অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের খাদ্যাভ্যাস কেমন হবে?

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্মের ১৮-৩৬ মাস বয়সের মধ্যে যদি ব্যবস্থা নেওয়া যায়, যথোপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা, পুষ্টি ব্যবস্থাপনা- এমনকি প্রশিক্ষিত অটিজম থেরাপিস্টের মাধ্যমে থেরাপি প্রদান করা যায়, তাহলে অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যেতে পারে। অটিজমের সঠিক কারণ যেহেতু এখনো নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তাই গবেষকরা প্রতিটি ধারণা নিয়ে গবেষণা করছেন, তার মধ্যে খাদ্য বিদ্যমান। খাদ্যের বিভিন্ন উপাদান নিয়ে পরীক্ষা করে দেখছেন, কোন একটি খাবার পরিহার করলে ও ভিটামিন মিনারেলের ঘাটতি পূরণ করলে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর অনেক উপসর্গের তীব্রতা কমানো যেতে পারে।
খাদ্যজনিত কারণে অটিজম হয় না। তবে গ্লুটিন ও কেজিনযুক্ত খাবার পরিহার, রক্তের শর্করার ভারসাম্য রক্ষা, ভিটামিন ও মিনারেলসের ঘাটতি পূরণ, থাইরয়েডের কার্যকারিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অটিজম বাচ্চার অতি চঞ্চলতা, আক্রমণাত্মক আচরণ, মনোযোগ স্বল্পতা, চক্ষু যোগাযোগহীনতা, বিকৃত অঙ্গভঙ্গি ও অন্যান্য উপসর্গের তীব্রতা কমানো যেতে পারে।
অটিজমের সমস্যা সমাধানে খাবারের গুরুত্ব বিবেচনা করে দেখছেন গবেষকরা। তার মধ্যে রয়েছে:
১. গ্লুটিন ও কেজিনযুক্ত খাবার বর্জন করতে হবে। অটিজম শিশুদের খাদ্যে গ্লুটিন (গম, যব, বার্লি, রাই, ইস্ট ইত্যাদি) ও কেজিন (দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার) বর্জন করতে হবে। কারণ গ্লুটিন ও কেজিনযুক্ত খাবার অটিজম শিশুদের ত্রুটিপূর্ণ পাচন, শোষণ ও বিপাক ঘটায়। ফলে শিশুদের মধ্যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। সে জন্য খাদ্যতালিকা থেকে গ্লুটিন ও কেজিনযুক্ত খাবার ধীরে ধীরে সরিয়ে অস্থিরতার পরিমাণ কমানো যায়।
২. অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অস্বাভাবিক দেখা যায়। এতে শিশুদের মধ্যে মনোযোগ কমে যায়, হাইপারঅ্যাকটিভিটি বা অস্থিরতার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাই অটিজম শিশুদের খাবারে সরাসরি চিনি বা মিষ্টি না দেওয়াই ভালো।
৩. থাইরক্সিন হরমোনের নিঃসরণ কম থাকায় বেশিরভাগ অটিস্টিক শিশুর হাইপোথাইরয়েডিজম দেখা দেয়। মানসিক অক্ষমতা, কথায় অস্পষ্টতা ও স্নায়বিক দুর্বলতা ইত্যাদি উপসর্গ পরিলক্ষিত হয়। থাইরক্সিন হরমোন নিঃসরণ কম থাকে। তাই
থায়রয়েড হরমোন তৈরির জন্য সামুদ্রিক মাছ, আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়ালে অটিজম শিশুর মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তি ও স্নায়বিক উন্নয়ন ঘটানো যায়।
৪. সয়া সসযুক্ত খাবার ও টেস্টিং সল্টযুক্ত খাবারও শিশুর অস্থিরতা বাড়ানোর অন্যতম কারণ।
বেশ কিছু অটিজম বিষয়ক গবেষক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা এবং অন্ত্রের মধ্যে খুবই শক্তিশালী এক ধরনের সম্পর্ক আছে। তাই তারা খাদ্যের ভূমিকার ওপর একটু বিশেষ নজর দিয়েছেন। কিন্তু এত বিশাল খাবারের তালিকা থেকে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর জন্য কোনগুলো সর্বোত্তম, তা নির্ধারণ করবেন কীভাবে? অনেক সময় দেখা যায়, প্রোবায়োটিক বা বন্ধুসুলভ ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ খাবারসমূহ অটিজমের উপসর্গগুলো দমিয়ে রাখতে সাহায্য করে। সুষম পুষ্টির গুণ নিশ্চিত করতে, পরিপাকতন্ত্রের স্বাস্থ্যকর অবস্থা বজায় রাখতে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে খাবারগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উপযুক্ত খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্যসম্মত পরিপাকতন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ অটিজমের উপসর্গগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা বিরক্তিকর পেটের সমস্যাগুলোর মধ্যে পেটে ব্যথা, দলা বা চাকা অনুভূত হওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া এবং পেট ফাপানোয় বেশি ভুগে থাকে। বিরক্তিকর পেটের সমস্যা মূলত তথাকথিত গ্যাস্ট্রোকলিক রিফ্লেক্স দ্বারা উদ্ভুত হয়, যা কোলনকে খাবার হজম করার জন্য প্রস্তুতের জানান দেয়। বিরক্তিকর পেটের সমস্যায় আক্রান্তদের গ্যাস্ট্রোকলিক রিফ্লেক্সটি অনেকটা আগে থেকে সক্রিয় থাকে বলে মাংসপেশীর স্প্যাম ও অত্যাধিক সক্রিয়তায় বেদনাদায়ক এ অবস্থার তৈরি করে। এ অবস্থার কার্যকর প্রতিরোধের জন্য অটিজমে আক্রান্তদের সহজে হজম হয় এবং দ্রুত গ্যাস্ট্রোকলিক রিফ্লেক্সটিকে কার্যকর না করে সাধারণত এমন খাবার খাওয়াতে হবে। এ ধরনের খাবারগুলোই অটিজমের কার্যকর চিকিৎসার দাবিদার।
যেসব খাদ্য এড়িয়ে যাওয়া উচিত সব সময়। অটিজমে আক্রান্ত শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের কার্যকরভাবে এড়িয়ে যাওয়া উচিত এমন খাবারগুলো হলো:
>> গ্লুটিন ও কেজিন আছে এমন খাবার, সেগুলো বাচ্চার মস্তিষ্কে আসক্তি তৈরি করতে পারে এবং হাইপার অ্যাকটিভিটি বাড়িয়ে দিতে পারে। আশার কথা হলো, আমাদের দেশে যে ধরনের খাদ্য আমরা খাই, যেমন- ভাত, ডাল ইত্যাদিতে গ্লুটিন থাকে না। কিন্তু আটার মধ্যে গ্লুটিন অনেক থাকে। তাই আটার তৈরি যেকোনো খাবার বাচ্চাকে দেওয়া যাবে না। এমনকি দোকানে যেসব চিপস, চকলেট, প্রক্রিয়াজাত খাবার পাওয়া যায়; তার সবগুলোর মধ্যেই গ্লুটিন আছে। এমনকি চিকেন ফ্রাইতেও আটা ব্যবহার করা হয়। তাই এসব খাবার বাচ্চাকে একদম বন্ধ রেখে দেখতে হবে বাচ্চার আচরণগত কোনো পরিবর্তন আসে কি-না। গবেষণায় প্রমাণিত, গ্লুটিন এমনই একটি উপাদান যা বিশেষ শিশুদের মস্তিষ্কের অপোয়েড রিসিপ্টরের সাথে যুক্ত হয়ে হেরোইন বা মরফিনের মতই নেশার উদ্রেক ঘটাতে পারে।
>> তেমনই সব ডেইরি প্রোডাক্টে (দুগ্ধজাত খাবার) কেজিন নামক উপাদান থাকে, যা বিশেষ শিশুর পরিপাকতন্ত্র পরিপাক করতে পারে না এবং হাইপার অ্যাকটিভিটি বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই সব ধরনের দুধ ও ডেইরি প্রোডাক্ট বন্ধ করে দেখা যেতে পারে যে বাচ্চার আচরণে কোনো পরিবর্তন হয় কি-না। যদি হাইপার অ্যাকটিভিটি কমে আসে, তাহলে দুধের বিকল্প খাবার বাচ্চাকে অভ্যস্ত করাতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তে ক্যালসিয়াম লেবেল পরিমাপ করে ক্যালসিয়াম দিয়ে, বাচ্চার ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে।
>> অপাচ্য আঁশযুক্ত খাবারগুলো হজমে খুবই সমস্যা করে। তাই যতটা সম্ভব এ ধরনের অপাচ্য আঁশযুক্ত খাবার কম দিতে হবে। যদিও তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী হয়। অপাচ্য আঁশযুক্ত খাবারগুলোর মধ্যে কিছু সবুজ শাক-সবজি যেমন- পালং শাক, লেটুস পাতা, বিভিন্ন লতাপাতা জাতীয় শাক, যেসব খাবারের মধ্যে গম, বাদামি গম ও গম বীজ থাকে, ফল-মূল, যেমন- আনারস, সবুজ মটরশুটি; ক্যাপসিকাম জাতীয় মরিচ, পেঁয়াজ, শালগম, বাঁধাকপি, ফুলকপি এবং টমেটো ইত্যাদি খাবারগুলো এড়িয়ে যেতে হবে।
>> চর্বিযুক্ত খাবারসমূহ হজম ক্রিয়াকে অধিকতর কঠিন করে ফেলে। চর্বিযুক্ত খাবার অটিজমে আক্রান্ত শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য বেশিরভাগ সময়েই কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়ার কারণ হয়ে থাকে। চর্বিযুক্ত খাবারসমূহর মধ্যে থাকে- যেকোনো ধরনের ভাজা খাবারসমূহ, মাংস, দুধ ও দুধজাত খাবার, সালাদসমূহ, পেস্ট্রি কেক ও অন্যান্য মিষ্টি বা ঝালজাতীয় বেকারিতে তৈরি খাবার।
>> কার্বোনেটেড দ্রব্যাদি যেমন সোডা অবশ্যই এড়িয়ে যেতে হবে। কেননা এটি পেট ফাপানো ও মাংসপেশীর ক্রাম্পের কারণ। এ ছাড়াও কার্বোনেটেড দ্রব্যাদিতে প্রচুর ক্যাফেইন থাকে, যা অবশ্যই এড়িয়ে যেতে হবে।
>> কফি ও অ্যালকোহল বিশেষভাবে এড়িয়ে যেতে হবে। কারণ এসব খাবার পরিপাকতন্ত্রের সমস্যার উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে থাকে। বিশেষ করে কফির ক্যাফেইন, কোলনকে সর্বদাই সক্রিয় করে রাখে।
>> কৃত্রিম মিষ্টি সৃষ্টিকারী খাবার সাধারণত অটিজম ও বিরক্তিকর পেটের সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের জন্য খুবই খারাপ। কৃত্রিম মিষ্টি সৃষ্টিকারী খাবারের স্বাদ এবং স্থায়ীত্ব বজায় রাখার উপাদানগুলো বিরক্তিকর পেটের সমস্যা তৈরির প্রধান কারণ। যেমন- দুগ্ধজাতপণ্য আইসক্রীম।
অটিজমে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসা হিসেবে যেসব খাবার দেওয়া যেতে পারে। তা হলো- যেকোনো ধরনের আলু যেমন- গোল আলু, মিষ্টি আলু, চীনা আলু ও গাজর, মিষ্টি কুমড়া, মুলা, বীটস ও লাউ, পাস্তা ও অন্যান্য নুডলস, ওটামিল বা জইচূর্ণ, চালের রুটি বা ফরাসি রুটি, চাল ও চাল শস্যজাতীয় খাবারসমূহ, কলা, আম, পেঁপে ও আপেলের সস, পেপারমিট, ক্যামোমাইল ও ফেনেলের মত চকলেট, বন্ধুসুলভ ব্যাকটেরিয়াসমৃদ্ধ খাবার, যেমন- দই।
আপনার অটিস্টিক সন্তান কিছুই খেতে চায় না বা সুনির্দিষ্ট কয়েকটি খাবারই কেবল খায়, এরকম পরিস্থিতিতে আপনাকে সবার আগে যে কথাটি বলা দরকার, তা হলো- আপনি একা এ অবস্থায় নেই। অধিকাংশ অটিস্টিক সন্তানের বাবা-মা এ অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ শিশুদের তুলনায় অটিস্টিক শিশুদের খাদ্যাভ্যাস গঠন ও খাদ্য গ্রহণে পাঁচগুণ বেশি সমস্যা দেখা যায়। যা একটি গবেষণায় দেখা গেছে। এক্ষেত্রে প্রথমে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. স্বল্পসংখ্যক খাদ্যগ্রহণ প্রবণতা,
২. নিজস্ব খাদ্যগ্রহণ রীতি (যেমন নিজ খাবার কাউকে স্পর্শ করতে না দেওয়া),
৩. খাবার নিয়ে বদমেজাজ বা দুর্বার ক্রোধ দেখানো ইত্যাদি,
৪. খুব অল্পসংখ্যক অটিস্টিক শিশুর মধ্যে অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ বা ওভারইটিংয়ের প্রবণতাও দেখা যায়।
তারপর দেখতে হবে খাদ্যগ্রহণে অনীহা সংক্রান্ত ব্যাপার হলো, যার মধ্যে প্রথমেই আসে:
> মেডিক্যাল সমস্যা, এ ক্ষেত্রে দেখা যায় খাবার সাধলেই শিশুটি দু’ঠোঁট শক্ত করে চেপে রাখে বা মুখ বন্ধ করে রাখে। এরকম হলে বুঝতে হবে শিশুটি খাবার গ্রহণে সরাসরি অনীহা প্রকাশ করছে। এর মানে এমনও হতে পারে, সে জানে খাবারটি খেলেই তার পেটে ব্যথা অনুভব করবে। অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে একটি সাধারণ সমস্যা হচ্ছে পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা। তারা তাদের সীমাবদ্ধ কমিউনিকেশন ক্ষমতার বা যোগাযোগের জন্যে হয়তো বোঝাতেও পারছে না। এদিকে আমরা বাবা-মায়েরা তাদের খাবার খাওয়ার জন্য ক্রমাগত চাপ দিয়েই যাই। শিশুর খাদ্যগ্রহণে অনীহার প্রবণতা দেখলেই তাকে একবার তার চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে এবং তার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে নিতে হবে। এটা তার জন্য উপকারী।
> ধৈর্য ধরতে হবে, অনেক শিশু কোনো খাবার দেখলে খাবারের আগে সেটা চেক করে দেখে। চেক করা বলতে তারা খাবারের ‘চেহারা’ দেখে, গন্ধ শোঁকে, আবার অল্প পরিমাণে নিয়ে চেখেও দেখে। এরপর তার মর্জি হলে বা ইচ্ছে হলে সে খাবে। অটিস্টিক শিশুর খাবার সংক্রান্ত সংবেদনশীল আচরণ একেক জনের একেক রকম। তারা নতুন কোনো খাবার গ্রহণ করতে সময় নেয়। এ জন্যই অটিস্টিক শিশুর খাদ্যাভ্যাস তৈরির ইস্যুতে বাবা-মাদের ধৈর্য ধারণের জন্য অনুরোধ করা হয়। শিশুটি যদি কোনো খাবার অনেকবার চেষ্টা করার পরেও খেতে অনীহা দেখায়, তাহলে বিকল্প অন্য খাবার দিয়ে চেষ্টা করুন। নির্দিষ্ট সময় ধরে খাবার খেতেই হবে, এরকম ‘যুদ্ধে নামার’ প্রয়োজন নেই। প্রথমে তার খাদ্যাভ্যাস তৈরির দিকে প্রাধান্য দিন, পরে সময় অনুযায়ী খাবার খাওয়ানোর জন্য সঠিক পদ্ধতিতে একটি খাবারের তালিকা তৈরি করুন।
> নিজে ক্রিয়েটিভ হোন, যাতে অটিস্টিক শিশু নতুন খাবারে আগ্রহ বোধ করে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো নতুন খাবার তাকে দিলে আপনি সে খাবার খেয়ে খুব মজা পেয়েছেন- এরকম ভাব করুন। তাকেও বলুন যে মজার খাবারটা সেও যেন একটু খেয়ে দেখে। প্রয়োজনে তার কোনো প্রিয় খাবারের সঙ্গে নতুন খাবারটি দিতে পারেন।
> খাবারের টেক্সচারের দিকটি দেখুন, অনেক অটিস্টিক শিশু টেক্সচারের প্রতি সংবেদনশীল হয়। খাবারের মান বা ধরন বা গন্ধ যাই হোক, তারা অনেক সময় এসব দিক দেখে না। বরং খাবারটা মুখে দিলে কেমন লাগে বা লাগতে পারে, সেটা নিয়ে বেশি চিন্তিত থাকে। এ ব্যাপারে টমেটোর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আস্ত টমেটো বা টুকরো করে কাটা টমেটো খেতে একরকম লাগে, কারো কাছে বিস্বাদ লাগে। আবার টমেটোকে সস বানিয়ে দিলে বা নুডলসে দিলে দেখা যায় তা শিশুটি ভালোই খাচ্ছে। অর্থাৎ একই খাবারকে একরূপে দিলে মুখে বিস্বাদ লাগলেও অন্যভাবে কনভার্ট করে দিলে তা খাদ্যাভ্যাসে যুক্ত করা সহজ হয়।
> নতুন নতুন খাবার দিন যাতে খাবারে নতুন আইটেম তাকে উৎসাহিত করতে পারে। অথবা নতুনভাবে খাবারকে উপস্থাপন করুন। যেমন- তাকে সস দেওয়ার সময় সস দিয়ে প্লেটে একটা ফুল বা হাসির ইমোজি এঁকে দিন বা পিৎজাতে সবজি দেওয়ার সময় সেগুলো দিয়ে একটি শেপ বানিয়ে দিন বা ভেজিটেবল কাটার দিয়ে সবজিকে নতুন শেপে কেটে দিন। কাজগুলো এমনভাবে করুন যাতে শিশুটি এগুলো দেখে। এতে খাবারের উপস্থাপন তার কাছে নতুন এবং ভিন্নতর লাগবে ও পরবর্তীতে সেই খাবারে আগ্রহী হয়ে উঠবে।
> আপনার শিশুটি হয়তো চাইতে পারে যে, সে যা খাবে তা তার পছন্দ অনুযায়ী হবে। কোনো খাবারের প্রতি অনীহা একটি সাধারণ ব্যাপার, এটি আমরা বড়রাও করি। তাই তার খাবার চয়েস করার অপশন বাড়িয়ে দেওয়া যায় কি-না, তা ভেবে দেখতে হবে। সেই সাথে তার পছন্দের মধ্যে বিভিন্ন ক্যাটাগরি সেট করা যায় কি-না, তাও ভেবে বের করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, আপনি ঠিক করলেন সে যেন একটি সবজি আইটেম খায় এবং সাথে যেন একটি প্রোটিন আইটেম থাকে। তখন তার সামনে সবজি এবং প্রোটিনের একাধিক আইটেম রাখুন, যাতে সে নিজ পছন্দ অনুযায়ী খাবারটি খেতে পারে। একইভাবে আপনি যখন নুডলস রান্না করবেন; তখন তাকে বলুন সে যেন তাতে একটা অতিরিক্ত উপাদান মেশায়। এসময় তার সামনে চিকেন বা সবজি রাখুন। সে যেটি মেশাতে চেয়েছে তা দিয়েই নুডলস রান্না করুন। তার এ কাজটির প্রশংসা করুন। দেখা যায় খাবারটি সে তেমন কোন বিপত্তি ছাড়াই খেয়ে নেবে।
> শিশুটিকে খেতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য যদি পুরস্কার দেওয়ার মতো বিষয় প্রচলন করেন, তবে তা সাময়িকভাবে কাজে দেবে। দীর্ঘমেয়াদী রিওয়ার্ডের অভ্যাস করলে তার জন্য মঙ্গলকর হবে না। এতে সে খাবারের আনন্দ হারিয়ে ফেলবে এবং খেলেও পুরস্কারের লোভে খাবে। আর কিছুদিন পর এ পুরস্কারের প্রতিও তার বেশি আকর্ষণ থাকবে না। তখন তা আপনার জন্য হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। আপনি আপনার শিশুর ব্যাপারে যত পর্যবেক্ষণশীল হবেন; তার জন্য একটি সুষম খাদ্যাভাস তৈরি তত সহজ হবে।
যুক্তরাজ্যের একটি চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান, অটিস্টিকা, এরা সাধারণত অটিজম গবেষণায় ভালো অবদান রাখেন। তাদের তথ্যমতে, এনারক্সিয়া বা ক্ষুধামন্দা রোগ নিয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়; তাদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনের একজনের অটিস্টিক সমস্যা রয়েছে। তাই ইদানিং অনেক গবেষকই অটিস্টিক শিশুর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে গবেষণায় আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
ভিটামিনের ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ অটিস্টিক শিশুর জন্য। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুখাদ্যে যদি ভিটামিন এ (মায়ের বুকের দুধ, কডলিভার অয়েল, ছোট মাছ, গাজর, পাকা পেঁপে, মিষ্টি কুমড়া, টমেটো, কলিজা, ডিম, পালং শাক, পাকা আম ইত্যাদি) খাওয়ানো হয়, তাহলে শিশুর দৃষ্টিশক্তির বৃদ্ধির পাশাপাশি চোখে চোখ রেখে কথা বলার প্রবণতা বাড়বে। ভিটামিন বি৬, ভিটামিন সি ও ম্যাগনেসিয়াম দিলে শিশুর ব্রেনের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ভিটামিন সি, গবেষণায় দেখা গেছে নির্দিষ্ট ডোজের ভিটামিন সি ব্যবহার করে অটিস্টিক বাচ্চার বারবার বিশেষ ধরনের অঙ্গ সঞ্চালনের অভ্যাসের উন্নতি ঘটেছে। গর্ভাবস্থায় যদি ভিটামিন ডি’র পরিমাণ কম থাকে, তাহলেও অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সুতরাং অবশ্যই শরীরে ভিটামিন ডি’র পরিমাণ ঠিক রাখতে হবে। পরবর্তীতে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর শরীরেও ভিটামিন ডি’র অভাব আছে কি-না তা পরিমাপ করে দেখা খুবই জরুরি। জিঙ্ক, অটিজম ও হাইপার অ্যাকটিভ ডিজঅর্ডারের বাচ্চাদের মধ্যে এর ঘাটতি দেখা যায়। জিঙ্কের ঘাটতির কারণে অনেক সময় বাচ্চাদের মনোযোগের অভাব দেখা দেয়, মানসিক বিকাশে সমস্যা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, নির্দিষ্ট মাত্রায় জিঙ্ক বাচ্চাকে দেওয়ার ফলে তাদের মনোযোগের বিশেষ উন্নতি ঘটে। ম্যাগনেসিয়াম ও ভিটামিন বি-৬ এর কম্বিনেশন ব্যবহার করার ফলে অটিস্টিক বাচ্চার আচরণ, সামাজিক যোগাযোগ, মেলামেশা, ভাব বিনিময় করা ইত্যাদিতে উন্নতি দেখা যেতে পারে। ম্যাগনেসিয়াম, এনসেফালোপ্যাথি ও ডেভলপমেন্টালে বিলম্ব প্রতিরোধ করে।
আয়রনের ঘাটতি থাকলে পাঁচগুণ বেশি অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে গর্ভাবস্থায়। অনেক সময় মেলাটোনিন মাত্রাটাও দেখা হয় যাদের ঘুমের সমস্যা তাদের জন্য। পিকনজেনল, এটা শরীরে গ্লুটাথায়োনের পরিমাণ বাড়ায়। যা বাচ্চার শরীর থেকে টক্সিক মেটাল বের করে দেয়। অধিকাংশ অটিস্টিক ও হাইপার অ্যাকটিভ ডিজঅর্ডারের বাচ্চার শরীরে এ গ্লুটাথায়োনের পরিমাণ কম থাকে। শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে, বাচ্চার মনোযোগ কোঅর্ডিনেশন বাড়ায় এবং হাইপার অ্যাকটিভিটি কমায়। কারনসাইন, এ সাপ্লিমেন্টের জোরাল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা আছে। সেইসাথে খিঁচুনি কমানোরও সক্ষমতা রয়েছে। কথা বলার সক্ষমতা ও সামাজিক যোগাযোগও বাড়াতে পারে কারনসাইন। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, এ উপাদানের অভাবে হাইপার অ্যাকটিভিটি, অন্যের সাথে ভাব বিনিময়ের সমস্যা, দুশ্চিন্তা, হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে হাত-পা ছোঁড়া ইত্যাদি বেশি হতে পারে। মায়ের দুধের মাধ্যমে বা অন্যান্য শিশু খাদ্যের মাধ্যমে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের অভাব পূরণ না হলে সেই বাচ্চার অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ২-৪ গুণ বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সম্পুরক খাদ্য হিসাবে দেওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন বিকাশগত সমস্যা, হাইপার অ্যাকটিভ ডিজঅর্ডার, অটিজম আক্রান্ত শিশুদের উন্নতি ঘটতে পারে।
ভিটামিন ও সাপ্লিমেন্ট, তা অনেককেই উপকার দেবে আশা করা যায়। তবে মনে রাখতে হবে, এসব সম্পুরক খাদ্যের মাধ্যমে যে উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তা ১-২ দিনের মধ্যে চোখে পড়বে না। অনেক সময় এ ক্ষেত্রে উন্নতি পরিলক্ষিত হতে ২-৩ মাস সময় লাগে। আবার সব ভিটামিন ও সাপ্লিমেন্টই একসাথে শুরু করা যায় না। শরীরে কোন কোন উপাদানের ঘাটতি আছে, কোনটি বেশি আছে তা নিরুপনের জন্য অনেক সময় ডায়াগনস্টিক টেস্ট করার প্রয়োজন পড়ে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যেসব খাবার বেশি দেওয়া প্রয়োজন, তা হলো- দেশি বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী শাক ও সবজি, দেশি যেকোনো মৌসুমী ফল ও ঘরে বানানো চিনি ছাড়া ফ্রেশ জুস, এপ্রিকট ইত্যাদি। প্রোটিনের জন্য নদী ও সাগরের মাছ, ডিম, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, আখরোট, বিভিন্ন ধরনের শিম ও শিমের বিচি, বিভিন্ন ধরনের ডাল। দুধের কেজিনের বিকল্প হিসেবে সয়াদুধ, অ্যালমন্ড বাটার বা অ্যালমন্ড মিল্ক অথবা অন্যান্য বাদামের তৈরি দুধ ইত্যাদি। চিনি বা মিষ্টি কিছুর বদলে খেজুর দেওয়া যাবে। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি মধু মাঝে মাঝে দেওয়া যাবে।
যেসব খাবার একেবারেই দেওয়ার প্রয়োজন নেই, তার মধ্যে রয়েছে- চিনি, জাঙ্ক ফুড, চকোলেট, চিপস, বাণিজ্যিকভাবে তৈরি জুস, কোমলপানীয়, ফাস্ট ফুড, ফ্রোজেন ফুড, প্রসেসড খাবার, প্রসেসড মাংস, পাউরুটি, বেক করা খাবার, বিভিন্ন ধরনের সিরিয়াল, কুকিস, পিৎজা, বিভিন্ন ধরনের ক্রেকার, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, পনির, আইসক্রিম, দই ইত্যাদি।
যখন কোনো কিছুতেই বাবা-মায়েরা পেরে ওঠেন না তাদের শিশুটিকে খাওয়াতে; তখন থেরাপির প্রয়োজন আছে। যা শিশু বিশেষজ্ঞ শিশুটির খাদ্যের ঘাটতির পরিমাণ নির্ণয় করেন ও একজন পুষ্টিবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্যতালিকা তৈরি করেন। পরবর্তীতে একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট সাহায্য নিয়ে শিশুটির খাদ্যাভ্যাস তৈরি করে দেন থেরাপির মাধ্যমে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা সেবায় বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও অকুপেশনাল থেরাপি চিকিৎসা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে।