স্ক্যানার মেশিনে হাত রেখে নির্নয় হয় রোগ, বাঘারপাড়ার বহরামপুরে ওষুধের দোকানের কর্মচারী এখন চিকিৎসক!

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ওষুধের দোকানের কর্মচারী এখন জনপ্রিয় চিকিৎসক হয়েছেন। সব জটিল রোগেরই তিনি চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শতাধিক রোগী দেখেন। উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পার হতে পারেননি, নেই কোন ডাক্তারি সনদ। নিজেকে পল্লী চিকিৎসক বলে দাবি করলেও কোন সনদ দেখাতে পারেননি।
প্রতিটি ব্যবস্থাপত্রে তিনি ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষতিকর ডেপ্লাজাকট ও ডেক্্রাম্যাাথাসন গ্রুপের ওষুধ লিখছেন। যা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মুমূর্ষু রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকেন। এমন এক ডাক্তারের সন্ধান পাওয়া গেছে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বহরামপুর বাজারে।
ভুয়া এ ডাক্তারের নাম মজনুর রহমান। তিনি খলশী গ্রামের ভ্যান চালক জালাল সরদারের ছেলে। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংসারে অভাব থাকায় মজনু ঢাকার একটি ওষুধের দোকানে কাজ করতেন। বছর পাঁচেক সেখানে কাজ করার পর তিনি এলাকায় এসে ছোট্র একটি ওষুধের দোকান দেন। এরপর তিনি শুরু করেন রোগী দেখা। রোগী দেখার হাতিয়ার হিসাবে তিনি ব্যবহার করেন এক ধরনের স্ক্যানার মেশিন। এ স্ক্যানার মেশিনে প্রতিটি রোগী এক মিনিট হাত রাখে। আর সামনে থাকা ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে কিছু রোগের বর্ণনা। আগত রোগীর কাছে মজনু রোগ সম্পর্কে তেমন কিছুই জিজ্ঞাসা করেন না। দুই মিনিটের মধ্যে একটা ব্যবস্থাপত্র লিখে রোগীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন চেম্বার সংলগ্ন ওষুধের দোকান থেকে সব ওষুধ কিনতে। রোগী দেখা ফি বাবদ মজনু প্রতি রোগীর কাছ থেকে ৫০ থেকে ১শ টাকা নেন। আর ওষুধের বিল রোগী ভেদে ৭শ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। গত শনিবার সকাল সাড়ে ৭টায় বহরামপুর বাজারে গিয়ে দেখা যায়,অর্ধ শতাধিক রোগী সেখানে উপস্থিত। সবাই সিরিয়াল দিতে ব্যস্ত। সিরিয়ালের কাজে সহযোগিতা করছেন কথিত ডাক্তার মজনুর ছেলে মেহেদি। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই রোগীর ভিড়ও বাড়তে থাকে। এ প্রতিবেদকের সাথে থাকা ব্যক্তিকে দিয়ে সিরিয়াল দেওয়া হলো। তখন তার সিরিয়াল নং দাঁড়ালো ৮৭। এরপরও আরও রোগী ছিলো। সকাল ৯টার দিকে ডাক্তার এসেই চেম্বারে ডুকে পড়লেন। এক রোগী ঢুকছেন, আড়াই তিন মিনিট পর তিনি ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। চেম্বার সংলগ্ন ফার্মেসি থেকে সবাই ওষুধ নিচ্ছেন। কয়েকজনের ব্যবস্থাপত্রে দেখা গেল একটি কমন ওষুধ কাটিমাক্্র লেখা হয়েছে। কাটিমাক্্র হচ্ছে ডেপ্লাজাকট গ্রুপের ওষুধ। কয়েকটা ব্যবস্থাপত্রে দেখাগেল ডেক্্রাম্যাথাসন গ্রুপের ওষুধ ডেকাসনের নাম।
বাঘারপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্েরর আরএমও ডা. মুস্তাক আহাম্মেদ জানিয়েছেন, ডেপ্লাজাকট ও ডেক্্রাম্যাাথাসন হচ্ছে মূল অ্যাস্ট্ররয়েড গ্রুপের ওষুধ। এটি সেবন করলে যে কোন ধরনের রোগের সাময়িক উপশম হবে। তবে কিছুদিন পরেই তার কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, শরীরে পানি জমে যাবে, হাড় ক্ষয় হতে থাকবে। আলসারের সমস্যা থাকলে তা বেড়ে যাবে। সর্ব শেষ তার শরীরে প্রচন্ডভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে।
নড়াইলের গাজির হাট পেড়োলী গ্রামের আবুল শেখের স্ত্রী মর্জিনা বেগম(৪০), একই গ্রামের মশিয়ার শেখের স্ত্রী নাহার(৬০) ও শফিক লস্করের স্ত্রী বর্না(২২) এসেছেন হাটু, ঘাড় ও কোমরের ব্যথা নিয়ে। গত ১০দিন আগে তারা এসেছিলেন। ডাক্তার তাদের ব্যবস্থাপত্র দিয়েছিলেন। তাদের ব্যয় হয়েছিলো মর্জিনার ১৩শ’ ৫০ পঞ্চাশ টাকা, নাহারের ৮শ’ ও বর্নার ১৫শ’ টাকা। তাদের কোন পরিবর্তন হয়নি। ডাক্তারের কথামত এদিন আবার এসেছেন।
যশোর সদরের রুপদিয়া হাটবিলা গ্রামের মৃত হাসেম আলী মোল্যার স্ত্রী জহুরোন নেছা (৫৫) শরীরে শক্তি পান না, হাটু ও কোমরে ব্যাথা। গত দশদিন আগে এসেছিলেন। এদিন আবারও এসেছেন। তিনি জানিয়েছেন ব্যাথা একটু কম হয়েছে। গত দিন তার কাছ থেকে ওষুধের দাম নেওয়া হয়েছিলো এগারোশ’ পঞ্চাশ টাকা।
নড়াইল আগদিয়ার হাই সরদারের স্ত্রী রেহেনা খাতুনের মুখ ও পায়ের পাতা ফুলে গেছে। তিনি জানালেন, তার লিভার ও পেটের সমস্যা। প্রায়ই তার পায়ের পাতা ও মুখ ফুলে যায়। খোঁজ পেয়ে এ ডাক্তারের কাছে গত নয়দিন আগে এসেছিলেন। ওষুধ পত্র দিয়ে ষোলশ’ টাকা নিয়েছিলো। পায়ের ফোলা একটু কমেছে। অন্য বিষয়ে কোন উন্নতি হয়নি।
গতকাল সকালে ডাক্তার মজনুর চেম্বারের আশে পাশে বসে কম করে হলেও ২০ জন রোগীর সাথে কথা বলা হয়। তৃতীয়বার এসেছেন এমন কোন রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে বহারামপুর বাজারের এক ওষুধের দোকানি জানালেন, রোগ সারে না বলেই তৃতীবার আর কেউ আসেন না। তারপরেও রোগীর কমতি নেই। নতুন নতুন রোগী আনার ক্ষেত্র তার কিছু কৌশল আছে। মজনু প্রচার করার জন্য দুই তিনজন লোক রয়েছে। তারা প্রতিদিন দূর দূরান্তে এমনভাবে প্রচার করে আসে যে পরদিন থেকে সে অঞ্চলের রোগী আসা শুরু করে।
বাজারের এক ব্যবসায়ী জানালেন, মাত্র পাঁচ বছরে মজনু আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে। সে এই ভুয়া ডাক্তারি করে ২০ লক্ষ টাকা খরচ করে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট শাখা এনেছে। মাঠে ১৫ বিঘা জমি কিনেছেন। বড় একটি মাছের ঘেরও করেছেন। এ ব্যবসায়ী আক্ষেপ করে বলছিলেন এর আগে অনেক সাংবাদিক (কয়েক জনের নাম উল্লেখ করে), পুলিশ এসে গেছে। কিছুই হয়নি। সবাইকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে নিয়েছেন।
যশোরের সিভিল সার্জন ডাঃ বিপ্লব কান্তি বিশ^াস জানিয়েছেন, এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে মজনুর রহমান জানিয়েছেন, তার পল্লী চিকিৎসকের সনদ রয়েছে। তিনি নিয়ম অনুযায়ি রোগী দেখছেন।