লকডাউনে কর্মহীনতায় দিনমজুরদের করুণদশা

0

শেখ আব্দুল্লাাহ হুসাইন ॥ সরকারের ‘কঠোর লকডাউন’ ঘোষণায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দিনমজুররা। গত ১৪ এপ্রিল থেকে তারা ভোরবেলা কাজের সন্ধানে যশোর শহরে এসে কাজ না পেয়ে খালি হাতে বাসায় ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন।
কাঁচাবাজার, মাছবাজার, মুদি দোকান, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও ব্যাংক সীমিত সময়ের জন্য খোলা থাকলেও নির্মাণ সামগ্রীর দোকানগুলো পুরোপুরি বন্ধ থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা। লকডাউন ঘোষণার ছয় দিন পার হলেও সরকার বা বেসরকারি উন্নয়ন কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে দিনমজুরদের খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা না দেওয়ায় পরিবারের চাহিদা মেটাতে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকেই। এদিকে রোজার মধ্যে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আরও বেকায়দায় পড়েছেন নি¤œআয়ের খেটে খাওয়া মানষেরা।
করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ মারাত্মক রূপ ধারণ করায় সরকার ১৪ এপ্রিল থেকে প্রথম দফায় ২১ এপ্রিল পর্যন্ত টানা আট দিন সারা দেশে ‘কঠোর লকডাইন’ ঘোষণা করে। সোমবার আরেক দফা এক সপ্তাহ বাড়িয়ে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। অবশ্য কাঁচাবাজার, মাছবাজার,মুদি দোকান সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৩টা, হোটেল-রেস্টুরেন্ট সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা এবং রাত ১২ টা থেকে ভোর ৬টা ও ব্যাংক সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত খোলা রাখাার অনুমতি আছে। তবে নির্মাণ সামগ্রীসহ অন্যান্য সব দোকান ও শপিংমল পুরোপুরি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিশেষ করে নির্মাণ সামগ্রীর দোকানগুলো বন্ধ থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষেরা। নির্মাণ শ্রমিকরা বলছেন নিত্যপণ্যের দোকানিরা ঠিকই ব্যবসা করছেন, রিকশাচালকেরা লকডাউনের মধ্যেও কোনোরকম জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন, সীমিত আকারে ইজিবাইক চলছে রাস্তায়, মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার কোনো কিছুরই চলাচল বন্ধ নেই, সবই চলছে। অথচ তাদের কাজ পুরোপুরি বন্ধ।
গতকাল সোমবার সকালে যশোর শহরের লালদীঘির পূর্বপাড়ে গিয়ে দেখা যায়, শ শ দিনমজুর কাজের অপেক্ষায় অবস্থান করছেন। এ সময় তাদের অনেকের সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আব্দুল গফুর কাজের সন্ধানে যশোর শহরের শংকরপুরে ভাড়া বাসায় থাকেন। স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের চার সদস্যের ভরনপোষণ তাকেই করতে হয়। কিন্তু ১৪ এপ্রিল থেকে লকডাউন ঘোষণার পর এ পর্যন্ত তিনি কোনো কাজ পাননি। প্রতিদিন ভোর ৬টায় কাজের সন্ধানে লালদিঘির পাড়ে এসে বসেন, দিনশেষে খালি হাতে তাকে বাসায় ফিরতে হচ্ছে।
শহরের রায়পাড়ার বাসিন্দা ডাবলু মিয়া জানান, তার পরিবারে প্রতিদিন ৩শ টাকার ওপরে খরচ হয়। তাকে বাসা ভাড়া প্রতিমাসে গুনতে হয় ২হাজার টাকা। বর্তমানে কর্মহীন হয়ে পড়ায় স্থানীয় সমিতি থেকে প্রতি হাজারে সপ্তাহে ৫০ টাকা হারে সুদে ঋণ নিয়ে তিনি পরিবারের সদস্যদের চাহিদা মেটাচ্ছেন। মনিরামপুর উপজেলার ঢাকুরিয়া ইউনিয়নের কাটাখালীর বাসিন্দা আজিবর বিশ^াস জানান, নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় কেউ আসছে না কাজে নিতে। কঠোর লকডাউন ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি কোনো সহায়তা তিনি পাননি। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তাদের অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে।
শুধু আব্দুল গফুর, ডাবলু মিয়া ও আজিবর বিশ^াস নয়, এমন অভিযোগ তরফদার নওয়াপাড়ার মুনসুর আলী মোল্লা, রায়পাড়ার আব্দুস সামাদ, রায়পাড়া রেল স্টেশন এলাকার মো. উলফাতসহ অনেকেরই। এসব খেটে খাওয়া মানুষ জানান, গত বছর করোনা ভাইরাসে লকডাউনের সময় সরকার ও অন্যান্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে খাদ্যসহ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্ত এবার আরও ভয়াবহ অবস্থা হওয়ায় সরকার ১৪ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত টানা আট দিন সারা দেশে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে। অথচ কোনো সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। এ সময় খেটে খাওয়া মানুষেরা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সরকারের প্রতি খাদ্য সহায়তাদানের আহ্বান জানান।
এদিকে রোজার মধ্যে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ভোক্তারা সরকারের নজরদারির অবহেলাকেই দায়ী করছেন। গতকাল সোমবার যশোরের বড়বাজার চালবাজারে গিয়ে দেখা যায়, রোজার মধ্যে মোট চালের দাম প্রতি কেজিতে ১ টাকা বেড়েছে। স্বর্ণা চাল খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা, রোজার আগে বিক্রি হয়েছিল ৪৩ থেকে ৪৪ টাকায়। যশোর চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সুশীল কুমার বিশ^াস জানান, আগামী সপ্তাহে নতুন বোরো ধানের চাল বাজারে চলে আসলে দাম কমে আসবে।
বড়বাজার মাছবাজারের মুদি দোকানি সোহরাব হোসেন জানান, রোজার মধ্যে মোটা আমদানি করা মসুর ডাল প্রতি কেজিতে ৩ টাকা বেড়েছে। গতকাল সোমবার অস্ট্রেলিয়ান মোটা মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৬৮ টাকা, রোজার আগে ছিল ৬৫ টাকা। লাল চিনি বিক্রি হয়েছে ৬৭ টাকা, রোজার আগে ছিল ৬৫ টাকা। সাদা চিনি বিক্রি হয়েছে ৬৮ টাকা, রোজার আগে ছিল ৬৬ টাকা।
বাজারে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে বেগুন ও উচ্ছে। বেগুন বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০ টাকা ও উচ্ছে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭০ টাকা দরে। মাসখানেক আগেও বেগুন বিক্রি হয়েছিল ৫০ টাকা ও উচ্ছে বিক্রি হয়েছিল ৪০ টাকায়। কাঁচামালের আড়তদার মনিরামপুর ভা-ারের অন্যতম স্বত্বাধিকারী জহিরুদ্দিন কাজল জানান, রোজায় চাহিদা প্রচুর বেড়ে যাওয়ায় বেগুনের দামটা বেড়ে গেছে। তবে রোজার প্রথমে বেগুন ৯০ টাকায় উঠে গিয়েছিল। সামনের দিনগুলোতে আরও দাম কমে যাবে বলে তিনি আশা করছেন।
গতকাল সোমবার বাজার করতে আসা জনৈক শহীদুল ইসলাম জানান, রোজার আগে সরকারকে কঠোর হওয়ার কথা শোনা গেছে, তারপরও রোজার মধ্যে চাল, ডাল, চিনি ও সবজির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার যথাযথভাবে মনিটরিং করলে ব্যবসায়ীরা এসব পণ্যের দাম বাড়াতে পারত না।