মূল্যবৃদ্ধি সব সমস্যার সমাধান নয়

0

প্রধানমন্ত্রীর ইউরোপ সফরের সময়ে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। এমনিতেই দেশে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা জনসাধারণের জন্য দুর্বহ হয়ে উঠেছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় দেশে সব ধরনের পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির সাথে সাথে পণ্যমূল্যে আরেক দফা উল্লম্ফন ঘটায় তা জনমনে বিক্ষোভ-অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সফর শেষের সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, শুধুমাত্র তেলের ভর্তুকি খাতে সরকারকে বছরে ২৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সামগ্রিক ভর্তুকির অঙ্ক ৫৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন। বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে দেশে তেলের মূল্য না বাড়ালে বাজেটের বড় অংশই এ খাতে চলে যাবে এবং তাতে উন্নয়ন কর্মকান্ড ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কার কথাও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তেলের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে যেমন যুক্তি রয়েছে, তেমনি এ সময়ে তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে জনগণের কী ক্ষতি হচ্ছে তাও ভাবতে হবে। পরিবহন ভাড়াসহ পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির বিষয়টিও অস্বীকার করা যাবে না। বিশেষত দেড় বছরের করোনা মহামারির সঙ্কটে দেশে লাখ লাখ মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষের আয় রোজগার কমে গেছে। করোনা কালের বাস্তবতায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দিলেও তাতে কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থানে তেমন কোনো ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়নি। কোটি কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনবাস্তবতা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। এ সময়ে জ্বালানি তেলের মতো নিয়ামক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন ও দুর্বহ হয়ে উঠেছে। আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমূল্য সমাজে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সৃষ্টি করছে। গণপরিবহনের ভাড়া, চাল-ডাল, আটা, চিনি, ভোজ্যতেল, মাছ-মাংসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কোটি কোটি মানুষ অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। অপুষ্ট ও অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বহুলাংশে একটি অপুষ্ট জনগোষ্ঠির দ্বারা আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদনশীলতা ও সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা সম্ভব কিনা তা ভেবে দেখতে হবে।
করোনাকালের আগে থেকেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে একটি দীর্ঘমেয়াদি মন্দাবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছিল। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও একই ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। করোনাকালীন বাস্তবতায় তৈরি পোশাক রফতানি খাতে যে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছিল তার বিপরীতে এখনো আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধির নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও জনসাধারণের জীবনযাত্রায় এহেন বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটছে। লাখ লাখ কর্মহীন মানুষ যখন পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যয়ভার বহন করতেই হিমশিম খাচ্ছে, তখন স্কুল-কলেজ খোলার পর সন্তানের লেখাপড়ার খরচ এবং পণ্যমূল্য বৃদ্ধি তাদের জন্য বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো দুর্বহ হয়ে উঠেছে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনযাত্রা নির্বিঘœ রাখতে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির অস্বাভাবিক প্রবণতা রোধের পাশাপাশি কর্মহীন সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমে যাওয়ার সময়ও মূল্য সমন্বয়ের নামে আমাদের দেশে একাধিকবার জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি খাতে সরকারের ভর্তুকি কমানোর তাগিদ যথার্থ বলে ধরে নিলেও চলমান বাস্তবতায় দামবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরও ব্যয়বহুল করে তুলবে, সন্দেহ নেই। এ সময়ে কর্মহীন মানুষের জীবনযাত্রা নির্বাহ, কর্মসংস্থান ও আয়বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সুযোগে গণপরিবহনে ভাড়াবৃদ্ধিতে এক ধরনের নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বেপরোয়া তৎপরতার বিপরীতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানি তেলের ২৩ ভাগ মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে পরিবহন ভাড়া ২৭ ভাগ বৃদ্ধির চাপ সাধারণ দরিদ্র মানুষকে বহন করতে হচ্ছে। আমরা মনে করি, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের আগেই সংশ্লিষ্টদের নিষ্পত্তি করা উচিত।