উন্নয়নের ধারণায় পূর্ণাঙ্গতা অপরিহার্য

0
সালাহউদ্দিন বাবর
উন্নত দেশগুলো সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার ফলে জনগণের লিখিত-অলিখিত সব অধিকার ও তাদের বিভিন্ন চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে এসব দেশের সরকারি মেশিনারিগুলো এত সতর্ক এবং সেগুলো দক্ষতায় এতটা পারঙ্গম যে, মানুষের কষ্টভোগের মুহূর্তেই তার সমাধান তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। তার পরও সেখানে নাগরিকদের নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতার জন্য অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে। এসব কারণেই সেই দেশগুলো ‘কল্যাণমূলক রাষ্ট্র’ হিসেবে অভিহত হয়ে থাকে। এসব সংস্থা যাতে আরো দক্ষতার সাথে জনবান্ধব ভূমিকা রাখতে পারে তার জন্য গবেষণা ও প্রশিক্ষণের বহু সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মানুষের মূল চাহিদা হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। উন্নত প্রায় রাষ্ট্রই তার সমাধান করে এনেছে। তার পরও উন্নত রাষ্ট্রে ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে রয়েছে হাজারো স্বাধীন মিডিয়া। এর পরও এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, এই সুখ-সমৃদ্ধির জন্য নাগরিকদের ব্যয় করতে হয় বিপুল অর্থ, যা কর হিসাবে সরকারকে পরিশোধ করতে হয়। তবে অনেক দেশেই কর্মহীন বেকারদের জন্য রয়েছে নানা ধরনের অনুদান ও ভাতা। এসব বলার প্রয়োজন হলো এ জন্য যে, আমরা এই বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করার ঘোষণা শুনেছি। কিছু দিন আগে এ সম্পর্কিত সরকারি ঘোষণা প্রশাসনিকভাবে দেয়া হয়েছে। এখানে একটা সতর্কতামূলক কথা স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, ৫০ বছর আগে থেকেই এর প্রস্তুতি ও লক্ষ্য নিশ্চিত করা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকে শুরু করা উচিত ছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় এসে আজকে এমন ঘোষণার অর্থ হচ্ছে যে, অতীতে এ জন্য তেমন কিছু করা হয়নি। উন্নত রাষ্ট্রগুলো এই পর্যায়ে আসতে অনেক দিনের যে চেষ্টা ও সাধনা সক্রিয় ছিল তার জন্য কাজ বহু দিন আগে শুরু হয়েছিল।
সেই সাথে আমাদের সমসাময়িক কালে যেসব দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছিল, তারা ইতোমধ্যে শুধু মধ্য আয়ের দেশেই পরিণত হওয়ার লক্ষ্য অতিক্রম করে অনেক দূরে এগিয়ে গেছে, যেসব দেশের অবস্থা ৫০ বছর আগে আমাদের চেয়ে ভালো ছিল না। তাদের সম্পদ আর উন্নয়ন অবকাঠামো আমাদের চেয়ে খুব উন্নত ছিল না। তাদের হাতে জাদুর কাঠিও ছিল না, যার স্পর্শে সব কিছু মুহূর্তেই হয়ে গেছে। তারা নিজেদের পরিশ্রমে ও অধ্যবসায়ে এসব অর্জন করেছে। এখন এসব দেশের উন্নয়ন এবং উন্নয়নের পথ আর পরিকল্পনার রোলমডেল হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃত। সেসব দেশের উন্নয়নের কাহিনী শুনলে তা আমাদের কাছে স্বপ্ন বলে মনে হতে পারে। আসলে সেসব দেশের নেতারা জনগণকে স্বপ্ন দেখাতেন এবং সে স্বপ্নে তাদের উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমাদের নেতাদের সে স্বপ্ন দেখা এবং সম্ভবত দেখানো হয়নি। কেননা আমরা নিরন্ন থাকায় ঘুমই আসে না। ফলে স্বপ্ন দেখব কিভাবে? আর যারা সবাইকে স্বপ্ন দেখাবেন তারা তেমন স্বাপ্নিকও নন। তাদের এ ভাবনাচিন্তাও ছিল না। ফিরে যাই উন্নত দেশগুলোর কাহিনীতে। আজকে যারা উন্নয়নের শীর্ষে আছে তারাও এই পর্যায়ে এসেছে রকেটে চড়ে নয়। দিন ক্ষণ মাস বছরের হিসাবে সে পথ অবশ্যই ছিল দীর্ঘ আর সেটি মসৃণও নয়। বহু চেষ্টা সাধনা এবং দৃঢ় সংকল্প; সেই সাথে ধারাবাহিকভাবে চলেছে তাদের বিরতিহীন দায়িত্ব পালন। এমন নিষ্ঠা ও একাগ্রতাই আজ শুভ পরিণতির দ্বারে পৌঁছে দিয়েছে তাদের। এমন সাফল্য টেকসই করে রাখা এবং আরো এগিয়ে যাওয়ার জন্য নিরন্তর চেষ্টা অব্যাহত রেখে চলেছে। এমন উদ্যোগের লক্ষ্য জনগণের সমৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করা। সে দেশের নেতাদের নীতি ও পথের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য রয়েছে। উন্নয়নের পথ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও চিন্তা চেতনার পার্থক্যও ছিল। এ নিয়ে তর্কবিতর্ক নিয়তই উপযুক্ত ফোরামে চলত। কিন্তু যুক্তিতর্কে যা সর্বোৎকৃষ্ট সাব্যস্ত হতো তা বিনাদ্বিধায় সবাই গ্রহণ করে নিত।
উন্নয়নের পথে যা কিছু অন্তরায় বলে চিহ্নিত হয়েছে, তাকে পরিহার করার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র মতভেদ ছিল না এবং আর সে পথ পরিহার করার ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ হতো না। উন্নয়নের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে পুরোপুরি স্বচ্ছতা অনুসরণ করা হয়েছে। দুর্নীতি ও উন্নয়ন কাজের মানের প্রশ্নে কোনো আপস ছিল না। তাই এসব দেশের বিভিন্ন স্থাপনা এত বছর পরও এতটুকু ম্লান হয়ে পড়েনি। সেসব দেশের স্থাপনার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, স্থপতি এর যে নকশা প্রণয়ন করেছেন তা কালের বিবর্তনে এখনো হালের শৈলী থেকে তেমন পিছিয়ে পড়েনি। সম্মুখের সময়কে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। স্থপতিরা সে বিষয়ে কতটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন তা এখন বোঝা যায়। এখনো ব্যবহারের দিক থেকে তা অযোগ্য হয়ে পড়েনি, এসব স্থাপনা কালজয়ী হয়ে রয়েছে। আমাদের পিছিয়ে থাকার জন্য হয়তো কিছু অজুহাত বা কারণের কথা বলা যায়। আর সেটি হলো, ১৯৪৭ সালে দেশ যখন প্রথম ‘স্বাধীনতা’ লাভ করেছিল তখন এ অঞ্চলের মানুষ নানা অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হয়েছে। সে সময় এই অঞ্চলের নেতা বা জনপ্রতিনিধি যারা ছিলেন তারা আমাদের অধিকার ও সমৃদ্ধির পক্ষে কথা বলার তেমন সুযোগও পেতেন না। নানা জুলুম নির্যাতন সয়ে মূক হয়ে থাকতে হতো। তবে এ কথাও স্বীকার করতে হবে- এমন প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি আমাদের নেতাদের মধ্যে দূরদর্শিতা, চিন্তাচেতনা আর জ্ঞান গরিমার স্ফুরণ লক্ষ করা যায়নি। পাকিস্তান আমলে ও তার আগে ২০০ বছরে ব্রিটিশ শাসন শুধু আমাদের অর্থনীতিই ধ্বংস করেনি; শিক্ষা-দীক্ষায় আমাদের বরাবর পিছিয়ে রাখা হয়েছে। তাতে আমাদের বোধ বিবেচনা আর উন্নয়ন ধারণার বিকাশ ঘটেনি। পাকিস্তান আমলেও এই পরিস্থিতির খুব একটি উন্নতি পরিবর্তন ঘটেছিল, বলা যাবে না। পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে এ কথা বলতেই হবে, আমাদের এই অঞ্চল চরম বৈষম্যের শিকার থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এখান থেকে যেসব পণ্য রফতানি হতো, সে আয়ের হিস্যা এই অঞ্চল পায়নি। উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এখানকার মানুষের আর্থিক সঙ্গতি যাতে না হয় তারও কূটকৌশল আঁটা হতো। অতীত নিয়ে আর আলোচনা না করে এখন বরং আমরা আজকের কথা বলতে পারি। বাংলাদেশ আমলে আমরা গত ৫০ বছরে কী করতে পেরেছি? কতটা অগ্রগতি আমরা অর্জন করতে পেরেছি? সেটি বিবেচনায় নেয়া যায়। উপরে বলা হয়েছে, গত ৫০ বছরে আমাদের পর্যায়ে যেসব দেশ ছিল তারা আমাদের অনেক পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। অথচ আজ অনেক দেরিতে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। এখন দেখা যায়, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। কিন্তু উন্নয়নের ধারণার বিচ্ছিন্ন কোনো প্রকল্পের বাস্তবায়ন তেমন ফলপ্রসূ হতে পারে না। আমরা জানি না, গোটা দেশের উন্নয়ন ধারণা একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার অধীনে এসব করা হচ্ছে কি না। আর আমাদের আদৌ হালনাগাদ কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে কি না। তার সমন্বয় এবং তদারকি কিভাবে হচ্ছে? হঠাৎ কিছু একটা করা হলে; কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অধীনে সেগুলো না হলে এমনকি তা অকার্যকর হয়ে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। এসব পরিকল্পনার নীলনকশা নিয়ে আলোচনা বা পরামর্শের কোনো সংবাদ আমাদের জানা নেই। দেশের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনার সর্বোচ্চ ফোরাম হচ্ছে জাতীয় সংসদ। আজো তো সেখানে এমন আলোচনার কোনো আয়োজন হতে শুনিনি। কিংবা দেশের বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের কোনো সম্মেলনে জাতীয় উন্নয়ন নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো আলোচনা এবং তাদের সুচিন্তিত মত কিংবা সুপারিশ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির খবরও পত্রপত্রিকায় পাইনি। বিচ্ছিন্ন কোনো চিন্তাভাবনা কল্যাণ আনতে পারে না। অথচ এমন খবর প্রায়ই পাই, স্থানীয় এমপি বা ক্ষমতাসীনরা নির্মীয়মাণ রাস্তাঘাট বা কোনো প্রকল্প ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির জোরে নিজ স্বার্থ ও সুবিধার জন্য তার নকশা বা পরিকল্পনা পাল্টে ফেলেন। এমন ঘটনা অসংখ্য; এতে ব্যক্তি স্বার্থ সুরক্ষা পায় বটে কিন্তু সামগ্রিক স্বার্থকে তাতে জলাঞ্জলি দিতে হয়। এভাবে যদি পর্যায়ক্রমে ব্যক্তির স্বার্থের অনুকূলে খেয়াল খুশিমতো কাজ সম্পন্ন হয়, সেটি কোনোভাবেই সাধারণ জনগণের জন্য হিতকর হবারই নয়। বরং তাতে এলাকায় গুরুতর পরিবেশ বিপর্যস্ত হতে পারে। এলোপাতাড়ি রাস্তাঘাট বাঁধ ইত্যাদি তৈরি করা হলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় কৃষি ও যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে আর এসব অপরিকল্পিত পদক্ষেপ মারাত্মক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে থাকে। অথচ যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সামগ্রিক স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়াই বিবেচনায় রাখতে হয়। কিন্তু এটা রাজনৈতিক স্বার্থে উপরের কর্তৃপক্ষ উপেক্ষাই করে থাকে।
উন্নয়নের ধারণা এবং তার প্রয়োগ পদ্ধতির বাস্তব কারণেই বহুমাত্রিকতা রয়েছে। তাই এ নিয়ে বহু পরিশ্রম আর গবেষণার প্রয়োজন অপরিহার্য। উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা সে কথাই বলে। কেননা একটি প্রকল্প থেকে মানুষ দীর্ঘকাল ধরে যাতে সুবিধা ভোগ করতে পারে তেমন বিবেচনায় পর্যায়ক্রমিকভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অনুসরণ করা হয়ে থাকে। আমাদের পরিকল্পনাবিদদের সে সুযোগ দেয়া উচিত, যাতে তারা উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে গভীরে যেতে ও চিন্তা গবেষণা করতে পারেন। অবশ্যই সে পরিশ্রমের ভালো ফল পাওয়া যায়। জনপ্রতিনিধিদের যৌক্তিক এবং সুচিন্তিত মতামতের বিষয়টি অস্বীকার করছি না; কিন্তু তাদের খামখেয়ালিপনা আর অন্ধ স্বার্থকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত হবে না। দেশে জনপ্রতিনিধিদের ফোরাম তথা সংসদে এমন আলোচনা এখন কদাচিৎ হয়। উন্নয়নের সাথে গণতান্ত্রিক চেতনার সম্পর্ক রচনার জন্য সংসদের অর্থহীন আলোচনা পরিহার করা উচিত। দেশের প্রতিনিধিদের জনগণের চাহিদাকে আমলে নিয়ে তথ্যপূর্ণ কথা বলা হলে পরিকল্পনা প্রণয়নকারী বিশেষজ্ঞদের কাজ সহজ হবে এবং তারা বুঝতে পারবেন আসলে সাধারণ মানুষের চাহিদা কী। উন্নয়নের গতি এবং এ ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো বোঝার জন্য সরকারি মহলের গুরু দায়িত্বটা অনেক বেশি। উন্নয়নের সাথে অর্থের সম্পর্ক ওতপ্রোতোভাবে জড়িত। সে জন্য স্বচ্ছতার ব্যাপারে কোনো আপস কোথাও গ্রহণীয় হয় না। কেননা উন্নয়নের জন্য যে অর্থের সংস্থান করা হয়ে থাকে তা দেশের সাধারণ গরিব মানুষের করের পয়সা দিয়ে। এ কথা সবার জানা, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করেন। এসব ব্যক্তির কাছ থেকেই সরকার কর আদায় করে থাকে। তা ছাড়া উন্নয়নের জন্য যে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করা হয়, তা পরিশোধের সময় এই ঋণ বহু গুণে বেড়ে যায়। সেটিও পরিশোধ করতে হয় দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের স্বল্প আয় রোজগার থেকে। অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা জরুরি এ জন্য যে, বিশ্বের যে কয়টি চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ রয়েছে তাদের কাতারে উপরের দিকেই রয়েছে বাংলাদেশের নাম। তা ছাড়া দুর্নীতির বিষয়টি জানতে অন্যদের গবেষণা পর্যালোচনা থেকে আমাদের বুঝতে হবে এমন নয়, বাংলাদেশের প্রতিদিনের জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর পাতায় যদি চোখ রাখা হয় দেখা যাবে, দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে এবং বিদেশে তা পাচারের অসংখ্য কাহিনীর বহু বর্ণনা রয়েছে। আর এ কথা ভেবে অবাক হতে হয় যে, এমন শত শত অর্থ লোপাটের কাজটি কিভাবে অব্যাহতভাবে চলছে যেখানে প্রশাসন রয়েছে, বিধিবিধানের কমতি নেই। আর দেশের প্রশাসনকেও অদক্ষ বলে বিবেচনা করা যাবে না। বরং এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা বড় কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত থাকেন বলেই অর্থ লোপাটকারীদের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
এমন সব অনিয়ম হওয়ার কারণ মূলত দেশে সুশাসনের চরম দৈন্য। প্রশাসনের উচ্চ পদে যারা আসীন তাদের যোগ্যতা নিয়ে হয়তো কথা বলা যাবে না। কেননা নানা পরীক্ষা দিয়ে এবং প্রতিযোগিতা করেই তারা প্রশাসনের উচ্চ পদে সমাসীন হয়েছেন। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? এর সহজ জবাব হচ্ছে তাদের নীতি-নৈতিকতার দেউলিয়াত্ব। তাদের এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে এটা পরিষ্কার হয় যে, তারা মনে করেন এসব সেকেলে ধারণা ও ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়, যা প্রাচীনকালের চর্চার বিষয়। কিন্তু অন্যান্য দেশে তো এখানকার মতো এত দুর্নীতি হয় না। তবে কোন জাদুর স্পর্শে সেখানে সুনীতি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? এরও সহজ জবাব হচ্ছে তারা সত্যিকারভাবেই সুশাসনের চর্চা করেন আর এসবের জন্য যে বিধি বিধান আছে, সেখানে যে কঠিন জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে তার এতটুকু ঘাটতি সেখানে সহ্য করা হয় না। এ ক্ষেত্রে উচ্চ পদে যারা রয়েছেন তাদেরও কোনো অনিয়ম গ্রাহ্য করা হয় না। মাঝে মধ্যেই এমন খবর পাওয়া যায় যে, কোনো রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী বা অন্যান্য মন্ত্রী পদ হারানো এবং তাদের অপকর্ম খুঁজে শাস্তির বিধান করা হয়েছে। বিগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আয়কর নিয়ে অনিয়মের তদন্ত যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি আরো একটি খবর বিশ্বের মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে যে, ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট সারকোজি অনিয়ম করায় এখন তাকে জেল জীবনযাপন করতে হবে। এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা হলে দুর্নীতি থেকে কিঞ্চিৎ হলেও মুক্ত হওয়া যাবে, স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশে উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরো যে ফাঁকফোকর রয়েছে সেগুলো হলো- প্রকল্প তদারকির ক্ষেত্রে এমন একটা ঢিলেমি রয়েছে যে, এক দিনে করা সম্ভব যে কাজ সেটি পনেরো দিনেও শেষ হয় না। তাই স্বাভাবিকভাবেই বছর ঘুরলেই তার ব্যয় কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এ নিয়ে বহু অভিযোগ শোনা গেলেও তার কোনো প্রতিকার নেই। এই ধীরগতি অবলম্বনের কারণ তথা অযৌক্তিক কালক্ষেপণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই রাখা হয়। নিঃসন্দেহে এসব খুঁজে দেখলে এর মাঝেও দুর্নীতির বিরাট ঘাপলা আবিষ্কার করা যাবে। আরেকটা বিষয় নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা হতে পারে। দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে এখন কোনোভাবে বিরোধী দলকে সম্পৃক্ত করা হয় না। এ ক্ষেত্রে তাদের ‘অচ্ছুৎ’ করে রাখা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের যে ধারণা, সেখানের গণতন্ত্রের সংশ্লিষ্টতাকে বড় করে দেখা হয়। কেননা বিদেশীরাও দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন আর উন্নয়ন পরিকল্পনা কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থের বিষয় নয়। সব মানুষের জন্যই চাই উন্নয়ন আর অগ্রগতি। এই বিবেচনায় সরকারের প্রতিপক্ষের মত ও চিন্তাকে গুরুত্ব দেয়া দরকার। অথচ বাংলাদেশে সরকারি কার্যক্রমের সাথে ভিন্ন মতকে যুক্ত করা তথা তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া বস্তুত গণতান্ত্রিক চেতনাকে উচ্চকিত করার শামিল, যা উন্নয়নের ধারণার সাথে সম্পৃক্ত। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের অবজ্ঞা বা উপেক্ষা কোনোভাবে জাতির জন্য কল্যাণকর নয় এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে অপূর্ণাঙ্গ থেকেই যাবে। এ কথা ভাবতে হবে যে, দেশ কোনো দল বা গোষ্ঠীর নয়; সব মানুষের। এ বিবেচনা তখনই কার্যকর যখন গোটা দেশের মানুষকে নিয়েই ভাবনাচিন্তা করা হবে।