যশোর মুক্ত দিবসে অবহেলিত বিজয় স্তম্ভ

0

শিকদার খালিদ ও আকরামুজ্জামান॥ গতকাল ছিল ঐতিহাসিক যশোর মুক্ত দিবস। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম মুক্ত জেলা যশোর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এ দিনটি উজ্জ্বল হয়ে আছে। যশোর জেলা প্রশাসন প্রতি বছর দিবসটি উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করে। এবং যশোরের মানুষ প্রশাসনের সাথে স্বতঃষ্ফূর্তভাবে দিবসটি পালন করেন। গত বছর পর্যন্ত এ দিবসে মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয় শহরের মণিহার এলাকায় ‘মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী বীর শহীদদের স্মরণে নির্মিত বিজয় স্তম্ভে। ১৯৭২ সালের ২৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ বিজয় স্তম্ভের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। কিন্ত এ বছর গতকাল ঐতিহাসিক দিনটিতে সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়নি, শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাঁর সম্মানে নির্মিত ম্যুরালে। এ বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ তমিজুল ইসলাম খান বলেন, অন্যান্য বছরে যশোর মুক্ত দিবসের কর্মসুচির বড় আয়োজন করা হলেও বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির কারণে এবছরের সীমিত পরিসরে করা হয়েছে। যশোরের মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার প্রতিনিধিদের সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু ম্যুরালে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়।


যশোর ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি সভাপতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হারুন-অর-রশিদ বলেন, করোনা ভীতি সৃষ্টি করে আমাদের জাতীয় ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। যাতে করে ধর্মীয় মৌলবাদীরা সুযোগ পাচ্ছে। আমি জেলা প্রশাসনের এ কর্মসূচি জানতাম না। জানলে অবশ্যই গাড়িতে করে হলেও এরকম সীমিত পরিসরেই বিজয় স্তম্ভে ফুল দিয়ে সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য চাপ দিতাম। হারুন-অর-রশিদ আরও বলেন, এ বছরের যশোর মুক্ত দিবস পালনে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সভায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তরিকুল ইসলাম তারু বিজয় স্তম্ভে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সভায় উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা নেতৃবৃন্দ সায় দেননি।


তরিকুল ইসলাম তারু লোকসমাজকে বলেন, গতবারও আমরা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে র‌্যালি করে বিজয় স্তম্ভে গিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি। কিন্তু এ বছর নতুন জেলা প্রশাসক। তাকে অনুষ্ঠিত সভায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম গতবছর যশোর মুক্ত দিবসে পালিত কর্মসূচির বিবরণ পড়ে শোনান। এরপর সভায় করোনা সতর্কতার কারণে সীমিত পরিসরে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এবং দূরে না গিয়ে জেলা প্রশাসকের দফতর চত্তর থেকে র‌্যালি করে পাশে বঙ্গবন্ধু ম্যুরালে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। এসময় আমি (তরিকুল ইসলাম তারু) সীমিত পরিসরেই বিজয় স্তম্ভে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লিবারেশন ফোর্স-মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) এর উপ-অধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট রবিউল আলম বলেন, বরাবরই যশোর মুক্ত দিবসের কর্মসুচি যশোর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজন করা হয়। সেই আয়োজনের সূত্র ধরে আমরা ডিসেম্বরের ৬ তারিখে যশোর টাউন হল ময়দানে সর্বস্তরের মানুষ সমবেত হই এবং বিশাল র‌্যালি নিয়ে যশোর পুরাতন বাসটার্মিনালস্থ স্থাপিত শহীদ স্মৃতি স্তম্ভে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু এবছর করোনার সেকেন্ড ওয়েভের কারণে কর্মসূচি সীমিত করে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের পরিবর্তে শহরের বকুলতলাস্থ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিস্তম্ভ বঙ্গবন্ধু ম্যুরালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্থপতি। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সুতরাং বিশেষ এই পরিস্থিতিতে করোনার ঝুঁকি এড়াতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত যথার্থ হয়েছে। এ নিয়ে কেউ সমালোচনা করলেও সেটি গুরুত্ব পাবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
একই কথা বলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে যশোরে মুজিব বাহিনী প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেন মনি। তিনি বলেন, করোনার কারণে প্রশাসন এবারের কর্মসুচি ছোট করে ফেলেছে। এ বিষয়ে আমাদের কোনো কিছু করার ছিলো না। যেহেতু ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত দিবসের প্রোগ্রাম প্রশাসন আয়োজন করে থাকে। তবে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ক্ষেত্রে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভকে অবহেলা করা হয়েছে এমনটা মনে করা ঠিক নয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন।
তবে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন যশোরের প্রবীণ সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা রুকুনউদ্দৌলাহ। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণের কারণে সতর্কতা হিসেবে প্রশাসন এবারের প্রোগ্রাম সীমিত করেছে। তবে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সবাইকে অবশ্যই সকল শহীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভে যাওয়া উচিৎ ছিলো। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা রাখার প্রয়োজন ছিল বলেও মনে করেন তিনি।
সচেতন নাগরিক কমিটি-সনাক যশোরের সভাপতি সুকুমার দাস বলেন, ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের একটি গৌরবময় দিন। এদিনটিতে আমরা দেশের মধ্যে প্রথম শত্রুমুক্ত হয়েছিলাম। সেই থেকে দিবসটিকে আমরা যথাযথ মর্যাদায় পালন করে আসছি। তবে করোনার কারণে এবার সেই আয়োজনের কিছু ছন্দপতন হয়েছে। প্রোগ্রামটি যেহেতু প্রশাসনের সেকারণে প্রশাসন করোনা ঝুঁকির বিষয়টি ভেবে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী ১৬ ডিসেম্বরে আমরা যাতে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে প্রোগ্রাম নিতে পারি সে বিষয়ে সবাই উদ্যোগী হবেন।
এদিকে যশোর মুক্ত দিবস পালন উপলক্ষে গতকাল সকালে শহরের বকুলতলাস্থ বঙ্গবন্ধু ম্যুরালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে জেলা প্রশাসন, জেলা সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ যশোর ইউনিট, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড , মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড জেলা শাখা, জেলা জাসদ ও এলজিইডি।
এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান, পুলিশ সুপার আশরাফ হোসেন, সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মির্জ ইফতেখার আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজেক আহমেদ, রবিউল আলম, এএইচএম মযহারুল ইসলাম মন্টু, অ্যাড. অশোক রায়, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান বুলু, সনাকের সভাপতি সুকুমার দাস, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার আলম খান দুলু, যশোর ইনসটিটিউটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রওশন আরা রাসু প্রমুখ।