তালেবানের বিজয় ও আঞ্চলিক বাস্তবতা

0

গোলাম মাওলা রনি
আজকের কলামে মহাকালের রাজনীতির কিছু সূত্র এবং কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনা করব। প্রথমত, প্রকৃতির অমোঘ লীলায় একটি জাতি অন্য জাতিগোষ্ঠীর ওপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আধিপত্যের সুযোগ পায়। এই সময়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত জাতিগোষ্ঠী যদি তাদের অধীনস্থ জাতিগোষ্ঠীর ওপর জুলুম-অত্যাচার চালায় তবে শত শত বছর পরে হলেও অধীনস্থ জাতিগোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে অতীতে তাদের ওপর চালিত অত্যাচারের প্রতিশোধ নিয়ে থাকে। ইতিহাসের পাতা থেকে কয়েকটি বিখ্যাত উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আপনাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। পারস্য দেশে মার্কসেস নামে বিখ্যাত এক সম্রাট ছিলেন। তার পিতা মহান দারায়ুস নামে ইতিহাসে সমধিক পরিচিত। প্রাচীন দুনিয়া তো বটেই এমনকি সর্বকালের ইতিহাসে সম্রাট দারায়ুসের মতো অতবড় সুসংগঠিত সাম্রাজ্য অন্য কোনো সম্রাট প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। দারায়ুসের মৃত্যুর পর তার সন্তান প্রথম মার্কসেস ৪৮৬ খ্রি: পূর্বাব্দের অক্টোবর মাসে সিংহাসনে বসেন। এর তিন বছর পর তিনি গ্রিস বিজয়ের জন্য দুনিয়ার সর্বকালের সবচেয়ে বড় যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন। হিরোডোটাসের বর্ণনা মতে, প্রায় ৫৩ লাখ সৈনিক এবং অন্যান্য লোকজনসহ প্রায় সোয়া কোটি লোকের সমন্বয়ে গঠিত বিশাল বাহিনী নিয়ে তিনি পুরো গ্রিস তছনছ করেন এবং তৎকালীন দুনিয়ার এক নম্বর কসমোপলিটান নগরী এথেন্স ধ্বংস করেন।
উল্লিখিত ঘটনার মাত্র ১৫৩ বছর পর অর্থাৎ ৩৩০ খ্রি: পূর্বাব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারায়ুসকে পরাজিত করে রাজধানী পার্সিপোলিস দখল করেন যা ছিল তৎকালীন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় এবং জাঁকজমকপূর্ণ মহানগরী। আলেকজান্ডার পুরো শহরে আগুন লাগিয়ে সম্রাট প্রথম দারায়ুস ও সম্রাট প্রথম মার্কসেস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পারস্য সাম্রাজ্যের গর্বের ধন এই মহানগরীকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেন। মার্কসেস যেভাবে এথেন্স ধ্বংস করেছিলেন তাতে পরবর্তী গ্রিক সম্রাটরা নগরীটি ধাপে ধাপে পুনঃনির্মাণ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু আলেকজান্ডার পার্সিপোলিসকে এমনভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন যা আর কখনো পুনঃনির্মাণ সম্ভব হয়নি। পার্সিপোলিসের মতো আরেকটি বিখ্যাত শহরের নাম ছিল গুরগঞ্জ। মধ্যযুগের মিসরীয় মামলুকরা যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তা বর্তমানকালের ইরান-মিসর-সমগ্র মধ্য এশিয়া-আফগানিস্তান এবং চীনের বিরাট অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। এই বংশের বাদশাহ, যার উপাধি ছিল শাহ তারা- সমসাময়িক দুনিয়ার অন্য কোনো বাদশাহকে নিজেদের কর্মচারী হিসেবে ধ্যানজ্ঞান করতেন। খাওরেজম শাহ দ্বিতীয় মোহাম্মদের সাথে মোঙ্গল বীর চেঙ্গিস খানের বিরোধ বেধে যায় মূলত খাওরেজম শাহের একজন ক্রীতদাসের বেঈমানির কারণে। ফলে প্রায় আট লাখ সৈন্য নিয়ে চেঙ্গিস খান বিশাল এই সাম্রাজ্যের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর-বন্দরে ধ্বংসলীলা চালিয়ে প্রায় দেড় কোটি লোককে হত্যা করেন। এরপর তিনি রাজধানী গুরগঞ্জকে এমনভাবে ধ্বংস করেন যার অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উপরোক্ত ঘটনার প্রাকৃতিক প্রতিশোধ কিভাবে হয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে আজকের শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করব। প্রথমত, চেঙ্গিস খানের রাজধানী ছিল কারাকোরাম, যার পরিণতি গুরগঞ্জের চেয়েও ভয়াবহ হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, খাওরেজম সাম্রাজ্য আক্রমণকালে তার দুই আত্মীয় বার্কে খান এবং হালাকু খানের মধ্যে যে সঙ্ঘাত দেখা দেয় তার ফলে তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্র পাল্টে যায়। বার্কে খান মধ্য এশিয়ার দায়িত্বে ছিলেন। অন্য দিকে হালাকু খান বাগদাদের মুসলিম খিলাফত ধ্বংস করার পর আজকের ইরাক-ইরানের পুরো অংশ এবং তুরস্কের কিয়দংশের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। হালাকুর সাথে বিরোধিতার একপর্যায়ে বার্কে খান বুঝলেন যে, স্থানীয় অধিবাসীদের সাহায্য ছাড়া হালাকুর মোকাবেলা সম্ভব নয়। সুতরাং তিনি তার দলবল নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। বার্কে খানের ইসলাম গ্রহণের খবরে হালাকু খুশি হলেন এবং মনে করলেন যে, তিনি কেন্দ্রীয় মোঙ্গল শাসক বা গ্র্যান্ড খানের সহযোগিতা নিয়ে বার্কে খানকে দমন করবেন। কিন্তু বাস্তবে পুরো পরিস্থিতি তার বিরুদ্ধে চলে গেল। কারণ বেজিং-এ প্রতিষ্ঠিত মোঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রধান খান মঙ্গু এবং তারপরে কুবলাই উভয় সম্রাটই কোনো ধর্মের ব্যাপারে দুর্বল ছিলেন না কিংবা ধর্মবিদ্বেষী ছিলেন না। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যের কথা মাথায় রেখে হালাকু খান যখন বার্কে খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন তখন যুদ্ধের ময়দানে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হলো। বার্কে খানের পক্ষে মোঙ্গল বাহিনী ছাড়াও খাওরেজম শাহের সেনাবাহিনীতে কাজ করত এমন অভিজ্ঞ মুসলিম যোদ্ধারা দলে দলে যোগদান করল। ফলে পরপর কয়েকটি যুদ্ধে হালাকু শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পারস্যে ফিরে যেতে বাধ্য হন! বার্কে খানের সাথে যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে বেজিংয়ের কাছে হালাকুর গুরুত্ব কমে গেল। এ অবস্থায় তিনি তার বিজিত এলাকায় টিকে থাকার জন্য মুসলমানদের সঙ্গে সমঝোতা শুরু করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় তার মৃত্যু হলে তার উত্তরাধিকারীরা সদলবলে মুসলিম হয়ে গেলেন এবং নিজেদের মোঙ্গল পরিচয় কবর দিয়ে ইলখানী পরিচয় ধারণ করলেন। এর ফলে বার্কে খানের বংশধর ও হালাকু খানের বংশধররা নির্বিবাদে বহু বছর রাজত্ব করতে থাকেন। এমনকি-চেঙ্গিস খান প্রতিষ্ঠিত ইউয়ান সাম্রাজ্যের পতনের পরও বার্কে খান ও হালাকু খানের বংশধরেরা মধ্য ও পারস্যে নির্বিবাদে রাজত্ব করেছিল বহু দিন।
আমরা আজকের শিরোনাম প্রসঙ্গে উল্লেখিত ইতিহাসের আলোকে বিস্তারিত আলোচনার আগে খুব সংক্ষেপে আফগান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করব। তালেবান যোদ্ধারা রাজধানী কাবুল দখল করেছেন। অন্য দিকে আফগানিস্তান দখল এবং তালেবানের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ যাবৎকালে যত টাকা খরচ করছে তা দেশটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অন্য কোনো যুদ্ধাভিযান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকবেলা অথবা জাতীয় উন্নয়নের কোনো একক প্রকল্পে খরচ করেনি। তারা এই যুদ্ধে ইউরোপের সম্মিলিত ন্যাটো বাহিনী ছাড়াও ভারত-পাকিস্তানসহ আরো অনেক বন্ধু রাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক ও কৌশলগত সহযোগিতা নিয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও তারা যেভাবে অপমানিত-লাঞ্ছিত হয়ে শোচনীয়ভাবে তালেবানের কাছে পরাজিত হয়ে আফগানিস্তান থেকে পালাচ্ছে তার দ্বিতীয় নজির গত এক শত বছরে পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তালেবানের বিজয়ের পেছনে তাদের বীরত্ব, যুদ্ধ-কৌশল, দেশপ্রেম এবং আল্লাহ প্রদত্ত ভৌগোলিক সুবিধার পাশাপাশি রাশিয়া-ইরান-চীনসহ আরো অনেক দেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল। যুদ্ধকালীন এসব সহযোগিতা নিয়ে কানাঘুষা হতো বটে- কিন্তু যুদ্ধের শেষপ্রান্তে তালেবান যখন বিজয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ঠিক সেই সময়ে তাদের সাথে চীনের দহরম মহরম বিশ্ববাসীর নজরে এসেছে। সবাই ধারণা করছেন, অনাগত দিনে আফগানিস্তানে তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে চীন হবে তাদের কৌশলগত প্রধান অংশীদার। এর ফলে মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন ও পাকিস্তান পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে ভারত- তারপর মার্কিনিরা এবং শেষমেশ রাশিয়া। বিপদে পড়বে মিসর ও সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েত। ইরান-তুরস্ক এবং বাংলাদেশ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। তালেবান শাসকরা যদি আফগানিস্তানে রাষ্ট্রক্ষমতা চীনের সহযোগিতায় পাকাপোক্ত করে ফেলতে পারে তবে প্রথম চার-পাঁচ বছর ধরে উল্লিখিত সমীকরণেই যে বিশ্ব রাজনীতি আবর্তিত হবে তা রাজনীতির সাধারণ বিশ্লেষকও বলে দিতে পারেন। কিন্তু তালেবানের বিজয়ের ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে যে প্রাকৃতিক প্রতিশোধ শুরু হয়ে যাবে তা সবার আগে ইউরোপ-আমেরিকাকে ভোগাতে পারে। আলোচনার শুরুতেই প্রাকৃতিক প্রতিশোধ সম্পর্কে বলছিলাম। চীনের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই জাতিটি সুদীর্ঘকাল ধরে পশ্চিমা জাতিগোষ্ঠী দ্বারা নানাভাবে জুলুম নির্যাতন ও নাজেহালের শিকার হয়েছে। প্রকৃতির দয়ায় পরিস্থিতি এখন তাদের অনুকূলে। ফলে চীন তার সামরিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব দিয়ে পশ্চিমা দুনিয়াকে যেভাবে নাকানি চুবানি খাওয়াচ্ছে তা যদি অনাগত দিনে আরো বেড়ে যায় তবে অনেক দেশের মানচিত্রই পাল্টে যেতে পারে। চীন সাম্প্রতিক সময়ে যা করছে তার বেশির ভাগই অর্থনীতির জোরে করছে। ফলে তাদের দ্বারা সাধারণত যুদ্ধময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে না। অন্য দিকে উইঘুর মুসিলমদের সাথে তারা সঠিক ব্যবহার করছে না। এ দিকে মিয়ানমার সরকার আরাকানি রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর যে জুলুম নির্যাতন চালাচ্ছে চীনের আনুকূল্য বন্ধ হলে তা তারা করতে পারত না।
আমরা সবাই জানি, উইঘুর মুসলিমরা হাজার বছর ধরে মধ্য এশিয়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছে যারা ঐতিহ্যগতভাবে মধ্য-এশিয়া অথবা পারস্যের মুসলিম শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়ে আসছিলেন। ইতিহাসের একটা সময়ে তারা আটোমানদের দ্বারাও শাসিত হন। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উইঘুর সম্প্রদায়ের একটি অংশ ভৌগোলিকভাবে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের বাসিন্দা হতে বাধ্য হয়। বাকিরা কমিউনিস্ট সোভিয়েত সরকারের কবলে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর কাজিকিস্তান, তুর্কেমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, আজারবাইজান, কিরঘিজস্তান প্রভৃতি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে উইঘুর সম্প্রদায়ের মুসলিমরাই ওই সব দেশের রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে পড়ে। এই কারণে চীন সরকার তাদের দেশে বসবাসরত উইঘুর মুসলিমদের ব্যাপারে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ জিনজিয়াং প্রদেশটি চীনের সবচেয়ে দুর্গম এবং সবচেয়ে বড় প্রদেশ যেটির চার সীমান্তে মুসলিম অধ্যুষিত মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো রয়েছে। মধ্য এশিয়ার উইঘুর সম্প্রদায়ের কোটি কোটি মুসলমান চীনে বসবাসরত তাদের বংশীয় লোকদের ব্যাপারে সংবেদনশীল। চীন যদি গায়ের জোরে কিছু করতে যায় তবে জনমত উইঘুরদের পক্ষে ঝুঁকেবে। সেটি হবে আমেরিকা-রাশিয়াসহ চীন-বিরোধী পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি সুযোগ।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য