আমলাতন্ত্র ও জনগণের প্রত্যাশা

0
তৈমূর আলম খন্দকার
ব্রিটিশ-পূর্ব ভারতে আমলাতন্ত্র ছিল, কিন্তু তাদের জবাবদিহিতা ছিল নিয়োগকর্তার কাছে। কারণ তখন জনগণের কোনো স্বাধীনতা ছিল না, ছিল না কোনো মৌলিক অধিকার। নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো সুযোগ ছিল না। রাজার ছেলেই হতেন রাজা। বাহুবলে বা তলোয়ারের জোরে রাজ্য দখলই ছিল ক্ষমতা বদলের একমাত্র পদ্ধতি। হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে রক্তাক্ত পথে পররাজ্য দখল করলে উপাধি পাওয়া যেত ‘বীর যোদ্ধা’। কূটকৌশল ও রক্তের বিনিময়ে ভারত দখল করার পর ব্রিটিশরা প্রজাদের শাসন-শোষণ করার জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় একটি প্রশাসনিক বাহিনী গড়ে তোলে। এ বাহিনীর কাজ ছিল ব্রিটিশ প্রভুত্ব কোন কোন পদ্ধতিতে এ দেশে কায়েম রাখা যায়, সেটি নিশ্চিত করা। পাক-ভারত উপমহাদেশের সূর্য-সন্তানদের আন্দোলনের মুখে ও অনেক রক্তের বিনিময়ে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হলেও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। তারা শাসনকর্তার কাছে Your obedient servant হিসেবেই নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আমলাতন্ত্রের উচ্চ শিখরে ওঠার ‘মই’ হিসেবে নিজেকে ব্যবহার করত। জনগণ কী চায় এবং জনগণের চাহিদা পূরণের বিষয়টি আমলারা তাদের দায়িত্ব বলে তখনো মনে করত না। ব্রিটিশ শোষণমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও কাক্সিক্ষত আশা পূরণ না হওয়ায় জনগণের আন্দোলন স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নিলো এবং স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন; যার ফলে মুক্তিযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হলো।
বাংলাদেশের জনগণ রক্তের অক্ষরে একটি সংবিধান পেল যার মধ্যে জনগণের মৌলিক অধিকারকে নিশ্চিত করা ছাড়াও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সবসময় জনগণের সেবায় নিযুক্ত থাকার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ শুধু তাই নয়, সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্ব কার্যকর হইবে।’ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ শিরোনামে ২৬ থেকে ৪৭ক অনুচ্ছেদে জনগণের অধিকারকে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। সংবিধান হলো একটি রাষ্ট্রের সাথে সে রাষ্ট্রের জনগণের চুক্তিনামা যা একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দলিল। কিন্তু এই দলিল আজ পদদলিত করা হচ্ছে প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত কর্মচারীদের দ্বারা যারা জনগণের বেতনভুক কর্মচারী বটে। ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশরা যে প্রশাসনিক ক্যাডার গড়ে তুলেছিল তাদের প্রধান দায়িত্ব ছিল ভয়ভীতি সৃষ্টি করে, গ্রেফতার, রিমান্ড দিয়ে, লাঠি চার্জ করে অধিকার আদায়ে সংগ্রামরত জনগণকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া। কিন্তু বর্তমান প্রশাসন এর ব্যতিক্রম হয়ে উঠেনি। মুখে মুখে গণমুখী প্রশাসনের কথা বললেও কার্যত প্রশাসনকে গণমুখী করা হয়নি। কারণ প্রশাসন যদি গণমুখী হয় তবে কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন হবে না, বরং সংবিধানে প্রদত্ত জনগণের জন্য যে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে তার ভিত্তিতেই প্রজাতন্ত্র চলবে। সিনিয়রকে ডিঙিয়ে জুনিয়রকে প্রমোশন এবং লোভনীয় পদে পোস্টিং দেয়ার ‘মুলা’ নাকের ডগায় ঝুলিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ‘গাধা’ বানিয়ে অধিকারবঞ্চিত জনগণকে ভয়ভীতির মাধ্যমে শাসনকর্তাদের অনুগত থাকার যাবতীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়। প্রশাসনিক স্তর মূলত জেলা থেকে সৃষ্ট। জেলা প্রশাসক, নিজেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা কালেক্টর এবং কাগজে-কলমে অনেক বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও ক্ষমতাসীনদের সব অন্যায় আবদার By way of commission and omission জেলা প্রশাসনই করে থাকে, হয়রানি হয় জনগণের। প্রশাসনের কাছে ন্যায়বিচার না পেয়ে অধিকারবঞ্চিত জনগণকে দৌড়াতে হচ্ছে হাইকোর্টে। বাংলাদেশের কত পার্সেন্ট লোক প্রতিকারের জন্য হাইকোর্টে যেতে পারে?
সরকার জোর দিয়েই বলে যে, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সরকারি দলের কিছু হোমরা চোমরাকে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ক্যাসিনো ও মানিলন্ডারিং মামলায় গ্রেফতার করলেই কি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়? সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’ যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তবেই বলা যাবে যে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উক্ত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংবিধানের উক্ত অনুচ্ছেদকে পায়ের তলায় পিষ্ট করে ফেলেছে। সরকারি দল যখন কোনো মিছিল করে তখন পুলিশ পাহারা দেয়, অথচ বিরোধী দল তাদের দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় নামলেই পুলিশ পেটায়, কাঁদানো গ্যাস দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে, গ্রেফতার করে রিমান্ড-বাণিজ্য করে। এ ভাবেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের সমতা রক্ষা করছে (!) সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই অপরাধে বেশি জড়িয়ে পড়ছে। পুলিশের অনেক লোককে জেলে পাঠানো হয়েছে। দুদকের বেড়াজালে আটকা পড়ছে সরকারি আমলারা। নিচু পদস্থ কর্মচারীরাও কোটি কোটি টাকার মালিক। স্বাস্থ্য বিভাগের একজন ড্রাইভারের সম্পদ দেখলে মাথা চড়ক গাছের মতো ঘুরতে থাকে। আমলারা নিজেরাই এখন দলবাজি করে। এ দলবাজি থেকে জাতিকে রক্ষা করার একমাত্র উপায়, তাদের জন্য দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। পরিতাপের বিষয়, মন্ত্রীরা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের একটি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছেন। কারণ নিজস্ব বাহিনী না থাকলে মন্ত্রীদের ‘জিন্দাবাদ’ দেয়ার লোক পাওয়া যাবে না। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ পায় বিধায় সে সুযোগের অপব্যবহার করে মন্ত্রীর সাথে ‘সখ্য’কে বিক্রি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে, যে টাকা রাখার জন্য কোনো ব্যাংকে নিরাপদ মনে করেনি বিধায় খাটের নিচে, বিছানার নিচে বা বালিশের ভেতর টাকা পাওয়া যাচ্ছে।
প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জনগণকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করছে। আধুনিক পুলিশের জন্মদাতা রবাট পিল-এর মতে ‘জনগণই পুলিশ এবং পুলিশই জনগণ’। তিনি আরো বলেছেন, জনগণ যা অনুমোদন করে না তা পুলিশের কর্ম হতে পারে না। পুলিশ বাহিনীকে আধুনিকভাবে ঢেলে সাজানোর জন্য সরকারের বারবার প্রতিশ্রুতি কোনো কাজে আসেনি। কারণ রাষ্ট্র নিজেই ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পুলিশকে অনৈতিক কাজে ব্যবহার করে থাকে। বর্তমানে আমাদের দেশে একটি পেশাদার প্রশাসন ও পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গড়ে ওঠা আবশ্যক যারা সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করবেন। সিনিয়র ডিঙিয়ে প্রমোশন ও লোভনীয় পোস্টিংয়ের জন্য সরকারের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সেবাদাস হিসেবে গড়ে না তুলে একটি গণমুখী প্রশাসনে পরিণত হবে। জমি রেজিস্ট্রি করার ৮ দিনের মধ্যে মিউটেশন বা নামজারি করার জন্য সরকারের সিদ্ধান্ত একটি ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। অনুরূপভাবে সরকারের দায়িত্ব হবে, প্রশাসনকে এসি রুমের পরিবর্তে জনগণের দরজায় পৌঁছে দেয়া, যার ফলে একটি গণমুখী প্রশাসন আমাদের রাষ্ট্রে সৃষ্টি হতে পারে। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার ও বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’ সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ মোতাবেক জনগণ কি সুবিধা বা অধিকার ভোগ করতে পারছে? সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দলিল, যার অংশীদার দেশের সব জনগণ। কিন্তু দেশের রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ সুবিধা ও অধিকার একটি গোষ্ঠী ভোগ করছে, অন্যরা বঞ্চিত। এ বঞ্চনা থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে জাতীয় অসন্তুষ্টি। এ অসন্তুষ্টি দূর করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে, নতুবা জাতীয় বিভক্তি দূরীভূত হবে না।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]