সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ করা হচ্ছে

0

বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা সমাজে দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠছে। সত্য প্রকাশই সাংবাদিকতার ব্রত। সে কারণে নানা সময় এই পেশার কর্মীদের ওপর বেআইনীভাবে নিপীড়ন-নির্যাতন চালানোর ঘটনা ঘটে চলেছে। মূলত অপরাধীচক্র এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষুদ্র একটি অংশ, সংবাদ বা মত প্রকাশের কারণে যাদের স্বার্থে আঘাত লাগে, তারাই সাংবাদিকদের ওপর অন্যায়ভাবে চড়াও হয়। এটা পরিষ্কার যে, আইনবিরোধী কাজের জন্য আইনসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। যিনি আইনবিরোধী বা আইনের অপব্যবহার করে অন্যায় অপকর্মে লিপ্ত হবেন তিনি যদি আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্যও হন তবুও তাকে আইনের মুখোমুখি করা যাবে। দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকা ও বাসস জেলা প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম শাহীনকে কুলাঘাট বিশেষ বিজিবির ক্যাম্পে নিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নির্মম নির্যাতনের পর এক বোতল ফেনসিডিল দিয়ে ছবি তুলে সামাজিকভাবে হেয় করার যে ঘটনা ঘটানো হয়েছে তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। সাংবাদিক সমাজ বলছে, এ পেশা ঝুঁকিপূর্ণ করা হচ্ছে।
জানা গেছে, গত ২৫ মার্চ সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম শাহীন তার ফেসবুক আইডিতে গরু“পাচারের একটি ছবি তুলে দিয়ে লিখেছিলেন, সীমান্ত উন্মুক্ত রেখে গরু“পাচার বন্ধ না করে কোন অবস্থাতেই সীমান্তহত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। ফেসবুকের এই পোস্টটিই তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। এটি খোলাখুলি না বললেও চলে যে, সাংবাদিকের বস্তুনিষ্ঠ ওই অভিমতে কাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। যারা চোরাচালানির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত তাদেরই এতে ক্ষিপ্ত হওয়ার কথা। কোনভাবেই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কোন সদস্যের এতে অসন্তুষ্ট হওয়ার কথা ছিল না। অথচ দেখা যাচ্ছে বিজিবির কতিপয় সদস্য এতে রুষ্ট হন এবং প্রকাশ্যেই জানান উক্ত সাংবাদিককে শিক্ষা দেয়া হবে। বিষয়টি সাংবাদিক শাহীন মোবাইলের খুদে বার্তার মাধ্যমে লালমনিরহাট ১৫ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল তৌহিদুল আলমকে চটজলদি জানিয়েও ছিলেন। বিষয়টি দেশের আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থার মাঠ পর্যায় ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছিল। তারপরও তার জীবনে নেমে আসে এমন দুর্বিষহ বিপর্যয়। কলেজের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে সাংবাদিক শাহীন সম্পর্কে স্থানীয়রা ভালভাবে জ্ঞাত আছেন বলেই তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন ও সম্মানহানির জন্য তারা প্রতিবাদী হয়েছেন। শনিবার জেলায় কর্মরত সকল প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীগণ শহরের মিশন মোড় চত্বরে সাংবাদিক শাহীনের ওপর নির্মম নির্যাতনের বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে মানববন্ধন করেছেন। সাংবাদিক শাহীন ও তার পরিবার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে সেনাপ্রধানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। পরিবারের বক্তব্য হলো, যেই দায়ী হোক তাকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এখানে সুষ্ঠু তদন্তে যদি সাংবাদিকও দায়ী হন, তারও বিচার করতে হবে। এক বোতল ফেনসিডিলসহ কোমরে দড়ি ও হাতে হাতকড়া দেয়া সাংবাদিক শাহীনকে সামনে রেখে তিন জওয়ানের মেশিনগান তাক করে দাঁড়ানোর ছবি ভাইরাল করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দেশের প্রচলিত তথ্যপ্রযুক্তি আইনেই এ বিষয়ে মামলা হতে পারত। কেননা, আইন এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্যই সমান। আমরা বিশ্বাস করি, কর্তৃপক্ষ সীমান্ত রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী বিজিবি বাহিনীর সুনাম রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেশবাসীর প্রশংসা অর্জন করবে। একই সঙ্গে সীমান্ত সংক্রান্ত দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনে নিয়োজিত সাংবাদিকদের প্রয়োজনীয় সহায়তা এবং নিরাপত্তা প্রদানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
এ প্রসঙ্গে আমরা আরও বলতে চাই, ফেসবুকে দেয়া একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে খুলনার সিনিয়র সাংবাদিক আবু তৈয়ব মুন্সীর বিরুদ্ধে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি মানহানীর মামলা করেছেন। পুলিশ গতপরশু রাতে তৈয়ব মুন্সীকে গ্রেফতার করে ৪ দিনের রিমাণ্ড চেয়েছে। আদালত তাকে কারা হাজতে পাঠিয়ে শুনানীর দিন ধার্য করেছেন। শুনানী শেষে হয়ত পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পেতে পারে। ঘটনাটি নিয়ে সাংবাদিক মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে এবং দাবি উঠেছে তথ্য নিরাপত্তা আইন বাতিলের। আমরা জানি না, তৈয়ব মুন্সীর লেখা ওই স্ট্যাটাস সত্যতা কতটা শক্ত। ফলে, সে বিতর্ক না গিয়েই বলতে পারি পুলিশ তাকে গ্রেফতারের আগে বিষয়টি তদন্ত করতে পারতো। রিমান্ডে নিয়ে ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ করেই তথ্য উদ্ঘাটন করতে হবে এমনটা নিশ্চয় চূড়ান্ত বিধি নয়। মামলা হলেই ধরে এনে তদন্ত করতে হবে তাও কিন্তু নয়। অভিযোগ তদন্ত করে মামলা রেকর্ডের বিধানও রয়েছে। একজন প্রবীণ সাংবাদিকের ক্ষেত্রে পুলিশ এই বিধানটা মানলে মানুষ খুশিই হতো। আমরা, আশা করবো, পুলিশ তৈয়ব মুন্সীর বয়স, অবস্থান ও পেশার সম্মানের দিকটা বিবেচনায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করবে এবং ন্যায়-বিচার নিশ্চিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।