নিত্যপণ্যের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি রুখতে হবে

0

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতিতে জনসাধারণ এক দিশাহারা অবস্থায় রয়েছে। বিগত প্রায় দুই মাস ধরে জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। এসব প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিত্যপণ্যের অসহনীয় দামবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। পণ্যমূল্য তাদের হাতের নাগালের বাইরে। অসাধু ব্যবসায়ী, সিন্ডিকেটের কাছে নিত্যপণ্যের বাজার জিম্মি হয়ে রয়েছে। তাদের ইচ্ছামতো দামবৃদ্ধি করে চলেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় সিন্ডিকেট বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে যেন সরকারও অসহায় হয়ে রয়েছে। এমন কোনো পণ্য নেই যার অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধি হয়নি। আজ একরকম দাম থাকলে কাল দেখা যায়, তার দাম গড়ে পাঁচ থেকে দশ টাকা বেড়ে গেছে। এ নিয়ে খুচরা ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের মধ্যে বাধানুবাদও ঘটতে দেখা যায়। চাল, ডাল, তেল, লবণ, চিনি, দুধ, আটা-ময়দা, পেঁয়াজ, মাছ-গোশত, শাক-সবজি, সব ধরনের মুরগী, গরম মশলাসহ সব ধরনের পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। নানা উছিলায় ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে চলেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধিতে দরিদ্র থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত সবাই অতিষ্ঠ ও অসহায় হয়ে পড়েছে। অনেকের দিন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। দুঃখের বিষয়, ব্যবসায়ীদের এমন অনৈতিক ও মুনাফালোভী চরিত্র বিশ্বের আর কোনো দেশে আছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাসে এসে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের মধ্যে আনন্দের পরিবর্তে বিষাদগ্রস্থ করে তুলেছে। তাদের জীবনযাপনের টানাপড়েন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সুবর্ণজয়ন্তীর আনন্দঘন মুহূর্ত তাদের কাছে ম্লান হয়ে পড়েছে। সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠেছে, তারা আনন্দ করবে নাকি সচ্ছন্দে নিত্যকার খাবার জোগাড় নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় থাকবে? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যেভাবে তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে, তাতে তাদের দুঃশ্চিন্তা করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। আমাদের দেশে জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধির বিষয়টি নতুন নয়। এ দামবৃদ্ধির যেমন কোনো নিয়ম-নীতি নেই, তেমনি জবাবদিহির ব্যবস্থাও নেই। স্বাভাবিক সময়ে তো বটেই বিশেষ কোনো উপলক্ষ এলেই জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে রমজান ও দুই ঈদ সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেট জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। আগে রমজানে ইফতার সামগ্রীসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধি একটি অপসংস্কৃতি হয়ে ছিল। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা কৌশল বদলে রমজানের আগেই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে যাতে বলা যায় রমজানে দাম বাড়েনি। এবারও তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে না। রমজান শুরু হতে আর বিশ-পঁচিশ দিন বাকি। তার আগেই অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা ছুঁতায় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বাজারে গিয়ে সাধারণ মানুষ কোনো কূল-কিনারা করে উঠতে পারছে না। তারা এক রকম বাজেট নিয়ে গেলে দেখা যায় তা দিয়ে তার চাহিদার পণ্য কিনতে পারছে না। ফলে বাধ্য হয়ে তাকে হয় কোনো পণ্য বাজারের ফর্দ থেকে বাদ দিতে হয়, না হয় চাহিদার তুলনায় কম কিনতে হয়। বিশেষ করে সীমিত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের কষ্টের কোনো সীমা থাকে না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, করোনার কারণে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়েছে, অসংখ্য মানুষের আয় কমেছে। রাজধানী ছেড়ে অনেক পরিবার গ্রামে চলে গেছে। সীমিত আয়ের অনেক মানুষ খরচ কুলাতে না পেরে পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে যারা রয়ে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠছে। এ চিত্র শুধু রাজধানীতে নয়, সারাদেশে একই চিত্র বিরাজমান। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, রমজানে টিসিবি দ্বিগুণ পণ্য নিয়ে বাজারে নামবে। এর কোনো আলামত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। টিসিবির পণ্য বিক্রির ধরণ কেমন তা নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ ধারণা রয়েছে। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, সরকার রমজানের আগে ব্যবসায়ীদের জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে অধিক ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়েছে।
উন্নত বিশ্বসহ অনেক দেশে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে জনসাধারণের সমস্যা হবে কিনা বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে কিনা, তা আগে বিবেচনা করা হয়। দাম বাড়ালেও তার যৌক্তিক কারণ তাদের সামনে তুলে ধরে ব্যাখ্যা দেয়া হয়। পার্শ্ববর্তী দেশেও যখন-তখন পণ্যের দামবৃদ্ধি করা হয় না। দামবৃদ্ধির ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে ভোক্তাদের স্বস্তি ও আনন্দ দেয়া হয়। আমাদের দেশে ঘটে এর উল্টো। নিয়ম-নীতির কোনো বালাই নেই। জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কমন কিছু উছিলা থাকে। সরবরাহ কম, বিশ্ববাজারে দামবৃদ্ধি ইত্যাদি উছিলায় দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্ববাজারে কত দামবৃদ্ধি হয়েছে এবং তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে দামবৃদ্ধি করা হয়েছে কিনা, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। বরং আমরা দেখছি, সরকার ব্যবসায়ীদের দামবৃদ্ধিকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করে কোনো কোনো পণ্যের দাম নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত এ দামেরও তোয়াক্কা করছে না। বলা হয়ে থাকে, যে ব্যবসায়ি সিন্ডিকেট জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করে থাকে তার সাথে সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীরা যুক্ত থাকে। ফলে সরকার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না। সরকারকে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে জনজীবনে যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে তা অবসানে সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।