জিরো টলারেন্স বনাম কালা টাকা সাদা করা

0

জি. মুনীর
অর্থমন্ত্রী এ এইচ এম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি বলেছেন, ‘আগামী জাতীয় বাজেটে সরকার অপ্রদর্শিত টাকা সাদা করার বিধান অব্যাহত রাখবে। কালো টাকা মূলধারার অর্থনীতিতে আনার জন্যই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি আরো বলেন, এই অপ্রদর্শিত টাকা সাদা করার বিধান অব্যাহত রাখা হবে, যদ্দিন না অপ্রদর্শিত সব টাকা বৈধ করে তোলা যায়। দেশের অর্থব্যবস্থা থেকে ক্রমে অপ্রদর্শিত টাকা কমিয়ে এনে একসময় এর অবসান ঘটানো হবে।’
গত ১৯ মে অর্থমন্ত্রী আরো জানান, বিগত কয়েক বছরে দেশে প্রচলিত ব্যবস্থার কারণে অপ্রদর্শিত টাকার পরিমাণ বেড়ে গেছে। তার মতে, ‘এই অপ্রদর্শিত টাকা যদি মূলধারার অর্থনীতিতে ফিরিয়ে আনা না হয়, তবে অর্থনীতি সঠিকভাবে পরিচালনা করা যাবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘এ ধরনের অপ্রদর্শিত টাকার ক্ষেত্রে উঁচু হারের রেজিস্ট্রেশন ফি, স্টাম্প ফি বাড়িয়ে সরকার ক্রমান্বয়ে সবার জন্য কমিয়ে আনছে আয়করের হার, স্টাম্প ডিউটি ও রেজিস্ট্রেশন খরচ, যাতে সবাই সহজে ও অনায়াসে কর দিতে পারে এবং এর মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ে। একসময় দেশে উঁচু হারের আয়কর চালু ছিল, কিন্তু সময়ের সাথে আয়কর বিশ্ব অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে কমিয়ে আনা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চলতি সমাপ্তপ্রায় অর্থবছরের জন্য অপ্রদর্শিত অর্থ ও সম্পদ বৈধ করার ব্যাপারে অসীম সুযোগ দেয়া হয়েছিল। শেয়ারবাজার ও রিয়েল এস্টেট শিল্পে কালো টাকা বিনিয়োগের সুয়োগ দেয়া হয়েছিল। ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুনের মধ্যে এই সুযোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, নির্ধারিত হারের কর পরিশোধ করে যারা তাদের অপ্রদর্শিত সম্পদ বৈধ করবে, তারা ইনডেমনিটি পাবে। আগামী ৩ জুন আসন্ন অর্থবছরের বাজেট পেশের কথা রয়েছে। সে পর্যন্ত অপেক্ষায় থেকে দেখা যাক, এবার কালো টাকা সাদা করার ব্যাপারে সরকার কী কী সুযোগ ঘোষণা করে। প্রতি বছর জাতীয় বাজেট ঘোষণার সময় ‘কালো টাকা সাদা করার’ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। সরকার ও অনেক বিজনেসম্যান কালো টাকা সাদা করার পক্ষে অবস্থান নেন। উল্টো দিকে সুশীলসমাজ, বিভিন্ন থিংকট্যাংক, মানবাধিকার গোষ্ঠী ও বিশিষ্ট নাগরিকবর্গ অবস্থান নেন এর বিপক্ষে। শেষোক্ত গোষ্ঠীর অভিমত, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সৎ করদাতাদের কর দেয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে। সেই সাথে জনগণকে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনে উৎসাহিত করে। এদিকে ব্যবসায়িক নেতৃবর্গ ও শিক্ষাবিদ গত ১৮ মে ‘সিটিজেনস প্ল্যাটফরম ফর এসডিজি’ আয়োজিত এক ওয়েবিনারে বলেছেন, অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকা বৈধ করা অর্থনীতির নীতির সাথে সাংঘর্ষিক এবং অসাংবিধানিক। একই সাথে এটি দেশের নাগরিক ও সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য অনিষ্টকর। তারা মনে করেন, বাজেটীয় কাঠামোর আওতায় কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া বছরের পর বছর ধরে দীর্ঘকাল চলতে পারে না। তারা প্রশ্ন তোলেন, কালো টাকা যদি সাদা করতেই হয়, তবে ওই টাকা কেন শেয়ারবাজার বা রিয়েল এস্টেট খাতের বদলে স্বাস্থ্য ও শিল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করা হবে না? তারা আরো বলেছেন, গণমাধ্যম, সমাজকর্মী, নাগরিক প্ল্যাটফরম, সুশীলসমাজের সংগঠনগুলোকে কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া বন্ধ করার দাবি নিয়ে দাঁড়াতে হবে। সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য কালো টাকা সাদা করার পদক্ষেপকে অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করেন। সিপিডির আরেক ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিভিন্ন দেশে কালো টাকা সাদা করার উদ্যোগ নেয়া হয় মাঝে মধ্যে, অব্যাহতভাবে নয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই সুযোগ দেয়া হচ্ছে বারবার। ল্যান্ডমার্ক ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ বৈধ করার কোনো সুযোগ থাকা উচিত নয়। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেন, কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন চলতে দেয়া যায় না। এটিকে রীতিতে পরিণত করা যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত আরেকটি ওয়েবিনারে বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এ সুযোগ রাখা হলে নিয়মিত করদাতারা হতাশ হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, এ সুযোগ বন্ধের পাশাপাশি যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কাছে পড়ে থাকা ঋণের অর্থ আদায়ে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। তার মতে, যেসব ঋণখেলাপি পরপর তিনবার ঋণ তফসিলি করার পর আবারো ঋণখেলাপি হয়, তাদেরকে ‘ইন্টেনশনাল ডিফল্টার’ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। ড. ফরাস উদ্দিন মনে করেন, রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যমান এ সমস্যার সমাধান হবে না। শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া শুধু সরকার একা এই সংস্কারপ্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে না। ‘তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ, বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র সদস্যসচিব ড. আনু মুহাম্মদ এই ওয়েবিনারে বলেন, ‘বাংলাদেশের ধনীরা পাকিস্তানের ২২ পরিবারের তুলনায় অধিকতর আগ্রাসীভাবে ও কম সময়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। অব্যাহত দুর্নীতি ও অনিয়ম সুযোগ করে দিয়েছে নতুন নতুন ধনকুবের সৃষ্টির। আর বাংলাদেশে সম্পদ বৈষম্যের অন্যতম কারণ এটি। সুশাসনের অভাবে কালো টাকার আকার বাড়ছে। আর এই কালো টাকা সমাজে বৈষম্য আরো বাড়িয়ে তুলছে।’ তিনি আরো বলেন, বেশির ভাগ অপ্রদর্শিত সম্পদ অর্জিত হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে। অধ্যাপক ড. এ কে এম মতিউর রহমান বলেন, যারা কালো টাকার পাহাড় গড়েছে, তারা এই টাকা বাংলাদেশে রাখা নিরাপদ মনে করে না। তাই এরা ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তায় ওই কালো টাকা বিদেশে পাচার করে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোও চায় বাংলাদেশে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ হোক। ‘ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’ (টিআইবি) মনে করে, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ। তা ছাড়া এই প্রক্রিয়া সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান দুর্বল করে তোলে। এই উপলব্ধি মাথায় রেখে টিআইবি আহ্বান জানিয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ না রাখার।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালো টাকার সুযোগ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাড়ানোর ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যকে অনৈতিক আখ্যায়িত করে বলেন, শেষ পর্যন্ত কালা টাকা সাদা করার সুযোগ কর-ব্যবস্থায় খেলাপি হওয়ার সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। কারণ, এ প্রক্রিয়া বৈধ ও সৎ করদাতাদের মধ্যে কর পরিশোধে নিরুৎসাহিত করবে। টিআইবিও, বাজেটে এ ধরনের সুযোগ রাখার বিষয়টি বৈষম্যমূলক ও অসাংবিধানিক হিসেবে বিবেচনা করে। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই সুযোগ বহাল রাখার ঘোষণা দিয়ে সরকার বৈধভাবে করা ‘অপ্রদর্শিত আয়’ এবং দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত ‘কালো টাকার’ মধ্যকার পার্থক্য বিলুপ্ত করে দিয়েছে। এর ফলে দেশে দুর্নীতিবাজদের জন্য সৃষ্টি হবে একটি উদার পরিস্থিতি। কারণ, দুর্নীতি ও চাঁদবাজির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। টিআইবি আশা করছে, সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসবে নয়তো তা হবে একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ন্যায়নীতি প্রশ্নের মুখে পড়বে। তিনি অত্যন্ত যৌক্তিক একটি প্রশ্ন তোলেন : যদি ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যায়, তবে একজন সৎ করদাতা কেনো ৩৫-৩০ শতাংশ হারে কর দিতে যাবে? সরকার হয়তো ভাবছে কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারের কিছু রাজস্ব আয় হবে। কিন্তু এর ফলে বিপুলসংখ্যক করদাতাকে খেলাপি হতে উৎসাহিত করবে। এর ফলে নতুন ধরনের করফাঁকির সংস্কৃতির জন্ম নেবে। তাই এখনই চরম সময় কালো টাকা সাদা করার এ প্রক্রিয়া বন্ধ করার।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশের অর্থনীতিতে কালো টাকার উপস্থিতি ক্রমশ কমিয়ে এনে একসময় এর অবসান ঘটানো হবে। তবে তা আদৌ সম্ভব হবে কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণের অবকাশ রয়েছে। কারণ আমরা দেখেছি, সরকার সেই ১৯৭১ সাল থেকে বিভিন্ন অর্থবছরে কালো টাকার মালিকদের ট্যাক্স অ্যামনেস্টি দিয়ে আসছে। কিন্তু কালো টাকা সাদা করার ব্যাপারে খুব একটা সাড়া মেলেনি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দেয়া হিসাব মতে, ১৯৭১-২০১৭ সময়ে মাত্র ১৮ হাজার ৩৭২ কোটি ১৩ লাখ কালো টাকা সাদা করা হয়েছে। এর জন্য সরকার কর হিসেবে পেয়েছে এক হাজার ৫২৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ২০০৭-২০০৯ পর্যন্ত সামরিক বাহিনী-সমর্থিত সরকারের সময়ে ৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে। দেশের যে কোনো সরকারের আমলের তুলনায় এটি সর্বোচ্চ পরিমাণে কালো টাকা সাদা হওয়ার ইতিহাস।
বাংলাদেশে কালো টাকা একটি অপ্রত্যাশিত বাস্তবতা। তবে দেশের কালো টাকার পরিমাণ নির্ধারণ খুবই কঠিন। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও কোনো নির্ভরযোগ্য উপায় নেই কালো টাকা পরিমাপের। তবে গবেষণা সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থগুলো সব সময় চেষ্টা করে তা জানার। আইএমএফের ‘Shadow Economies Around the World : What Did We Learn Over the Last 20 Years’ শীর্ষক ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি দলিল মতে, বাংলাদেশে কালো টাকা বা শ্যাডো ইকোনমির আকার হচ্ছে দেশটির মোট জিডিপির ২৭.৬০ শতাংশ। ১৯৯৩ সালে এটি ৩৭.১২ শতাংশ। ১৯৯১ সালের পরবর্তী সময়ে এটিই সর্বোচ্চ। কালো টাকা তথা শ্যাডো মানি হচ্ছে যেকোনো দেশের জন্যই একটি সামাজিক ব্যাধি। দেশের নাগরিক সাধারণের জন্য এটি অনিষ্টকর। অথচ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করার ব্যাপারে এদের নেই কোনো বাদ-প্রতিবাদ। কারণ, এ ব্যাপারে এদের নেই প্রয়োজনীয় সচেতনতা। কালো টাকা কী, কিভাবে এর সৃষ্টি, কোথায় এই কালো টাকা ব্যয় হয়, কালো টাকা তাদের কী ক্ষতি করে, সে সম্পর্কে এদের নেই সুস্পষ্ট ধারণা। তাই সরকার সহজেই দেশে কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে পারছে। কালো টাকার কোনো আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা নেই। সাধারণত কালো টাকা বলতে বুঝি হিসাবের খাতায় উল্লেখ না করে অর্জিত অর্থকে। একজন অবৈধ উপায়ে যে অর্থ উপার্জন করে, তা কালো টাকা। অপর দিকে কেউ যদি বৈধ পথে করযোগ্য অর্থ ও সম্পদ অর্জন করার পর নির্ধারিত কর পরিশোধ করে না এবং এই অর্থ বা সম্পদ অর্জনের বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে না জানায়, তবে অর্জিত সে অর্থ ও সম্পদ কালো টাকা বা লুক্কায়িত সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। তাই কর্তৃপক্ষের সবুজসঙ্কেত ছাড়া কালো টাকা ঘোষিত ও আনুষ্ঠানিক ব্যবসায়িক লেনদেনে ব্যবহার বৈধ নয়। এ ধরনের অর্থের লেনদেনকে অভিহিত করা হয় অনানুষ্ঠানিক, নিয়মবহির্ভূত, গোপন, লুক্কায়িত, অনথিবদ্ধ, করবহির্ভূত ও হিসাববহির্ভূত লেনদেন নামে। অনেকে কালো টাকার অবৈধ ব্যবহারকে শ্যাডো ইকোনমি, গ্রে মানি, ক্যাশ মানি ইত্যাদি নামেও উল্লেখ করেন। কালো টাকা কিভাবে সৃষ্টি হয়? বিভিন্নভাবে অবৈধ লেনদেন কোনো ব্যক্তি বা মহলকে কালো টাকা সৃষ্টিতে সহায়তা করে। বড় মাপে কালো টাকা আসে দুটি উপায়ে : অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এবং আনরিপোর্টেড তথা না জানিয়ে করা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। বৈধভাবে কিংবা অবৈধভাবে অর্জিত অর্থও যদি অর্জন করা হয় কর কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে, তবে এই অর্থও কালো টাকা হিসেবে বিবেচিত। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। একজন মালিক একটি ফ্ল্যাট বিক্রি করলেন এক কোটি টাকায়। তিনি চেকের মাধ্যমে পেলেন ৭০ লাখ টাকা। বাকি ৩০ লাখ টাকা পেলেন নগদে। এই ৩০ লাখ টাকা যদি তিনি প্রাপ্তির খাতে না দেখান তবে ওই ৩০ লাখ টাকা হয়ে যাবে কালো টাকা অথবা আনরেকর্ডেড টাকা। কর ফাঁকি, কর প্রশাসনের গাফিলতি ও কর কর্মকর্তাদের দুর্নীতির মাধ্যমের প্রচুর কালো টাকা সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে। অধ্যাপক ফ্রেডারিক শ্নিডার তার ‘Shadow Economies All Over the World: New Estimates for 162 Countries from 1999-2007’ শীর্ষক সমীক্ষায় উল্লেখ করেন, কর প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে শ্যাডো মানি বা ব্ল্যাক মানি বিভিন্ন দেশে বেড়ে চলেছে, যে কারণে বিভিন্ন ব্যক্তি ও কোম্পানি আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কাঠামোর বাইরে চলে যেতে পারছে। কালো টাকা সৃষ্টির পেছনে আরো যেসব অবৈধ কাজকর্ম রয়েছে, তার মধ্যে আছে : চাঁদাবাজি, জুয়া খেলা, চোরাকারবার, নেশাপণ্য ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, অবৈধ অভিবাসনের মাধ্যমে আয়, দুর্নীতি, কর ফাঁকি, ভবন ও জমিজমা রেজিস্ট্রি করায় তথ্য গোপন, হুন্ডি ব্যবসায়, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, জনপ্রতিনিধিদের নামে করমুক্ত যানবাহন আমদানি ইত্যাদি। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক করদাতা আনুষ্ঠানিক হিসাবের বাইরে ব্যাংকবহির্ভূত লেনদেন সম্পন্ন করেন।
কালো টাকা কোথায় খরচ হয়, সাধারণ মানুষ তা জানে না। কালো টাকার বড় অংশটি চলে যায় দেশের বাইরে। এর সামান্য একটি অংশ ব্যাংকে স্থায়ী আমানত করা হয়। কালো টাকার মালিকেরা বাকি টাকা ব্যয করে তাদের আরাম আয়েশের পেছনে। স্মার্ট, এলিগেন্ট ও ফ্যাশনেবল জীবনযাপনে। অনেকে বিদেশে তৈরি করেন তাদের সেকেন্ড হোম। বিপুল কালো টাকা দিয়ে অন্য দেশের নাগরিকত্বও কেনা হয়। একটা নির্ধারিত পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করলে অনেক দেশে নিশ্চিত নাগরিকত্ব মিলে। অপর দিকে বাংলাদেশের অনেকে বিভিন্ন সুইস ব্যাংকেও টাকা জমা রাখে। কালো টাকা হচ্ছে একটি আর্থসামাজিক দুষ্টক্ষত। কালো টাকা সূত্রে দেশে যে কালোবাজার দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে, তা অচিরেই আমাদের অর্থনীতিকে বিপন্ন করে তুলবে। কারণ, ব্ল্যাক মানি জাতীয় অর্থনীতির বিপরীতে সমান্তরাল আরেক অর্থনীতি গড়ে তুলছে। কালো টাকা সরকারের রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কর ফাঁকিকে উৎসাহিত করে। ধনী-গরিবেব ব্যবধান বাড়িয়ে তোলে। সম্পদ বৈষম্য সৃষ্টি করে। সমাজের নৈতিকতার মানে অবনতি ঘটায়। জাতিকে করে তোলে দুর্নীতিপ্রবণ। এক দিকে দুর্নীতি রোধে জিরো টলারেন্সের নীতি সমুন্নত রাখার কথা বড় গলায় বলা হবে, অপর দিকে কালো টাকা সাদা করার পথ বাজেটীয় কাঠামোয় উন্মুক্ত রাখা হবে- এ এক চরম বৈপরীত্য। সরকারকে কালো টাকা সাদা করার আত্মঘাতী প্রক্রিয়া অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। নইলে দুর্নীতির পাগলা ঘোড়ার সদম্ভ পদচারণা বন্ধ করা কিছুতেই সম্ভব হবে না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট