চালের উৎপাদনের তথ্য বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই: পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেছেন, ‘সরকারের কৃষিখাত সংশ্লিষ্টরা চালের উৎপাদনের যে তথ্য দেয়, তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। বিশেষ করে চাল উৎপাদনের কোনো সঠিক তথ্য নেই।’ বুধবার হোটেল সোনারগাঁওয়ে ব্রি প্রণীত ‘বাংলাদেশে চালের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণকরণ-ডিআরপি’ শীর্ষক কৌশলপত্র উপস্থাপন ও মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মেসবাহুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে কৌশলপত্র উপস্থাপন করেন ব্রির মহাপরিচালক ড. মাে. শাহজাহান কবীর।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বিবিএসের মাথাপিছু চাল ভোগের পরিমাণ ধরে হিসাব করলে দেশে দুই কোটি ৮০ লাখ টনের বেশি চালের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে এর থেকে অনেক বেশি। তাহলে বাকি চাল গেল কোথায়? তারপরও কেন আমদানি করতে হচ্ছে? নিশ্চয় উৎপাদনের তথ্যে ভুল রয়েছে।’ পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে চাল উৎপাদনে যে সফলতা এসেছে সেটা ভালো। আরও অনেক এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের হেক্টরপ্রতি ফলন এখনো মাত্র ২.৭৪ টন। যেখানে জাপান হেক্টরে পাঁচ টন আর চীন সাড়ে ছয় টন ধান পায়। এমনকি ভিয়েতনামের ফলন ৫.৮৪ টন। আমরা চীন জাপানের মতো উন্নত নয়, কিন্তু ভিয়েতনামের মতো সাধারণ দেশের মতো ফলনও করতে পারি না।’
বাজারে চালের দাম কমাতে দীর্ঘদিন ধরে প্রাইজ কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয় উপস্থাপিত কৌশলপত্রে। সে প্রসঙ্গ টেনে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘কেন আপনারা প্রাইজ কমিশন চান? তাহলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কী কাজ? এমন একটি অধিদপ্তর ভারতেও নেই। তাদের কাজ কি শুধু প্রতিদিনের দাম-দরের হিসাব রাখা? ওই সংস্থাকে দায়িত্ব নিতে হবে। না হয় সেটা ভেঙে প্রাইজ কমিশন করতে হবে।’ ছোট্ট দেশ নেদারল্যান্ডসের প্রসঙ্গ টেনে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ছোট্ট একটি দেশ, যা বাংলাদেশের অর্ধেকের কম, তারা ৯৪ বিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি করছে। আমরা পাঁচ বিলিয়নে আটকে রয়েছি। যেখানে আমরা কৃষিপ্রধান দেশ।’ তিনি বলেন, ‘কৃষিকে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ব্যাপক প্রকল্প-কর্মযজ্ঞ চলে। কিন্তু দেশের এ আবহাওয়ানির্ভর কৃষির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। আমাদের কৃষিকে উন্নত করতে হবে। প্রয়োজনে গ্রিনহাউজ কৃষিতে যেতে হবে।’
অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক চালের উৎপাদনের তথ্যে ঘাটতির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘কোথাও তথ্যের গরমিল রয়েছে। আমি বিবিএসকে আহ্বান করবো, আগামী কৃষি শুমারিতে যেন উৎপাদনের সঠিক তথ্য থাকে। সামান্য ভুলও যেন না থাকে। প্রয়োজনে শুমারিতে দেরি হোক। কিন্তু সঠিক তথ্য উঠে আসুক।’ স্বয়ংসম্পূর্ণতার পরও চাল আমদানির প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গ টেনে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘ফসল আবহাওয়ানির্ভর। মাঝে মাঝে উৎপাদন ব্যাহত হয়। তবে আমরা যে পরিস্থিতিতে রয়েছি, তাতে ’৪৩ সালের মনান্তরের মতো লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মরার অবস্থা নেই। এখন কেউ না খেয়ে থাকে না। কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘২০৫০ সালে সম্ভাব্য ২০ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য চালের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার কাজ চলছে। দেশে একদিকে আবাদি জমি কমছে, বিপরীতে বাড়ছে জনসংখ্যা ও জলবায়ূ পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি। এই ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে চালের উৎপাদনশীলতা বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বাড়াতে হবে। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে।’
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে ছিলেন বিএআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ মো. বখতিয়ার, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ ও ইরির বাংলাদেশ প্রতিনধি হোমনাথ ভান্ডারি। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি এফএওর বাংলাদেশ প্রতিনিধি রবার্ট ডি. সিম্পসনের লিখিত বক্তব্য পাঠ করে শুনানো হয়। এসময় কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও অন্যান্য সংস্থাপ্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর। উপস্থাপনায় জানানো হয়, ডিআরপি ৩০ বছরের জন্য চালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কৌশলপত্র। ২০৩০ সালের মধ্যে চালের চালের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করতে কোথায় কোথায় বিনিয়োগ ও কী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে তা ডিআরপি কৌশলপত্রে বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ২০৫০ সালে চালের উৎপাদন ৬ কোটি ৮ লাখ টনে উন্নীত করার কথা এ বইয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। উন্নত জাত-প্রযুক্তি উদ্ভাবন, বিদ্যমান উৎপাদন গ্যাপ হ্রাস এবং অনাবাদি জমিতে আবাদ বৃদ্ধিসহ সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে চালের উৎপাদন ২০৩০ সালে ৪ কোটি ৬৯ লাখ, ২০৪০ সালে ৫ কোটি ৪০ লাখ এবং ২০৫০ সালে ৬ কোটি ৮ লাখ টনে উন্নীত করা সম্ভব। বর্তমানে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৮৭ লাখ টন। বইয়ে বলা হয়, এ কর্মপরিকল্পনার ৭৫% বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে ২০৩০ সালে ৪২ লাখ, ২০৪০ সালে ৫৩ লাখ ও ২০৫০ সালে ৬৫ লাখ টন চাল দেশে উদ্বৃত্ত থাকবে। এর ফলে যে কোন দুর্যোগে বছরে ৪০ লাখ টন পর্যন্ত চালের উৎপাদন কমলেও খাদ্য নিরাপত্তা অক্ষুণ্ন থাকবে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি-২ বা জিরো হাঙ্গার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। ১৯৭১-৭২ সালে হেক্টর প্রতি চালের গড় উৎপাদন ছিল ১ টনের কিছু বেশি। বর্তমানে হেক্টরপ্রতি চালের উৎপাদন গড়ে ৪ টনেরও বেশি।