সুমি’জ হট কেক’র বিরুদ্ধে সাড়ে ১০ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির মামলা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ রাজধানীর উত্তরায় সুমি’জ হট কেক’র বিরুদ্ধে ১০ কোটি ৫২ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য পেয়েছে ভ্যাট গোয়েন্দা। ভ্যাট ফাঁকির উদ্দেশ্যে বিক্রয় তথ্য গোপন এবং মেশিনে প্রস্তুত করা কেক হাতে তৈরির ঘোষণা দিয়ে এই ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হয়েছে। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির দায়ে ভ্যাট আইনে মামলা করা হয়েছে। মঙ্গলবার (৮ জুন) এ মামলা দায়ের করা হয় বলে নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের (মূল্য সংযোজন কর) মহাপরিচালক ড. মইনুল খান জানিয়েছেন। তিনি জানান, ভ্যাট ফাঁকির সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২ জুন সংস্থার উপ-পরিচালক নাজমুন নাহার কায়সার ও ফেরদৌসী মাহবুব’র নেতৃত্বে ভ্যাট গোয়েন্দার একটি দল সুমি’জ হট কেক’র কারখানা ও প্রধান কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে। রাজধানীসহ সারাদেশে এই কেক প্রস্তুতকারীর ২৬টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এসব বিক্রয় কেন্দ্রে কারখানায় উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করা হয়। অভিযানে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি হাতে তৈরির কেক ঘোষণা দিলেও মূলত মেশিনে কেক প্রস্তুত করে আসছে। মেশিনে তৈরির কেক’র ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। কিন্তু হাতে তৈরি করলে তা ৫ শতাংশ। এত দিন সুমি’জ কেক পাঁচ শতাংশ হারে ভ্যাট দিয়েছে। মইনুল খান জানান, ভ্যাট গোয়েন্দার পরিদর্শনকালে ভ্যাট সংক্রান্ত নথিপত্র দেখাতে বলা হলে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহযোগিতা করেন। পরিদর্শনকালে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়ের তথ্যসহ আরও কিছু বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করা হয়।
সুমি’জ হট কেক’র ভ্যাট সংক্রান্ত দলিলাদি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি তিন ধরনের ভ্যাট হার বিশিষ্ট পণ্য সরবরাহ মূল্য তাদের রিটার্নে উল্লেখ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে আদর্শ হারে পণ্য (মূসক-১৫ শতাংশ), সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য পণ্য (সম্পূরক শুল্ক-১০ শতাংশ), আদর্শ হার ব্যতীত অন্যান্য হারে পণ্য (মূসক-৫ শতাংশ) ও অব্যাহতিপ্রাপ্ত পণ্য। তবে রিটার্নের সংযুক্ত সাব ফরম যাচাই করে দেখা যায়, মেশিনে প্রস্তুতকৃত কেক ও অন্যান্য কেক’র মূল্য রিটার্নের নোট-৭ এ উল্লেখ করে এবং এর ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে উক্ত পণ্যের ওপর আদর্শহারে ভ্যাট (মূসক-১৫ শতাংশ) প্রযোজ্য হবে। কারণ সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির সকল ধরনের কেক মেশিনে প্রস্তুত করা হচ্ছে- বলেন মইনুল খান। তিনি জানান, পরিদর্শনকালে প্রতিষ্ঠানের কারখানায় স্থাপন করা কেক মিক্সিং মেশিন ছয়টি, অটো ওভেন (ক্যাপাসিটি ১০৫টি) দুটি, বিস্কুট প্রস্তুতের বড় অটো ওভেন একটি, ক্রিম মিক্সিং মেশিন একটি দেখতে পাওয়া যায়। কেক তৈরিতে এসব মেশিন ব্যবহার হচ্ছে। তিনি আরও জানান, পরিদর্শনকালে কেক প্রস্তুতের সিনিয়র সেফ’র সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের কারখানায় কয়েকটি ধাপে কেক প্রস্তুত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- মিক্সিং মেশিনে ডিমের ফোম প্রস্তুত করা, ডিমের ফোমের সঙ্গে অন্যান্য উপকরণ দিয়ে মিক্সিং মেশিনে ৩০ মিনিট মিশিয়ে কেক’র বেটার প্রস্তুত করা, কেক বেটার ডাইসে ঢেলে অটোমেটিক ওভেনে ৩০ মিনিট রেখে বেক করা, ডেকোরেশনের জন্য মিক্সিং মেশিনে ক্রিম প্রস্তুত করা, ওভেনে বেক করা কেকের ওপর ক্রিম দিয়ে ডিজাইন করা এবং সরবরাহের জন্য তা বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়।
মইনুল খান বলেন, প্রতিষ্ঠানের কারখানায় কেক প্রস্তুতের জন্য কিছু কাজ হাতে (যেমন- বস্তা থেকে ময়দাসহ অন্যান্য উপকরণ মিক্সিং মেশিনে ঢেলে দেয়া, কেকের বেটার মিক্সিং মেশিন থেকে নামানো, ক্রিম দিয়ে ডিজাইন ইত্যাদি) করা হলেও কেক প্রস্তুতের মূল কাজ মেশিনে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি কেক তৈরির মূল প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন ধরনের মেশিনের মাধ্যমে সম্পন্ন করেও হাতে তৈরি কেক’র হার অনুযায়ী ভ্যাট প্রদান করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছিল। মামলার প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তুত করা কেক মেশিনে প্রস্তুত বিবেচনায় নিয়ে তার ওপর আদর্শহারে ভ্যাট আদায়যোগ্য। একই প্রক্রিয়ায় অন্যান্য কেক প্রস্তুতকারকরা ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিয়ে আসছে। সুমি’জ হট কেক কম ভ্যাট দেয়ায় অন্যান্য প্রস্তুতকারকরা ক্ষতির মুখে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানের ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের এপ্রিল সময়ের দাখিলপত্র অনুযায়ী মেশিনে প্রস্তুত কেক’র সরবরাহ মূল্য ২৬ কোটি ৯০ লাখ ৭২৬ টাকা। এসব কেক মেশিনে প্রস্তুত করা হলেও প্রতিষ্ঠানটি (হাতে তৈরি কেক হিসেবে ৫ শতাংশ হারে) ভ্যাট প্রদান করে এক কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬ টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির জন্য প্রযোজ্য আদর্শ হার হলো ১৫ শতাংশ। বিধায় চার কোটি তিন লাখ ৫০ হাজার ১০৯ টাকা ভ্যাট প্রযোজ্য। সে বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানটির অপরিশোধিত ভ্যাটের পরিমাণ দুই কোটি ৬৯ লাখ ৭৩ টাকা। এই ভ্যাট যথাসময়ে পরিশোধ না করায় ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক দুই শতাংশ হারে সুদ ৬০ লাখ ২২ হাজার ৬৬৯ টাকা প্রযোজ্য।
এছাড়াও প্রতিষ্ঠান থেকে জব্দ করা সিএ রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে প্রকৃত বিক্রয়মূল্য ৫৫ কোটি ৫৫ লাখ ১২ হাজার ৮৬৫ টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ দাখিলপত্রে বিক্রয়মূল্য ২৫ কোটি ৮৫ লাখ ৭১ হাজার ৮৬১ টাকা প্রদর্শন করেছে। এর মাধ্যমে সুমি’জ কেক ২৯ কোটি ৬৯ লাখ ৪১ হাজার চার টাকা বিক্রয়মূল্য কম প্রদর্শন করেছে। কম পরিশোধিত বিক্রয়মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ হিসেবে আট কোটি ৩৩ লাখ ২৬ হাজার ৯৩০ টাকা ভ্যাট প্রযোজ্য। এই সময়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তিন কোটি ৮৯ লাখ ২৬ হাজার ৮৫৯ টাকা ভ্যাট প্রদান করেছেন। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের পরিহার করা ভ্যাটের পরিমাণ চার কোটি ৪৪ লাখ ৭১ টাকা। এই ভ্যাট যথাসময়ে পরিশোধ না করায় ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক দুই শতাংশ হারে সুদ বর্তায় দুই কোটি ৭৮ লাখ ৪২ হাজার ৯৬ টাকা। প্রতিবেদন অনুসারে, সুমি’জ হট কেক ২০১৬ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সাত কোটি ১৩ লাখ ১৪৩ টাকা ভ্যাট পরিহার করেছে এবং এই পরিহার করা ভ্যাটের ওপর সুদ বাবদ তিন কোটি ৩৮ লাখ ৬৪ হাজার ৭৬৫ টাকাসহ সর্বমোট ১০ কোটি ৫১ লাখ ৬৪ হাজার ৯০৯ টাকা আদায়যোগ্য হবে। মইনুল খান জানান, তদন্তে উদঘাটিত ভ্যাট ফাঁকির টাকা আদায়ের আইনগত কার্যক্রম গ্রহণের জন্য মামলাটি ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটে প্রেরণ করা হবে। একই সঙ্গে এখন থেকে যথানিয়ম ও হারে ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট স্থানীয় ভ্যাট কার্যালয়কে সুপারিশ করা হবে।