নামেই ডেঙ্গু ডেডিকেটেড

0

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও ফাহিমা আক্তার সুমি॥ ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালে প্রস্তুতি নেই। চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা। ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড ৬টি হাসপাতালের মধ্যে ৪টিতেই চিকিৎসার তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেই। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসায় এসব হাসপাতাল আলাদা করে নির্ধারণ করেছে। এসব হাসপাতালে সেরকম চিকিৎসার যন্ত্রপাতিও নেই। গুরুতর অসুস্থ এসব হাসপাতালে চিকিৎসার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে জনমনে। প্রস্তুতি নেই, তবুও কেন ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) এসব হাসপাতালে তাদের প্রস্তুতি না থাকার কথা স্বীকারও করেছেন। এদিকে, রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিদিনই হু হু করে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
শয্যাও খালি নেই। হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা কমে এলেও এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর বৃদ্ধিতে রাজধানীসহ সারা দেশেই আতঙ্ক রয়েছে। বর্ষা মৌসুম শুরুর পর থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। মশাবাহিত এই ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ৪০ জনের মৃত্যুর খবরও দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চলতি বছরে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী। গতকাল রাজধানীর রেলওয়ে হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায় নীরব-নিস্তব্ধ অবস্থা। ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হলেও নেই কোনো প্রস্তুতি। হাসপাতালটিতে হাতে গোনা পাঁচজন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছিল। হাসপাতালটি ডেডিকেটেড ঘোষণা করলেও ঊর্ধ্বতন মহলের নেই কোনো সুদৃষ্টি। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বুধবার দুপুর দুইটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত পাঁচ-ছয়জন ডেঙ্গু রোগী হাসাপাতালে এসেছিলেন। তাদেরকে পরামর্শ দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতালের বিভাগীয় চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. রিপন দাস বলেন, সরকার ঘোষিত ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য রেলওয়ে হাসপাতাল নির্ধারণ করা হলেও চিকিৎসা শুরু হয়নি। এটা আমাদের সমস্যা ঠিক না। বিষয়টি হলো হাসপাতালটি রেল মন্ত্রণালয়ের অধীনে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। এখানে মূল সমস্যা যেটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটা নির্দেশনা পাঠায় রেল মন্ত্রণালয় বরাবর। আমাদের ওপর থেকে সেই অনুমতি আসলে আমরা কাজে নেমে যাবো। কিন্তু আমরা এই ধরনের কোনো পত্র বা মৌখিক অর্ডার কিছুই পাইনি। আমাদের হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে মোট পাঁচজন। এরমধ্যে তিনজন রেলওয়ের কর্মরত কর্মকর্তা এবং দুইজন বাইরের রোগী। আমাদের যে অবস্থা তাতে বাইরের রোগী এখনো আমরা চিকিৎসা দিতে পারি না, তবুও অনেকের রেফারেন্সে দু-একজনকে সেবা দিতে হচ্ছে। তিনি জানান, এখন ডেডিকেটেড চালু করতে হলে আমাদের আগে নির্দেশনা পেতে হবে। আমরা প্রস্তুত আছি কিন্তু আমাদের কিছু সমস্যা আছে। চিকিৎসক স্বল্পতা, প্যাথলজি ল্যাব সংকট। ডেডিকেটেড হাসপাতাল যদি আমরা শতভাগ চালু করতে চাই সেক্ষেত্রে কিছু সুযোগ-সুবিধা আমাদেরকে দিতে হবে। কারণ চব্বিশ ঘণ্টা একজন প্যাথলজিস্ট কিন্তু ডিউটি করতে পারে না। এই হাসপাতালে মাত্র একজন প্যাথলজিস্ট আছেন। তিনি তো চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি করতে পারবেন না। টেকনিশিয়ান আছে একজন। তার পক্ষেও একা ডিউটি করা সম্ভব না। এরপর ল্যাবের কিছু সমস্যা আছে। যখন রোগীরা ভর্তি হবে তখন ক্রিটিক্যাল অবস্থায় গেলে তাদের লাইফ সপোর্টে রাখতে হবে। সে ধরনেরও কোনো প্রস্তুতি নেই। নার্স সংকটও আছে আমাদের। মেডিসিন বিশেষজ্ঞও প্রয়োজন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চাইলে এসব আমাদের একদিনের মধ্যে সমাধান দিতে পারেন।
এই চিকিৎসক আরও বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যেটা আমাদের নার্স ও ডাক্তারদের জন্য দুই-তিনদিনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। এই সাপোর্টগুলো পেলে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রোগীদের সেবা দিতে পারবো। এখন তো আমরা বিপদের মাঝে আছি। কারণ কোনো দিকনির্দেশনাই আমরা এখনো পাইনি। আমরা একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। ডেডিকেটেড ঘোষণার পরে ডেঙ্গু আক্রান্ত সাধারণ রোগীরা হাসপাতালে আসছেন। অন্য হাসপাতাল থেকে আতঙ্কিত হয়ে হয়তো ডেডিকেটেড শুনে এখানে ছুটে আসছেন তারা। এরমধ্যে যারা আসছেন তাদের আশি শতাংশ রোগীকে আমরা পরামর্শ দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো হচ্ছে-ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, মিরপুরের লালকুঠি হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল, টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল, আমিনবাজার ২০ শয্যা হাসপাতাল এবং কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়, ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণা করলেও মিরপুরের লালকুঠি হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল, আমিনবাজার ২০ শয্যা হাসপাতাল এবং কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যা হাসপাতালে এখনো ডেঙ্গু রোগী ভর্তির তথ্য নেই। রোগীরা জানেন না। তাই সেখানে যাচ্ছেন না। ফলে রোগী ভর্তির তথ্যও আসে না। অন্যদিকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে। তার তথ্যও আসছে কন্ট্রোল রুমে।
ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণা হয়েছে কিন্তু রোগী নেই, মানুষ জানেন না-এই বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া মানবজমিনকে বলেন, ওই হাসপাতালগুলো পুরোপরি প্রস্তুত না। এগুলো প্রস্তুত করতে পারিনি। তাছাড়া জনবলও সংকট রয়েছে। মিরপুরের লালকুঠি হাসপাতালে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে। তাই প্রস্তুত না হাসপাতালটি। আমিনবাজার ২০ শয্যা হাসপাতালও প্রস্তুতি নেই। কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যা হাসপাতালে আউটডোর (বহির্বিভাগ) রয়েছে। ইনডোর নেই। রেলওয়ে হাসপাতালেও জনবল সংকট। ওটা রেলের হাসপাতাল। তিনি আরও বলেন, এখন করোনা কমে যাচ্ছে হয়তো এসব হাসপাতাল নাও লাগতে পারে। চলতি মাসে তিনগুণ বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত মাসের চেয়ে চলতি মাসে তিনগুণ বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২৬৭ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানীতেই রয়েছেন গত ২৪ ঘণ্টায় ২১৭ জন। আগস্ট মাসের ২৬ দিনে ৬ হাজার ৪৬২ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। দেশে ডেঙ্গুতে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে আগস্টের ২৬ দিনেই মারা গেছেন ২৮ জন। আর জুলাইতে ১২ জন। গত জুলাই মাসেই ভর্তি হয়েছিলেন ২ হাজার ২৮৬ জন ডেঙ্গু রোগী। তার আগের মাসে এই সংখ্যা ছিল ২৭২ জন। ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার বাইরে নতুন ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৫০ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৯০ জন। ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে মোট ভর্তি রোগী আছেন ৯৬৫ জন। অন্যান্য বিভাগে বর্তমানে ভর্তি আছেন ১২৫ জন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ১২০ জন। সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ৭ হাজার ৯৮৮ জন।