সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে কমতে পারে ডেঙ্গু

0

নূরে আলম জিকু্॥ মহামারি করোনার মধ্যে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এতে দিশাহারা নগরবাসী। দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় বেড়েছে এডিস মশার বিস্তার। উত্তর ও দক্ষিণের কয়েকটি ওয়ার্ডে এখন ডেঙ্গুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আক্রান্ত হচ্ছেন বিভিন্ন বয়সীরা। ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অধিকাংশই শিশু। চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ১৯৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যা মোট আক্রান্তের তিন-চতুর্থাংশ।
জুলাই মাসের তুলনায় ৩ গুণ বেশি। ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে আগস্ট মাসেই মৃত্যু হয়েছে ২৮ জনের। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও অনেকে করোনার ভয়ে সরকারি হাসপাতালে আসছেন না। চিকিৎসা নিচ্ছেন বাসাবাড়ি কিংবা প্রাইভেট হাসপাতালে। এর ফলে আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা প্রকাশ পাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি করোনা রোগীর সংখ্যা কমে আসলেও ডেঙ্গু রোগী কমছে না। কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেছেন, আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বরের ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে। আগামী মাসের ২য় সপ্তাহ থেকে প্রাকৃতিক উপায়েই ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে পারে। বৃষ্টিপাত কমলে এডিসের বিস্তার কমবে। এদিকে করোনার মধ্যে ডেঙ্গু রোগী বাড়ায় বার বার পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কার কথা জানিয়ে আসছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এতেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি সিটি করপোরেশন। ফলে গত ৩ মাস ধরে ডেঙ্গু রোগীর ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলছে। সিটি করপোরেশন মশা নিধন করতে অভিযান চালালেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি ডেঙ্গু। উল্টো জুলাই ও আগস্ট মাসে প্রতিদিনই সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় মৌসুম এডিস সার্ভে ২০২১-এ উঠে এসেছে ডেঙ্গুতে ঝুঁকি পূর্ণ বিভিন্ন এলাকার তালিকা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় মগবাজার ও নিউ ইস্কাটন এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসাবো ও গোড়ান এলাকায় ডেঙ্গুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের মগবাজার ও নিউ ইস্কাটন এলাকায় ডেঙ্গু মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। সূচক (বিআই) অনুযায়ী ৫৬ দশমিক সাত শতাংশ। ঝুঁকিপূর্ণ তালিকার মধ্যে অভিজাত এলাকাও রয়েছে। উত্তর সিটি করপোরেশনের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, নিকুঞ্জ, কল্যাণপুর, দারুসসালাম, মিরপুর-১০ নম্বর, কাজীপাড়া, মহাখালী, নিকেতন, আফতাব নগর, মেরুল বাড্ডা ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসাবো, গোড়ান, এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, আর কে মিশন রোড, টিকাটুলী, বনশ্রী, মিন্টো রোড, বেইলী রোড, বংশাল এলাকা সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এসব এলাকায় এডিসের বিস্তার বাড়ায় অনেকেই স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন।
দুই সিটি করপোরেশন বলছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত কীটনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে। এডিসের লার্ভা ধ্বংসে কাজ করছেন মশককর্মীরা। ইতিমধ্যে সর্বাত্মক জনবল ও শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। যেসব স্থাপনায় লার্ভা মিলছে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে, সেসব এলাকায় কীটনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে। মশার উৎসস্থল বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে অপরিকল্পিত নগরায়নকেই দায়ী করছে সিটি করপোরেশন। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আগে বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে ডেঙ্গু বেড়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার মানবজমিনকে বলেন, গত কয়েক মাস ধরে ডেঙ্গু ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় এডিস মশার লার্ভা মিলেছে। এতে অনেক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আগস্টেও প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গত কয়েকদিন ধরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক। এডিসের লার্ভা এখনো মিলছে। বছরের এই সময়টা ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি থাকে। সে তুলনায় ডেঙ্গু রোগী খুব বেশি না, আবার কমও বলা যাবে না। চলতি মাসের শেষ দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও কিছুটা বাড়তে পারে। তবে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকটা কমে আসবে। এই সময়টা সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি নগরবাসীকে সতর্ক থাকতে হবে।
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ এর চেয়ারম্যান ও কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকারে বেড়েছে। সে তুলনায় সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী উদ্যোগ নেয়নি। ফলে নগরীর ২ কোটি মানুষ ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে পড়েছেন। অনেকেই মারা গেছেন। জুলাই থেকে ডেঙ্গু ভয়াবহ হয়েছে। আমরা বার বার বলেছি এডিসের লার্ভা বেড়েছে। ডেঙ্গুর ক্লাস্টার বেড়েছে। করোনার মধ্যে ডেঙ্গু বাড়লে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কষ্টসাধ্য হবে। কিন্তু আমাদের কথা আমলে নেয়নি সিটি করপোরেশন। তখন ডেঙ্গুর ক্লাস্টার খুঁজে খুঁজে বের করলে আগস্টে ডেঙ্গুর আউটব্রেক হতো না। এখন ডেঙ্গু বিস্তার সর্বোচ্চ। সাধারণত আগস্টে এডিসের প্রজনন সবচেয়ে বেশি হয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনকে আরও বেশি জোর দিতে হবে। নিয়মিত লার্ভিসাইট ও অ্যাডাল্টিসাইট করতে হবে। তবে পরিবেশ ঠিক থাকলে আগামী মাসের শুরু থেকে বৃষ্টিপাত কমে আসতে পারে। ফলে ডেঙ্গুও প্রাকৃতিকভাবে কমে আসবে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে ডেঙ্গু রোগীও কমতে পারে। তবে ডেঙ্গু একেবারে নিয়ন্ত্রণে আসবে না। বছরের সবসময়ই কম বেশি ডেঙ্গু থাকবে। সিটি করপোরেশনকে এখুনি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আগামী মাসে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসলেও সিটি করপোরেশনের সফলতার কথা বলা যাবে না। কারণ এটা প্রকৃতি ও আবহাওয়ার কারণে কমবে। সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হলে জুলাই ও আগস্টেই হতো।