৈতিক চাল’ হিসাবে কাজে লাগায়। তবে জঙ্গিরা যে তাদের কাছেও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে সে সতর্কবাণীও শুনিয়েছেন মোদী। পাশাপাশি, পালাবদল ঘটে যাওয়া আফগানিস্তানের মাটিকে সন্ত্রাসবাদীরা যাতে ব্যবহার করতে না পারে, তা নিয়েও আন্তর্জাতিক ওই মঞ্চে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। কয়েক দিন আগেও জি২০ দেশগুলোর বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর জানিয়েছিলেন, মানবতার কথা মাথায় রেখে সব দেশগুলোর এগিয়ে আসা উচিত। যে সব আফগানরা সমস্যায় রয়েছেন তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। সেই বৈঠকেও ভারতের বার্তা ছিল, আফগানিস্তানের মাটি যাতে কোনোভাবেই জঙ্গি কার্যকলাপে ব্যবহার না করা হয় সে দিকে নজর দিতে হবে। সেই বার্তাই আরও এক বার দিল ভারত। পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তালেবানের দাবি ছিল তারা বদলে গিয়েছে। ‘তালেবান ২.০’ নামে তারা প্রাথমিক ভরসাও পেয়েছিল অনেকের। কিন্তু পরবর্তীতে কিছু উগ্রতার চিত্র সামনে চলে আসে, যার নিন্দা করে আমেরিকার পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নেড প্রাইস জানান, ‘তালেবান মুখে কী বলছে, আমরা সেটুকুই শুধু শুনছি, এমন নয়। তারা কী কী কাজ করছে, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনাও করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রাইস। আফগান সাংবাদিক, বিচারক, আইনজীবী, সমাজকর্মী এবং মহিলা ও শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত আমেরিকা-সহ পশ্চিমের দেশগুলো। তবে আফগানিস্তানের জঙ্গি কার্যকলাপ নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চায় না আমেরিকা। পেন্টাগনের প্রেস সচিব জন কিরবি জানিয়েছেন, সন্ত্রাসদমনে ‘এয়ারস্ট্রাইক’ নিয়ে তালেবানের সঙ্গে কথা চালানোর কোনও প্রয়োজন দেখছে না আমেরিকা। আকাশপথে হামলাও তারা আর করবে না বলে জানিয়েছে পেন্টাগন। তবে, তাদের বিরুদ্ধে ওঠা একরাশ অভিযোগ নিয়ে তালেবান কারাপ্রধান তুরাবির বক্তব্য হলো, ‘আমরা ওদের দেশের আইন নিয়ে মাথা ঘামাই না। ওরা কেন আমাদের আইন নিয়ে প্রশ্ন তুলবে!’ উল্লেখ্য, তালেবান পররাষ্ট্র মন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি তাদের মুখপাত্র সোহেল শাহিনকে জাতিসংঘে আফগান দূত হিসেবে মনোনীত করেছেন। এর আগে প্রাক্তন আফগান দূত গোলাম ইশাক জাইকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যদিও শাহিনকে স্বীকৃতি দেবে কি না জাতিসংঘ, সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
গত ১৫ আগস্ট কাবুল-সহ আফগানিস্তানের প্রায় সব প্রদেশের দখল নেয় তালেবান। তার পরে ২৬ আগস্ট কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে বিস্ফোরণ হয়। সেই হামলার দায় নেয় ইসলামিক স্টেট খোরাসান। সেই বিস্ফোরণের তীব্র নিন্দা করে নিরাপত্তা পরিষদ। ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে সে দিকে তালেবানকে নজর দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাবুলের তখতে তালেবান বসার পর থেকেই নয়াদিল্লির কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একটি অংশের আশঙ্কা, আফগানিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানের শিকড় ক্রমেই গভীরে পৌঁছচ্ছে। অনেকের মতে, সাম্প্রতিক অতীতে পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-কেও এমন চালিকাশক্তির ভূমিকায় দেখা যায়নি, যেমনটা দেখা গিয়েছে আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে। বাস্তবে আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালেবানদের পক্ষে-বিপক্ষে পাকিস্তান ও ভারতের সুদৃঢ় অবস্থানের পাশাপাশি আমেরিকা, রাশিয়া, চীন নিজ নিজ অবস্থানে তৎপর রয়েছে। আঞ্চলিক পরিসরের মতোই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও স্পষ্টতর হচ্ছে মেরুকরণের ছাপ। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বসংস্থা ও ফোরামে চাপা থাকছে না পক্ষে-বিপক্ষের বক্তব্য, পদক্ষেপ ও বিতণ্ডা। এমনতাবস্থায়, আফগানিস্তানের তালেবানদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের বিষয়টি বিভিন্ন পক্ষের টানাপোড়নের মধ্যে ক্রমাগত আবর্তিত হচ্ছে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।