রাসায়নিকের গুদাম সরাতে বলায় উল্টো ধমক খেয়েছিলেন ভাড়াটিয়ারা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥চুড়িহাট্টার ঘটনার পর রাসায়নিকের গোডাউন ও দোকান তুলে দিতে বাড়িওয়ালাকে অনুরোধ করেছিলেন আরমানিটোলার মুসা ম্যানসনের ভাড়াটিয়ারা। কয়েকবার অনুরোধ করলেও কান দেননি বাড়িওয়ালা। বরং ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ভাড়াটিয়াদের ওপর। শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) ভোররাতে সেই মুসা ম্যানসনের রাসায়নিক গুদামে আগুন লেগে মারা যান চারজন। ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছেন সেই বাড়িওয়ালা।
শনিবার (২৪ এপ্রিল) শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন দগ্ধরা এই তথ্য জানান।
বাড়ির ষষ্ঠ তলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন দেলোয়ার হোসেন। পরিবারটির ছয় সদস্য দগ্ধ হয়েছেন। ছয়জনের পাঁচজন বার্ন ইনস্টিটিউটের পঞ্চম তলায় পোস্টঅপারেটিভে রয়েছেন। তারা হলেন- দেলোয়ার হোসেন, তার স্ত্রী লায়লা বেগম, ছোট ছেলে শাকিল হোসেন, বড় ছেলের স্ত্রী মিলি ও তার মেয়ে ইয়াশফা (২)। বড় ছেলে সাফায়েত হোসেন রয়েছে চতুর্থ তলায় লাইফ সাপোর্টে। দুই বছরের ইয়াশফার শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। দগ্ধ মায়ের কোলেই শুয়ে থাকে সে।
পরিবারটি ২০ বছর ধরে এই ভবনে আছে। তাদের কয়েকজন স্বজনও এখানে ভাড়া থাকেন। ভবনটি যখন নতুন তৈরি করা হয়, তখনই তারা ওঠেন। পরিবারের ছোট ছেলে শাকিল বলেন, ‘সেহেরির সময়। বিদ্যুৎ চলে গেলো। পোড়া গন্ধ। বড়ভাই দরজা খুলে দেখার চেষ্টা করছে কী হয়েছে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ধোঁয়া ঢুকে পড়ে। রাসায়নিক পোড়ার বিকট গন্ধে সবাই কাশতে শুরু করে। ঘরে শ্বাস নেওয়া যাচ্ছিল না। বড়ভাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। দরজা খুলে বের হওয়ার উপায়ও নেই। আধাঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিস এলো। আমরা জানালা দিয়ে মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে সংকেত দিতে থাকলাম। কিন্তু উপরে কেউ উঠতে পারছিল না। বাড়িটির নিরাপত্তাকর্মীকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। তিনি যে নিচে আগেই মারা গেছেন তা জানতাম না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ছাদে গিয়ে তালা দেওয়া কলাপসিবল গেইট ভাঙে। ধোঁয়া বের হওয়ার পর আমরা ছাদে যাই। এরপর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আমাদের ছাদ থেকে নামায়।’
শাকিল বলেন, ‘নির্মাণের পর বাড়িটির নিচতলায় ১৪-১৫ বছর ধরে কোনও দোকান বা কেমিক্যালের গোডাউন ছিল না। বাড়ির আগের মালিক ছিলেন মোহাম্মদ মুসা। ৬-৭ বছর আগে ক্যান্সারে মারা যান তিনি। এরপর বাড়ির দায়িত্ব পান তার ছেলে মোস্তাক আহমেদ চিশতী। তিনি পরিবার নিয়ে ধানমণ্ডিতে থাকেন। বাবা মারা যাওয়ার পরই বাড়ির নিচতলায় কেমিক্যালের দোকান ভাড়া দেন তিনি। বানিয়ে দেন গোডাউনও।’
বাড়িটিতে কেমিক্যালের দোকান বা গোডাউন না দেওয়ার জন্য ভাড়াটিয়ারা সবাই কয়েকদফায় নিষেধ করেছিলেন। এমনকি চুড়িহাট্টার ঘটনার পর বাড়ির ম্যানেজার আব্দুল কাদেরকেও অনুরোধ করেছিল শাকিলের পরিবার। বাড়িওয়ালা এতে কর্ণপাত করেনি। উল্টো গালিগালাজ করেছেন ভাড়াটিয়াদের।
শাকিল বলেন, ‘কেমিক্যাল দোকান ও গোডাউনে বেশি ভাড়া পাওয়া যায় বলে তিনি ধমক দিয়ে বলেন. টাকা কি তুমি দিবা?’
দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রীর ভাই খোরশেদ আলম (৫০) তার স্ত্রী চেশমেয়ারা বেগম (৪৫) ও ছেলে সাখাওয়াত হোসেন (২৭)। তারাও শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছেন।
বাড়িওয়ালা পলাতক
ঘটনার পর রাজধানীর বংশাল থানায় মুসা ম্যানশনের মালিক মোস্তফাসহ আটজনের নামে মামলা করেছে পুলিশ। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ১৫-২০ জনকে আসামি করা হয়। কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কয়েকজনকেও আসামি করা হয়েছে।
মামলার অপর আসামিরা হলেন- ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান, মোস্তফা, গাফফার, সাইদ, ফিরোজ, তারেক ও বাপ্পী।
মামলার এজাহারে পুলিশ উল্লেখ করেছে- ‘মুসা ম্যানশনের মালিক মোস্তফা আহম্মেদসহ অন্যান্য কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা মুসা ম্যানশনের নিচতলায় দাহ্য পদার্থ এবং কেমিক্যাল সংরক্ষণের জন্য দোকান-গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করে। কেমিক্যালের আগুন লাগার ফলে বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাসরোধে ও দগ্ধ হয়ে চারজনের মৃত্যু হয়। ভাড়াটিয়াদের বিভিন্ন আসবাবপত্র আগুনে পুড়ে আনুমানিক পঞ্চাশ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। উক্ত আসামিরা তাচ্ছিল্য করে মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার জন্য আবাসিক স্থলে দাহ্য পদার্থ ও কেমিক্যাল সংরক্ষণের জন্য দোকান/গোডাউন ব্যবহার করে অবহেলার ফলে মৃত্যু ঘটিয়ে ও ক্ষতিসাধন করে পেনাল কোড আইনের ৩০৪-ক/৩৩৭/৪২৭ ধারায় অপরাধ করেছেন।’
বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহীন ফকির বলেন, ‘আসামিরা পলাতক। তাদের গ্রেফতারে বেশ কয়েকটি টিম কাজ করছে। আশা করছি দ্রুত গ্রেফতার করতে পারবো।’
নবদম্পতিসহ লাইফ সাপোর্টে তিনজন
নবদম্পতি আশিকুজ্জামান ও ইসরাত জাহান মুনাসহ তিনজন আইসিইউতে রয়েছেন। অপরজন সাখাওয়াত হোসেন। তাদের অবস্থার অবনতি হচ্ছে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ড. সামন্ত লাল বলেন, ‘অগ্নিদগ্ধ কেউ আশঙ্কামুক্ত নয়। আমরা সাধ্যমতো চিকিৎসা দিচ্ছি। যারা ওয়ার্ডে রয়েছেন, তাদের অবস্থা ভালোর দিকে।’