জননেতা তরিকুল ইসলামের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরন সংখ্যাার একগুচ্ছ লেখা-১

0

আমার দেখা তরিকুল ইসলাম
ব্যারিস্টার মুহাম্মদ জমির উদ্দিন সরকার

তরিকুল ইসলামের সাথে আমার পরিচয় যখন তিনি বিএনপিতে আসেন তখন থেকেই। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন ব্এিনপি গঠন করেন তখনই ভাসানী ন্যাপ থেকে তাঁরা এসে জয়েন করেন। যেহেতু তাঁর ও আমার বয়সের বেশ খানিকটা পার্থক্য রয়েছে তাই তাঁর প্রথম জীবন সম্পর্কে আমি বেশি বলতে পারবো না। তবে এতটুকু জানি যে ১৯৪৬ সালে তিনি যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবদুল আজিজ একজন স্কুল ইন্সপেক্টর ছিলেন। সে যুগে স্কুল ইন্সপেক্টরের পদটি বেশ সম্মানজনক ছিলো। পিতার পরিচয় সূত্রে বলতে পারি তিনি একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সফল সন্তান ছিলেন। যশোরে মেট্টিকুলেশন পাশ করেন। এরপর ঢাকা ও রাজশাহীতে পড়ালেখা করেছেন। ঢাকায় তিনি বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আসলেও শেষাবধি রাজশাহীতেই ভর্তি হন। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেছেন। ছাত্রজীবনে তিনি যশোর এমএম কলেজের একজন তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন। তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস হিসাবে ছাত্র আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করেন। ছাত্রদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে তাঁর ভূমিকা ছিলো সর্বজনবিদিত। তিনি খুবই জনপ্রিয় একজন ছাত্রনেতা ছিলেন। মূলত সেখান থেকেই তরিকুল ইসলামের রাজনীতির সূচনা হয়। তিনি তৃণমূল থেকেই রাজনীতিতে উঠে এসেছেন।
১৯৭০ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে অপেক্ষাকৃত তরুণ তরিকুল ইসলাম ন্যাপে যোগদান করেন। আওয়ামী লীগ ভেঙে ন্যাপ প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৫৪ সালে কাগমারী সম্মেলনের পর বিরাট আকারে এই পার্টির কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ এখানে সম্মেলনে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উলে¬খযোগ্য সিন্ধু প্রদেশের চিফ মিনিস্টার জিএম সৈয়দ, সীমান্ত গান্ধী গফ্ফার খান, ব্যারিস্টার মাহমুদুল হক ওসমানী, জনাব কাসুরী, লুন্দখোর, বেলুচ নেতৃবৃন্দ ও মিঞা ইফতেখার উদ্দিন। স্থানীয়দের মধ্যে মোজাফ্ফর আহমেদ, মির্জা গোলাম হাফেজ ও সেরনিয়াবত উপস্থিত ছিলেন। ন্যাপের গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করার দায়িত্ব ছিলো ব্যারিস্টার সলিমুল হক মিল্কীর ওপর। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের পূর্বসূরি হিসাবে আওয়ামী নামটা রাখার বিশেষ অনুরোধ করেন। সে অনুযায়ী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের নামকরণ করা হয়। মওলানা ভাসানী ন্যাপের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং সিলেটের মাহমুদ আলী সেক্রেটারি হন । তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে দলের সভাপতি হন ব্যারিস্টার মাহমুদ আলী কাসুরী। পাকিস্তান ন্যাপের সেক্রেটারি জেনারেল হয়েছিলেন মাহমুদুল হক ওসমানী। রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক যে ধারাটা তখন শুরু হয় সেটা প্রতিষ্ঠা করতে বেশি দেরি হয়নি। ১৯৭০ সালে তরিকুল ইসলাম এই ন্যাপে যোগ দেন। যাদু মিয়ার সাথে তরিকুল ইসলামের ঘনিষ্ঠতা ছিলো অনেক। তিনি তাঁর প্রিয়ভাজন ছিলেন। মওলানা ভাসানীর সাথেও তরিকুল ইসলামের ঘনিষ্ঠতা এভাবেই তৈরি হয়। মওলানা ভাসানীর পর যাদু মিয়াই ন্যাপের হাল ধরেন এবং এই সময় তরিকুল ইসলামও ন্যাপের অন্যতম নেতা হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। এঁরা সবাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ওপর বিশ^াসী ছিলেন। তারা সবাই বলতেন নির্বাচন করেই ক্ষমতায় যেতে হবে। এর বাইরে কোন পন্থায় নয়। মশিউর রহমান যাদু মিয়া দেখলেন যে এই ভাবে পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে কোনদিন সাফল্য লাভ করা যাবে না। শুধু নেতা কর্মীদের দুঃখ কষ্টের বোঝা বেড়ে যাবে। তাই তিনি শিক্ষিত কিছু নেতৃস্থানীয় নেতাকর্মী নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে পার্টি ও রাজনীতিকে বাঁচাতে হলে নির্বাচন ছাড়া গতি নাই। মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর তিনি ন্যাপের হাল ধরেন এবং শিক্ষিত ও রাজনীতিতে ঝানু কিছু নেতা ও কর্মীকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে এখন থেকে প্রত্যেকটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। এই সময় যে সমস্ত যুবনেতৃবৃন্দ যাদু মিয়াকে সাহায্য করেন তাদের মধ্যে তরিকুল ইসলাম অন্যতম।
বৃটিশ আমলে যশোর ছিলো কলকাতা প্রেসিডেন্সি বিভাগের আওতাধীন। ওই এলাকায় দলকে সংগঠন গোছানোর গুরু দায়িত্ব অর্পিত হয় তরিকুল ইসলামের ওপর। যাদু মিয়াকে তরিকুল বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেন। জিয়াউর রহমান দল গঠনের উদ্যোগ নিলে মশিউর রহমান যাদু মিয়া সিদ্ধান্ত নেন তিনি ন্যাপকে স্তিমিত করে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে রাজনীতি করবেন। কারণ ক্ষমতায় না থাকলে রাজনীতিতে শীঘ্রই অগ্রসর হওয়া যায় না। তিনি পার্টির কনভেনশন করে তাঁর ধারণাকে বাস্তবায়ন করার জন্য ঢাকার এক হোটেলে মিটিং করে জিয়াউর রহমানের সাথে নীতি সর্বসম্মতিক্রমে পাশ করে নেন। এই সময় তরিকুল ইসলামকে যাদু মিয়া সামনে রেখে নতুন প্রজন্মের কর্মমুখ নেতার স্বীকৃতি দেন। তখন থেকে ন্যাপের মূল ধারার সঙ্গে তরিকুল ইসলামের নেতৃত্ব শুরু হয়। তিনি পার্টিতে প্রাধান্য পান। মশিউর রহমান পুরানো নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তরিকুল ইসলামকে মিলিয়ে দিয়ে বিএনপিতে যোগদান করে পার্লামেন্টারি রাজনীতির দৃষ্টিকোণ জোরদার করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তরিকুল ইসলামের অসামান্য অবদান রয়েছে। ১৯৭১ সালে তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান এবং পশ্চিমবঙ্গে অবস্থানরতদের সাথে যোগাযোগ করেন। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার পেছনে তাঁর ভূমিকা অনেক। ছাত্রজীবনে তিনি একটি বামপন্থী ধারার সাথে সংযুক্ত থাকলেও আজীবন তিনি ছিলেন মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে। শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কন্ঠ। গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা ও মূল্যবোধকে তিনি মানুষের মুক্তির উপায় মনে করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের হাল ধরেই বামধারাকে সাথে নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তিনি সক্রিয় হন। এভাবেই এক সময় তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার খালকাটা কর্মসূচির অনেক বড় ক্ষেত্র ছিলো বৃহত্তর যশোর অঞ্চল। তরিকুল ইসলাম এই কর্মসূচির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তাই জিয়াউর রহমানও তাকে যথেষ্ট ¯েœহ করতেন। ন্যাপ একটি সফল গ্রুপ হিসাবে কাজ করেন। এতে অনেক সুফল পাওয়া গিয়েছিলো। জনগণ বুঝেছিল ভারত ফারাক্কায় পানি বন্ধ করলে খালের মাধ্যমেই কেবল ফসলের ক্ষতি রক্ষা করা সম্ভব হবে। এই এক নতুন পদ্ধতি। ফলে বিএনপির সময় কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে গেল এবং আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করলো।
১৯৭৯ সালে তরিকুল ইসলাম যশোর থেকে নির্বাচিত হয়ে আসেন। তিনি ওই সময় বেশ জনপ্রিয়তা নিয়েই সংসদে আগমন করেন। হঠাৎ যাদু মিয়ার মৃত্যুতে তরিকুল ইসলাম রাজনীতিতে এগিয়ে আসেন। সকল নেতাকর্মীর নজরে পড়েন এবং ন্যাপের নেতৃস্থানীয় এমপি হিসাবে স্বীকৃতিলাভ করেন।
মশিউর রহমান যাদু মিয়া চেয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্সিয়াল গভর্নমেন্টের সাথে প্রধানমন্ত্রীর পদটাও থাকুক। সরকারের সিস্টেমে ১৯৩৫ সালের আইনের সঙ্গে এই ধারাটিই দীর্ঘকাল বাংলাদেশে টিকে ছিলো। তাই সরকাবের প্রধান প্রেসিডেন্ট হলেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে মানুষ সহজে দাবি দাওয়া পেশ করতে পারত। ফলে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর যৌথ প্রচেষ্টায় জনগণের উন্নতি ত্বরান্বিত হওয়ার সুযোগ ছিল। আমার মনে পড়ে প্রেসিডেন্ট জিয়া কাকে প্রধানমন্ত্রী করবেন এ নিয়ে সেসময় প্রশ্ন ওঠে। অনেকেই চাচ্ছিলেন প্রফেসর বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী হোক। কিন্তু তরিকুল ইসলাম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে যুক্তি দেখান যে শাহ আজিজুর রহমান পাকিস্তানের জন্মপূর্ব থেকে পাকিস্তান আন্দোলন করে সুপরিচিত ছিলেন এবং সবসময় মুসলমান জনসাধারনের উন্নতির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে সাধারণ মানুষের কাছে সুপরিচিত ছিলেন। শাহ আজিজুর রহমান একজন খাঁটি রাজনীতিবিদ। দলে বুরোক্রেটদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হলে এদল টেকসই হবে না। রাজনীতিবিদই পারেন রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে। তাছাড়া শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি বিশ্বাসভাজন হবেন বলেও তিনি যুক্তি দেখান। জিয়াউর রহমান আলোচনার মাধ্যমে তাঁর এই বক্তব্য গ্রহণ করেন এবং শাহ আজিজুর রহমানকে সমন্বয় করে নেন। এ সময় যশোরের আরেকজন নেতা আফসার আহমদ সিদ্দিকীও ন্যাপ থেকে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনিও বিএনপি সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অনেক ভূমিকা রাখেন। ন্যাপ থেকে যারা বিএনপির রাজনীতিতে এসেছিলেন তাদের সবারই তরিকুল ইসলামের প্রতি একটা গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিলো। শাহ আজিজুর রহমানের সাথেও তরিকুল ইসলামের একটি সুসম্পর্ক তৈরি হলো।
তরিকুল ইসলামের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তিনি আজীবন মানুষের জন্যই লড়াই সংগ্রাম করেছেন। ১৯৭৭-৭৮ সালে তিনি যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ও পরে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি নিজ এলাকার জনগণের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন। তাকে জিয়াউর রহমানের প্রথম মন্ত্রিসভার সদস্য করা হয়নি। কিন্তু এনিয়ে তিনি বিচলিত ছিলেন না। নিষ্ঠার সাথে তিনি তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে গেছেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাহাদতবরণের পর তাকে বিচারপতি আবদুস সাত্তার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। বিএনপির ধারাবাহিক শাসনামলে তরিকুল ইসলাম সব সময়ই সহযোগী ছিলেন। দলের আদর্শ নীতির প্রতি তাঁর আনুগত্যের ঘাটতি কখনো পরিলক্ষিত হয়নি। যখনই দেশে কোন সঙ্কট দেখা দিয়েছে তরিকুল ইসলামকে দেখেছি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা বলতে।
এরশাদ যখন ক্ষমতা নেয় তরিকুল ইসলাম সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা বলেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের এখানেই সবচেয়ে বড় সফলতা বলে আমার মনে হয়। এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছিলেন কয়েকজন জেনারেলকে সাথে নিয়ে। বিএনপি এরশাদের ক্ষমতাদখলকে ভালোচোখে দেখেনি। ফলে তরিকুল গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন হয়েছিলো। তরিকুল ইসলাম আজীবন দেশের জন্য চিন্তা করেছেন। তাঁর কারো প্রতি বিশেষ কোন পক্ষপাতিত্ব ছিলো না। যা সত্য বুঝতেন সেটাই বলতেন। তাঁর ওপর এরশাদের জমানায় শত নির্যাতন স্বত্বেও তিনি কিছুতেই এরশাদের কাছে নতি স্বীকার করেননি। এরপরের ঘটনা সবারই জানা। আপোষহীন নেত্রী ম্যাডাম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এরশাদের বিরুদ্ধে প্রায় ১০ বছর সংগ্রাম পরিচালনা করে ১৯৯১ সালে এরশাদকে হটিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করে। তরিকুল ইসলাম এই পুরো সময়টা আমাদের সাথে প্রথম সারিতে ছিলেন। রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার দিক থেকে তাঁর মধ্যে স্বচ্ছতা ছিলো। তাঁর রাজনীতিতে নীতি আদর্শ ও মূল্যবোধ ছিলো। অর্পিত দায়িত্ব পালনে কখনো শিথিলতা দেখাননি। গণতন্ত্রের জন্য আজীবন লড়াই করেছেন। শোষণ বঞ্চনা নিপীড়ন নির্যাতন আর সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বিএনপিতে গণতন্ত্রের অন্যতম প্রবক্তা এবং অকপটে সত্য কথা বলার জন্য তিনি খ্যাত ছিলেন। যে কাজ জনসাধারণের উপকারে আসবে আজীবন তিনি তাই করেছেন। দলের কাজের প্রতি তাঁর মনোযোগ ছিলো অন্যরকম। যখনই কথা বলতেন যুক্তি দিয়ে বলতেন।
আমি শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে তাঁর সাথে যশোর জেলায় অনেক সফর করেছি। তাঁর প্রতি আমার যেমন স্নেহ ছিলো, তেমনি তিনিও আমাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। একবার কোন এক কলেজের অনুষ্ঠানে গেলে ছাত্ররা কলেজটিকে সরকারিকরণের দাবি জানায়। তরিকুল ইসলাম ছাত্রদের সাথে কথা বলেন। আমাকে আর কষ্ট পেতে হয়নি। তিনিই সে সমস্যার সুন্দর সমাধান করে দেন। তিনি বলেছিলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণে সরকারের একটি নীতিমালা রয়েছে। এই দাবি শিক্ষকদের হতে পারে। ছাত্রদের কেন? এতে ছাত্রদের কোনো লাভ নেই। তাছাড়া সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা ও নীতিমালা আছে। যেসব শিক্ষক ছাত্রদের সামনে ঠেলে দিয়েছেন তারা নিজেদের চাকরি সরকারিকরণের জন্য তা করেছেন। তার সেসব বক্তব্য আজো আমার মনে পড়ে।
তৃণমূল থেকে রাজনীতি করার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময়ে একবার দলের বিরুদ্ধে ভূমিকার অভিযোগে তাঁকে স্থায়ী কমিটির মুখোমুখি করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়া তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্যে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। বিএনপিতে বহুদলের লোক ছিলো। কিন্তু এসবের মধ্যে তরিকুল ইসলাম ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্রের। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো ভিন্ন। যুক্তি দিয়েই সবকিছু বিবেচনা করতেন।
ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময়ে তরিকুল ইসলামকে নিয়ে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। কিন্তু তিনি ষ্পষ্ট করেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়াদের ভূমিকা ছিলো ব্যক্তিগত স্বার্থে। তিনি ওই উদ্যোগে মোটেও ছিলেন না। এ জন্য তাকে জীবনের শেষদিনগুলোতেও অসুস্থ শরীর নিয়ে কারাবরণ করতে হয়েছে। দলের ভেতরে বাইরে তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কথাবার্তায় আমরা মুগ্ধ হতাম। তিনি বিশ্বাস করতেন রাজনীতি শুধু নাম কিংবা সুনাম অর্জনের জন্য নয়। তাইতো তাকে আমরা দেখেছি সারাজীবন সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করে যেতে। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিলো সাধারণ মানুষের জন্য তিনি কথা বলেছেন। তাদের ভাবনাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাদের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি রাজনীতিতে জুনিয়রদের ধরে এনে জনগণের উন্নতির রাজনীতি শিখিয়েছেন। তরুণদের নেতৃত্বের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতেন। আর দলের পলিসির বাইরে কখনোই কিছু চিন্তা করতেন না। এটা একটা মহৎ গুণ তাঁর। রাজনীতি করতে গিয়ে শত অত্যাচার নির্যাতনে তাঁর শরীরটা ভেঙে পড়ে। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও তিনি দমে যাননি। দেশপ্রেম ছিলো তাঁর রাজনীতির মূলমন্ত্র। আজীবন জনদরদী এই মহান মানুষটি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু যেসব কাজ তিনি করেছেন তাতে দেশবাসী তাকে চিরদিন মনে রাখবে। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি খুবই জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য মানুষ ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরও আমরা এই চিত্র দেখতে পাই। ঢাকায় বিএনপির পার্টি অফিসের সামনে জাতীয় সংসদ ভবনে তাঁর নামাজে জানাজায় বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। আর যশোরের জানাজা ছিলো স্মরণকালের সর্ববৃহৎ। তরিকুল ইসলামকে বাদ দিয়ে যে বিএনপির রাজনীতির ইতিহাস লেখা সম্ভব নয় সেটি তাঁর মৃত্যুর পরও প্রমাণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে আমি তাঁর মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ পাক যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন। আমিন।
লেখক :
সাবেক স্পিকার, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য।

মনীষাই যাঁর অহঙ্কার
শওকত মাহমুদ

জাতীয়তাবাদী রাজনীতির এক কিংবদন্তী পুরুষ তরিকুল ইসলাম। ছোটখাটো গড়ন, মানুষটার মধ্যে প্রতিভা ছিল, প্রতিভার মধ্যেও মানুষ ছিল। রাজনৈতিক জ্ঞানে ও দেশপ্রেমে সর্বক্ষণ টনটনে। একজন সাংবাদিক হিসেবে এমন রাজনীতিবিদের সাহচর্য সব সময়ই প্রত্যাশিত। তাঁর কথা দিয়ে সময়তাড়িত উদ্বেগকে সব সময় অনুভব করা যেত।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক অভিযাত্রার শুরু থেকেই ছিলেন। শহীদ জিয়ার পছন্দের মানুষগুলোও ছিলেন খাঁটি। মৌলিক নীতিবোধের পরিচয়বাহী। তরিকুল ভাই মানবিকতাকে কেন্দ্র করেই তাঁর রাজনীতির সংসার সাজিয়েছিলেন। চলনে-বলনে যত না, তার চাইতে বচনে কর্মকাণ্ডে আধুনিক। আধুনিক সফলতার সনাতন মাপকাঠিতে উৎরোয় না, কিন্তু তাঁর মধ্যে মনীষার অস্তিত্ব তাঁকে ব্যতিক্রমী করে তুলেছিল। পুরো সংসারটাই রাজনৈতিক। শহীদ জিয়া, বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, বিএনপি-এদের সুখ-দু:খের যাবতীয় পর্বেই তরিকুল ভাই নিজেকে বিশ্বস্ত সঙ্গী রেখেছেন। দেশনেত্রী বেগম জিয়া তাঁকে যে কতোটা সম্মান করতেন, চোখে না দেখলে বুঝা যাবে না।
রাজনীতির জন্যে জেল খেটেছেন দু:সহ নির্যাতন সয়েছেন। কিন্তু দিক পরিবর্তন করেননি।
ইংরেজি ক্রাইসিস শব্দটি গ্রিক ভাষা থেকে আসা। এর মূল অর্থ রাস্তার বাঁক। এই বাঁক শুধুমাত্র সংকট ও উদ্বেগ ছড়ায় না, পথ বদলের শুভ সম্ভাবনাও বহন করে। তরিকুল ভাই শত প্রতিকূলতায়ও আলোর উত্থানের স্বপ্ন দেখতেন। ওই যে একটা কবিতা পড়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গের প্রথম যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার শিক্ষামন্ত্রী (১৯৬৯) জ্যোতি ভট্টাচার্যের-
“হতাশার ফেরিঅলা কত চারদিকে।
তাদের আওয়াজে তবু মেলাতে পারি না
এই ভাঙা কণ্ঠস্বর, এই ধূলো ঝড়ে
এখনো আগলে আছি ছোট বাতিটাকে।”

তরিকুল ইসলাম : রাজনীতির মহীরূহ
খন্দকার মনিরুল আলম

তিনি ছিলেন আমার বন্ধু, সহকর্মী, ভাই এবং সর্বোপরি একান্ত আপনজন। তরিকুল ইসলাম। এদেশের বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতির মহীরূহ। তাঁকে বাদ দিয়ে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কথা চিন্তাও করা যায় না।
ছাত্রজীবন থেকেই তরিকুল ইসলাম ছিলেন রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের সে সময়কার ছাত্র রাজনীতি বা দলীয় রাজনীতিতে তিনজন ছিলেন সহযোদ্ধা। তরিকুল ইসলাম, খালেদুর রহমান টিটো এবং আলী রেজা রাজু। তাদের সাথে আমার খুব একটা সখ্যতা ছিলনা। কারণ আমি ছিলাম খুলনা বি,এল কলেজের আর ওরা ছিল যশোর এম,এম কলেজের ছাত্র। আমরা সবাই বামধারার ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম। সেই সুবাদে তাদের নামে চিনতাম। আমরা এই ত্রিরতেœর নাম দিয়েছিলাম “থ্রি মাসকেটিয়ার্স”। এই তিনজনের মধ্যে তরিকুল ছিলেন “ ফাস্ট এমং দা ইকোয়ালস”। অনেক পরে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান এবং বিপরীত রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
৬০ এর দশকের সে সময়টা ছিল এদেশের রাজনীতিতে অগ্নিগর্ভ সময়। আমাদের মাথার ওপরে ছিলেন রাজনীতির মহাপুরুষ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তাঁর ছায়ায় সে সময় আমরা ছিলাম ছাত্র আন্দোলন তথা রাজনৈতিক আন্দোলনের এক পথের পথিক। সে সময়টাতে তরিকুল মাঝে মধ্যে খুলনায় আসতেন। আমরা যেতাম যশোরে। খুলনায় নূরুল ইসলাম দাদু ভাই ছিলেন আমাদের মধ্যমনি। আমরা সবাই একসাথে বসতাম, চলতো রাজনৈতিক আলোচনা। তরিকুল তখনই প্রভাবশালী নেতা হয়ে উঠেছিলেন।
আমরা ছিলাম কর্মী। তার বক্তব্য, যুক্তি এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আমাদের মুগ্ধ করতো। যশোরে গেলে তাঁর সাথে দেখা হতো। তাদের ঘোপের বাড়িতে সে সময় আমরা অনেক বৈঠকও করেছি।
আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে তরিকুল ছিলেন সম্মুখ সারির নেতা। জেল জুলুম সহ্য করেছেন তিনি। কিন্তু আপোষ করেননি । এরপর এলো ’৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ। এখানেও রনাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধা তরিকুল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দীর্ঘদিন তরিকুল ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ ছিল না। তিনি ছিলেন যশোরের রাজনীতিতে আকন্ঠ জড়িত। আমি সাংবাদিকতা পেশায়। তবে তার খোঁজ খবর পেতাম। এরশাদ আমলের কথা। যশোরের রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য তরিকুল ইসলামের। এরশাদের নজর পড়লো তারদিকে। ভাগিয়ে নিজের দলে টানতে হবে। কিন্তু আদর্শের প্রতি অনঢ় তরিকুল ইসলাম। গণতন্ত্র হত্যাকারী স্বৈরশাসক এরশাদের সাথে কোন আপোষ নয়। ফলে কারাগারে ঢুকতে হলো তাকে। রাজনীতির পাশাপাশি ঠিকাদারী ব্যবসা ছিল তাঁর। রাজনীতি করতে হলে পয়সা লাগে। এ জন্য ঠিকাদারী ব্যবসা। তরিকুল ইসলামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলো ট্রাক ছিল। ছিল ইটের বিশাল মজুদ। সব লুট করে নিয়ে গেল এরশাদের প্রশাসন। কারাগারে নির্মম অত্যাচার করা হলো দিনের পর দিন। প্লাস দিয়ে একটার পর একটা দাঁত তুলে ফেলা হলো। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে তরিকুল ইসলাম বিভিন্ন রোগে জর্জরিত হয়ে পড়েন। তাঁর হৃৎপিন্ড, কিডনি, চোখ কোনটাই ঠিকমতো চলতো না। ছিল প্রচন্ড মাত্রায় ডায়বেটিক। এ সবই এরশাদ আমলের অত্যাচারের ফসল। তবে অসুস্থতা তাকে কখনই দমাতে পারেনি। হাসপাতালে গেছেন, আবার ফিরে এসে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তাকে কখনও ক্লান্ত হতে দেখিনি।
সংসদীয় গণতন্ত্রে কনসটেটুয়েমি, সোজা কথায় নিজ এলাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যত বড় নেতাই হোন না কেন নিজের এলাকা যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে তাহলে দলীয় তথা রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে আপনি মূল্যহীন। তরিকুল ইসলাম এটা ভালো করেই জানতেন। বিএনপির রাজনীতিতে – যে দলে তিনি পরবর্তিতে যোগ দিয়েছিলেন, সে দলের কেবল যশোর নয়, মেহেরপুর – কুষ্টিয়া হতে খুলনা সাতক্ষীরা বাগেরহাট পর্যন্ত তাঁর ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। তিনি মানুষ চিনতেন। ফলে এ অঞ্চলের অনেককে মূল্যায়ন করে নিজ দলে এনে যোগ্যতার আসনে বসিয়েছেন। বানিয়েছেন সংসদ সদস্য। এদের কেউ কেউ যে পরে বেঈমানী করেননি তা নয়। তবে এটা বাঙালি চরিত্রের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তিনি ছিলেন পাকা রাজনীতিবিদ। নেতা বানিয়েছেন, কিন্তু মাথায় চড়তে দেননি। কেউ সে চেষ্টা করলে তাকে পস্তাতে হয়েছে।
আমি অনেক ভাগ্যবান একারণে যে, তরিকুল ভাই আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। মর্যাদা দিতেন এবং আমার ওপরে তিনি আস্থা রাখতেন। ১৯৯৭ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের নির্বাচনে আমি ছিলাম সভাপতি পদপ্রার্থী। তখন আওয়ামী লীগের শাসনকাল। প্রচন্ড চাপের মধ্যে ছিলাম। নিজ দলের কয়েকজন বেঈমানী করেছিল। আওয়ামী লীগ সরকার আমাকে পরাজিত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো। যাহোক, নির্বাচনে জিতেছিলাম। অনেক পরে শুনেছিলাম সে নির্বাচনে তরিকুল ইসলাম আমার পক্ষে অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন। তিনি তার অঞ্চলের অনেক ভোটারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমাকে ভোট দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এ কথা তিনি আমাকে কোনদিন বলেননি। অনেক পরে একদিন এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, এতে বলার কি আছে। আমার কাজ আমি করেছি।
২০০২ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। তরিকুল ইসলাম তখন তথ্যমন্ত্রী। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক প্রতিনিধিদের নেতা হিসাবে আমি চীন সফরে। বাসায় বারবার টেলিফোন করেন তিনি। কবে ফিরবো চীন হতে। ঢাকায় ফিরে টেলিফোন করলাম। বললেন কাল সকালে আসেন সচিবালয়ে। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো। বললেন, আজই জয়েন করতে হবে সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে। প্রধানমন্ত্রী এ পদে আপনাকেই চাইছেন। বললাম, আমি এখনও প্রেস ক্লাবের সভাপতি। প্রথমে এ পদ থেকে আমাকে পদত্যাগ করতে হবে। কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে। কিছু ফর্মালিটি আছে। বললেন সবকিছু একদিনের মধ্যে সম্পন্ন করুন। কান কথা বলার বা শোনার লোকের অভাব এদেশে নেই। আমি আপনাকে ছাড়া এ পদে অন্য কাউকে চিন্তাও করতে পারি না।
পিআইও পদে যোগ দিলাম। জীবনে প্রথম সরকারি চাকরি। সাংবাদিকতা করেছি। নিজের মালিক নিজেই থেকেছি। সরকারি চাকরিতে অনেক বাধ্যবাধকতা, আনুষঙ্গিকতা। তরিকুল ভাই বলতেন চিন্তার কোনো কারণ নেই। মনে করেন এটা আপনার একটা নিউজ ইভেন্টের অ্যাসাইনমেন্ট। আপনি তো আর ক্যারিয়ার আমলা নন।
যতদিন আমি এবং তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলাম তথ্য মন্ত্রণালয়ে একসাথে কাজ করেছি ততদিন সত্যিই বুঝিনি যে এটা একটা চাকরি। মাঝে মাঝে তিনি আমার অফিসে বসে অফিস করতেন। সাংবাদিকরা আসতো তাদের সাথে আড্ডা দিতেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম, ভাই আপনি পিআইওর অফিসে বসে অফিস করেন এটা ঠিক হচ্ছে না। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, এখানে থাকলে অনেকের সাথে খোলামেলা কথা বলা যায়। আমার অফিস তো নানা বাধ্যবাধকতায় আবদ্ধ। তদবিরকারকরা বিভিন্ন তদবির নিয়ে হাজির হয়। আমার এসব একেবারে সহ্য হয় না। আমাকে বলেছিলেন, আপনার এখানে বসলে পুরো মন্ত্রণালয় জানতে পারে যে মন্ত্রী পিআইওর কক্ষে আছেন। ফলে মন্ত্রণালয়ের সবাই বুঝতে পারবে যে এই লোকটাকে সমীহ করতে হবে। তিনি বলেছিলেন, উনারা বাইরের কাউকে সহ্য করতে পারেন না। আমরা বাইরের লোক। আজ আছি, কাল নেই। কিন্তু যতদিন আছি পুরো কর্তৃত্ব নিয়ে থাকতে হবে।
তরিকুল ইসলাম নীতির কাছে কখনও আপোষ করেননি। যার কারণে তাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। একটা ঘটনা বলি। স্পেন সরকার বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য একটা প্রকল্পে অনেক টাকা অনুদান দিয়েছিলো। তবে শর্ত ছিলো যন্ত্রপাতি কিনতে হবে স্পেন থেকে এবং পরবর্তীতে যত স্পেয়ার লাগবে তাও কিনতে হবে সে দেশ হতে। তরিকুল ইসলাম এটা মানতে পারেননি। সে সময় নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন নামে একজনকে সবাই চিনতেন। এ প্রকল্পটি অনুমোদন করার জন্য অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছিলো। পিছনে ছিলো প্রধানমন্ত্রী অফিসের হারিছ চৌধুরী। তাদের স্বার্থ ছিলো এ প্রকল্পটিতে । তরিকুল ইসলাম আমাকে বলেছিলেন, ভাই তারা দেশের স্বার্থের চাইতে নিজেদের স্বার্থ অনেক বড় করে দেখে। সাদা চোখে দেখা যাচ্ছে এ প্রকল্পে সরকারের লাভ হবে। কিন্তু সরকারের ক্ষতি হবে অনেকগুণ বেশি। এ প্রকল্পের অনুমোদন তিনি দেননি। এর ফলে সে সময়কার অত্যন্ত প্রভাবশালী হারিছ চৌধুরী তরিকুল ইসলামের প্রতি ক্ষুব্ধ হন। একদিন হারিছ চৌধুরীর সাথে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেখা হলে তিনি আমাকে বলেন, তরিকুল ভাই “বুড়ো হয়ে গেছেন। তার এখন অবসর নেয়া উচিৎ”। কিছুদিন পরে তরিকুল ইসলামের মন্ত্রণালয় পরিবর্তন হয়।
তরিকুল ইসলাম চাইতেন রাজনীতি থাকবে রাজনীতিবিদদের হাতে। ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করা তিনি অপছন্দ করতেন। তাকে এবং তার মতো আরও কয়েকজনকে দলের এবং মন্ত্রিসভার কিছু সদস্য এই বলে সমালোচনা করতেন যে, এই পাজামা-পাঞ্জাবি ওয়ালাদের জন্য কিছু করা যায় না। তরিকুল সুতি পাজামা- পাঞ্জাবি পরতেন। এতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য পেতেন। দলে ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে তরিকুল ইসলাম হতাশ ছিলেন। খুলনার নজরুল ইসলাম মঞ্জু ছিলেন আগাগোড়া রাজনৈতিক। তিনি তরিকুল ইসলামের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। মঞ্জু খুলনা বিএনপির প্রাণ ভোমরা ছিলেন, এখনও আছেন। তার জায়গায় আনা হলো আলী আসগর লবীকে। তরিকুল ইসলাম এতে দুঃখিত হলেন। আমাকে একদিন বললেন ভাই আর রাজনীতিতে থাকতে মন চায় না।
কিন্তু তরিকুল রাজনীতি ছাড়েননি। তার প্রতিটি রক্তের ফোটায় ছিল রাজনীতি। লবী, হারিছরা হারিয়ে গেছেন। কিন্তু তরিকুল মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন রাজনীতিক। নীতির প্রশ্নে কখনো আপোষ তিনি করেননি। মৃত্যুর আগে তার প্রাত্যহিক ঠিকানা ছিলো হাসপাতাল। মাঝে মাঝে হাসপাতালে তাকে দেখতে গেছি। যতক্ষণ হাসপাতালের বেডের পাশে থাকতাম, তিনি আমার হাত ধরে রাখতেন। ছাড়তে চাইতেন না। যশোরকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় বা অন্য কোন সুযোগ পেলেই তিনি চলে যেতেন যশোরে। রাস্তার পাশে সঙ্গীদের নিয়ে চা খেতেন। গল্প করতেন। যশোরের সকলের হাড়ির খবর তিনি রাখতেন। তিনি বলতেন ভাই আপনাদের এই ঢাকা আমার একদম পছন্দ হয় না। এখানে প্রাণ ভরে দম নেয়া যায় না। সব স্বার্থপর আর সুযোগ সন্ধানীদের এখানে আনাগোনা।
আজ তরিকুল ইসলাম নেই। তার না থাকার মধ্যে আমি হারিয়েছি আমার একান্ত আপনজন।
লেখক : জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা।

স্মৃতিতে অনন্য রাজনীতিক তরিকুল ইসলাম
সৈয়দ আবদাল আহমদ

রাজনীতিবিদ হলেন তারা, যারা সাধারণ জনগণের জন্য কাজ করতে চান এবং দেশ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ চান। এর ব্যতিক্রম হলে একজন মানুষকে রাজনীতিবিদ বলা যাবে না।  অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে রাজনীতিবিদের সংজ্ঞায় এমনটিই বলা হয়েছে। এজন্যেই রাজনীতিবিদের কর্মকান্ডের প্রতি সবাই সতর্ক দৃষ্টি রাখেন, তিনি জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেছেন কি না।
একজন রাজনীতিবিদের কথা ও কাজে সমন্বয় থাকতে হয়। ভালো ও নির্ভরযোগ্য একজন রাজনীতিবিদ জনগণের সেবা করে আনন্দ পান এবং নিজেকে জনগণের সত্যিকারের সেবক ভাবতে বেশি পছন্দ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন উইনস্টন চার্চিল। তাঁরমতে জনগণের জন্য নিঃস্বার্থ সেবা হলো মানবীয় গুণাবলীর মধ্যে প্রথম গুণ। একই সময়ের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন থিওডোর রুজভেল্ট। তাঁর মতে, সেই রাজনীতিবিদ সবচেয়ে কৃতকার্য হন, যিনি বুঝতে পারেন জনগণ কী ভাবছে এবং বলতে চাইছে। সত্যিকার রাজনীতিবিদ সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
আমার স্মৃতিতে এমন অনন্য একজন রাজনীতিবিদ হলেন তরিকুল ইসলাম। তিনি যেমন ছিলেন আদর্শ রাজনীতিবিদ, তেমনি অমায়িক, মধুর এবং মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। দলমত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। চার্চিলের ভাষায় বলা যায়, মানুষের কল্যাণ করে তিনি আনন্দ পেতেন। কারণ মানুষের সেবা ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তিনি ছিলেন একজন ত্যাগী, নিষ্ঠাবান আর সৎ নেতা, যা আজ দেশের জন্য বড় প্রয়োজন।
জননেতা তরিকুল ইসলামকে আমি দেখে এসেছি এবং আমার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা পঁচিশ বছরের বেশি সময়ের। আমি অনায়াসে বলতে পারি, তিনি একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল আকর্ষণীয়। মানুষকে তনি আপন করে নিতে পারতেন। একজন বিনয়ী ও অমায়িক ব্যবহার সম্পন্ন মানুষ হিসেবে তিনি জনগণের ভালোবাসা অর্জনে সমর্থ হয়েছিলেন। সমাজসেবা,পরোপকার আর উদারতা তাঁকে করেছিল মহিমান্বিত। জনগণকে তিনি অলিক স্বপ্ন দেখাতেন না। সমর্থন আদায় বা বাহবা নেয়ার জন্য আশ্রয় নিতেন না কোনো ছলচাতুরির। মিথ্যা, কুটকৌশল কিংবা ধোকাবাজির। ইংরেজ কবি জন কিটস-এর মতো তার উপলব্ধীও ছিল ‘ট্রুথ ইজ বিউটি’ অর্থাৎ সত্যই সুন্দর। তাই তিনি কোনো ওয়াদা করলে তা পরিপূরণে সচেষ্ট থাকতেন। জনগণের বিশ্বাসকে তিনি মূল্য দিতেন। ফলে তাঁর ওপর জনগণেরও আস্থা ছিল প্রচুর। এর প্রমাণ মৃত্যুর পর তাঁর ঢাকা ও যশোরের জানাজায় মানুষের ঢল। তাঁর প্রতি জনগনের ভালোবাসার বহি:প্রকাশই ছিল এই লোকসমাগম।
তরিকুল ইসলাম তাঁর ৭৮ বছরের জীবনের ষাট বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন রাজনীতির সঙ্গে। এদেশের রাজনীতির অন্দর-বাহির তাঁর চেনা। তিনি সব গলি-ঘুপছি চেনেন বলে অপরকেও পথ চেনাতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। তাঁর নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সহজ সরল এবং স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। যশোর জিলা স্কুল থেকে ১৯৬১ সালে প্রবেশিকা পাশ করে তিনি ভর্তি হন যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজে। রাজনীতির পাঠ তাঁর সেখানেই। কলেজের ভাঙাচোরা শহীদ মিনার দেখে তাঁর মন কেঁদে ওঠে। শহীদ মিনার মেরামতে লেগে যান। ফলে সামরিক সরকারের কোপানলে পড়ে গ্রেফতার হন। তরুণ বয়সে জেলে গেলেও ভেঙে পড়েননি। বরং জেল জুলুম তাঁকে আরো প্রতিবাদী করে তোলে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন এবং ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার হওয়ার কারণে ১৯৬৮ সালে গ্রেফতার হন এবং যশোর ও রাজশাহী কারগারে নয় মাসের বেশি সময় বন্দী থাকেন। কলেজ জীবন শেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিক্রী অর্জন করেন। এ সময় উনশত্তরের গণঅভূত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এজন্যে তাকে কারাগারেও যেতে হয়েছে। ছাত্রজীবন শেষ করে ১৯৭০ সালে তিনি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগদান করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ন্যাপের রাজনীতিতে জড়িত থাকাকালীন। ১৯৭৫ সালেও তিনি কারাবরণ করেন। ন্যাপ থেকে প্রথমে তিনি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং পরে ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিতে যোগদান করেন। বিএনপির ৭৬ সদস্যের প্রথম আহবায়ক কমিটিতে তিনি অন্যতম একজন সদস্য ছিলেন। পরে ১৯৮০ সালে দলের যশোর বিএনপির সভাপতি, কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, ভাইস চেয়ারম্যান ও ২০০৯ সালে তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হন। ১৯৭৯ সালে যশোর-৩ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তিনি সংসদীয় রাজনীতিতে পদার্পণ করেন এবং বেশ কয়কবার এমপি নির্বাচিত হন। তরিকুল ইসলাম প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপির সরকার এবং বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দু মেয়াদের সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং সড়ক ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
জেল জুলুম একজন রাজনীতিকের জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু রাজনীতিক তরিকুল ইসলামের ক্ষেত্রে নির্যাতনের মাত্রাটা বেশিই ছিল। স্বাধীনতার আগে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের রোষানলে পড়ে তাকে যেমন কয়েকদফা জেলে বন্দী থাকতে হয়েছে, তেমনি স্বাধীনতার পর তাঁকে সইতে হয়েছে মুজিব সরকারের রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন এবং জেল-জুলুম। ১৯৮২ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ বন্দুকের নলের মুখে বিএনপি সরকারকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি বিভিন্ন দল ভেঙে নেতাদের ভাগিয়ে এনে জাতীয় পার্টি গঠন করেন। কিন্তু এরশাদের দল ভাঙার খেলায় যোগ দেননি তরিকুল ইসলাম। তিনি অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে বিএনপির মূলধারায় শক্তভাবে অবস্থান নেন। ফলে জেনারেল এরশাদের রোষানলে পড়েন এই রাজনীতিক। ১৯৮২ সালেই তাকে গ্রেফতার করে অনেকদিন অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে তাঁর কয়েকটি দাঁত উঠিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু বিএনপির রাজনীতি থেকে তাঁকে বিচ্যুত করা যায়নি। নীতির প্রশ্নে, দলের প্রশ্নে এবং আদর্শের প্রশ্নে তিনি ছিলেন অটল, অনঢ়। এ কারণে বিএনপির রাজনীতিতেও তিনি দলের নেতাকর্মীদের কাছে অত্যন্ত আস্থা ও শ্রদ্ধাভাজন একজন নেতা। পরবর্তীতে ১/১১-এর জরুরি সরকার এবং শেখ হাসিনার সরকারের রোষানলে থেকেও তিন বাঁচতে পারেনি। গ্রেফতার হয়ে তাঁকে কারাভোগ করতে হয়েছে।
সাংবাদিক হিসেবেই তরিকুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয়। যশোরের এই বর্ণাঢ্য রাজনীতিকের নাম প্রথম জানতে পারি দৈনিক বাংলা অফিসে যোগদান করে। দৈনিক বাংলার তৎকালীন আমাদের চিফ রিপোর্টার ছিলেন শ্রদ্ধেয় মনজুর আহমদ। তার বাড়ি বৃহত্তর যশোরের ঝিনাইদহে। তার কাছে জেনেছি, তরিকুল ইসলামের রাজনৈতিক জীবনের নানা কথা। দৈনিক বাংলায় যশোর প্রতিনিধি ছিলেন আলোচিত সাংবাদিক শামছুর রহমান কেবল। তিনি ঢাকায় এলে তার কাছেও তরিকুল ইসলাম সম্পর্কে শুনেছি অনেক কথা।
এরশাদবিরোধী আন্দোলের সময় একদিন দৈনিক বাংলা অফিসে সম্পাদক আহমেদ হুমায়ুনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন তরিকুল ইসলাম। কারণ এক সময় তারা দুজন একই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেদিনই তরিকুল ইসলামকে সরাসরি দেখি এবং তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। শুধু মঞ্জু ভাই নয়,দৈনিক বাংলার অনেকের সঙ্গেই তাঁর ছিল জানাশোনা। সবাইকে দেখি তাঁকে একবাক্যে তরিকুল ভাই বলে ডাকতে। সেদিন থেকে আমার কাছেও তিনি তরিকুল ভাই। এরপর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিএনপি অফিসে এবং আন্দোলনের নানা কর্মসূচি চলাকালে ঢাকার রাজপথে তাঁর সঙ্গে বহুবার দেখা হয়,কথা হয় এবং আমার তাঁর সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ হয়।
১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উপ-প্রেস সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে প্রায়ই তরিকুল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হতো। বিশেষ করে মন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তাঁর আসতে হতো। আমাদের সেই অফিসে ঢুকে তিনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর রেড ব্লকে যেতেন না। হয় আমার কক্ষ কিংবা খালেদা জিয়ার তৎকালীন এপিএস সালাউদ্দিন ভাই কিংবা প্রেস সচিব মোজাম্মেল ভাইয়ের কক্ষে এক কাপ কফি খেতে খেতে আড্ডা দিতেন। আমাকে কেন জানি খুব স্নেহ করতেন। আদর করে ডাকতেন আবদেল।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির বৈঠক হতো। প্রেস কভারেজের জন্য এসব বৈঠকে আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়। সেখানে তরিকুল ভাইকে দেখেছি জনগণের কল্যাণ হয় এমন প্রকল্প পাশ করানোর ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিতে। কোনো কোনো সময় দেখেছি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সঙ্গে তিনি ঝগড়া করে হলেও তাঁকে বুঝিয়ে জনবান্ধব প্রকল্প অনুমোদনে রাজি করাতেন। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তরিকুল ভাইকে সম্মান করতেন এবং গুরুত্ব দিতেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সফরে গেলে তিনি তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে তরিকুল ভাইকে সঙ্গে নিতেন। তিনি এলাকার রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট, মসজিদ মাদ্রাসার জন্য বরাদ্দ এবং তাঁর এলাকার জনগনের কল্যাণে বিভিন্ন প্রকল্প দ্রুত অনুমোদন করাতে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে লেগে থাকতেন। বিশেষ করে এপিএস সালাউদ্দিন ভাইকে তাগাদা দিতে দেখেছি। হেলিকপ্টারে আমাদের প্রেস টিমের সঙ্গে যেতেন তিনি। কারণ গল্প করা আর সিগারেট খাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। এ সময় তাঁর কাছ থেকে শুনেছি রাজনীতির নেপথ্যের অনেক মজার কাহিনী। তিনি খুব রসিক মানুষ ছিলেন, হাসাতেনও। একবার মন্ত্রণালয়ে তাঁর কক্ষে বসা ছিলাম। এক লোক বারবার তাঁকে বলছিল,ভাই আমাকে চিনছেন, ভাই আমাকে চিনছেন? এক পর্যায়ে তিনি যশোরের ভাষায় বলে উঠলেন, ‘তুমি কিডা, শাবানা না ববিতা যে তোমাকে চিনতে হবে ?’ তবে তাঁকে দেখলাম লোকটি যে কাজ নিয়ে এসেছে তা তিনি ঠিকই করে দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জাতিসংঘে গঙ্গার পানি সমস্যা তোলার জন্য নিউইয়র্ক যান। এ সময় কীসব দাবি নিয়ে যেনো টিএন্ডটি কর্মচারীরা ধর্মঘট ডেকেছিল। তরিকুল ভাই তখন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। আমি তাঁকে জানালাম জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেয়ার ভিজুয়াল কভারেজের ছবি ও রিপোর্ট আসবে। কিন্তু ধর্মঘটের কারণে তালিবাবাদ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে কাজ না হলে ছবি ও রিপোর্ট পাওয়া যাবে না। তরিকুল ভাই সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে এসে অবস্থান নেন। সচিবকে পাঠালেন ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে। কর্মচারীদের বুঝিয়ে ওই কেন্দ্রের ধর্মঘট প্রত্যাহার করিয়ে ছবি ও রিপোর্ট আসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে মন্ত্রণালয়ের অফিসে ফিরে যান।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকাকালে তিনি আমাদের অফিসে এলে গরিব কর্মচারীরা সেলাই মেশিন ও অন্যান্য সাহায্যের জন্য দরখাস্ত নিয়ে এলে তিনি দরখাস্ত সই করে দিতেন। অনেক গরিব মানুষকে তাঁর মন্ত্রণালয় থেকে সেলাই মেশিনের ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছি।
একবার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া লালমনিরহাট,কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা সফরে গিয়েছিলেন। আমরা একটি সাংবাদিক দলকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে ইত্তেফাকের প্রখ্যাত সাংবাদিক নাজিম উদ্দিন মোস্তান ভাইও ছিলেন। সার্কিট হাউসে খাবারের সময় ডিসি সাংবাদিকদের ভিন্ন জায়গায় খাবারের কথা জানালে মোস্তান ভাই এর প্রতিবাদ করে সাংবাদিকদের খাবার বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেন। আমাদের সঙ্গে তরিকুল ভাই ছিলেন। বিষয়টি তরিকুল ভাইকে জানালে তিনি তখনই এমন ব্যবস্থা নেন যে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে খাবারে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকেই রাখা হয়নি। তরিকুল ভাই মোস্তান ভাইকে গলায় জড়িয়ে ধরে রাগ ভাঙিয়ে খাবার টেবিলে নিয়ে আসেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পাশে বসান।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকীর সাপ্লিমেন্টে লেখার জন্য অনুরোধ করলে তরিকুল ভাই আমার কক্ষে বসেই লিখেছিলেন, শিশুদের জিয়া কতটা ভালোবাসতেন সে বিষয়ে অসাধারণ একটি লেখা। আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকেও লেখাটি পড়ে শুনিয়েছিলেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচনের সময় সাংবাদিক হারুন জামিলকে দিয়ে খরচের জন্য কিছু টাকা পাঠিয়েছিলেন আমাকে। অথচ তাঁর কাছে আমি কখনো টাকা চাইনি। তিনি ফোন করে বললেন,এটা আমার দোয়া তোমার জন্য। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলে খুশি হয়েছিলেন এবং প্রথম লিখিত অভিনন্দন তাঁর কাছ থেকেই পাই। এই হলেন তরিকুল ভাই।
তরিকুল ইসলাম আপাদমস্তক একজন আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ ছিলেন। রাজনীতিই ছিল তাঁর পুরো জীবনকে ঘিরে। যশোরে তরিকুল ইসলাম, খালেদুর রহমান টিটো,আলী রেজা রাজু তিন বন্ধুর মুক্তিযুদ্ধে অবদান,একত্রে রাজনীতি করাসহ নানা বিষয় কিংবদন্তি হয়ে আছে। প্রথমে তাঁরা এক পতাকাতলে থাকলেও সময়ের ব্যবধানে পৃথক রাজনীতির পথ বেঁছে নেন। তরিকুল ইসলাম বিএনপিতে, আলী রেজা রাজু আওয়ামী লীগে এবং খালেদুর রহমান টিটো জাতীয় পার্টি হয়ে বিএনপিতে এসেও থিতু হতে পারেননি। তবে যতটুকু জানি, তাদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বে কখনো চিড় ধরেনি।
কেমন রাজনীতিক ছিলেন তরিকুল ইসলাম? তিনি শুধু বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছেই নয়, অন্য দলের নেতাকর্মীদের কাছেও ছিলেন শ্রদ্ধারপাত্র। মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে রাজনীতিবিদ পংকজ ভট্টাচার্যের মন্তব্য ছিল, তরিকুল ইসলাম আগাগোড়াই গণমানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত একজন নেতা ছিলেন। নির্বাচনী এলাকার মানুষের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা যেমন, জাতীয় রাজনীতিতেও গ্রহণযোগ্য একজন ছিলেন তিনি। সার্বিকভাবে জনবান্ধব, সজ্জন, মার্জিত চরিত্রের একজন রাজনীতিক ছিলেন তরিকুল ইসলাম।
সিপিবি নেতা হায়দার আকবর খান রণো বলেন, প্রগতিশীল রাজনীতির ভেতর দিয়েই রাজনীতিক তরিকুল ইসলামের জন্ম ও উন্মেষ। তিনি ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের অত্যন্ত দক্ষ একজন সংগঠক ছিলেন। পরে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপের রাজনীতি করেছেন। বিএনপির জন্মলগ্ন থেকেই এ দলটির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমৃত্যু ছিলেন। তিনি ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, গনতন্ত্রের পক্ষে ও প্রগতিশীল চিন্তার পক্ষের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
রণো আরও মন্তব্য করেন, একজন রাজনীতিকের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি। তিনি গণমানুষের নেতা। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তাঁর গভীর। আমি নিজে দেখেছি তাঁর যশোর অঞ্চলসহ সারাদেশে বহু নেতাকর্মী ও মানুষকে তিনি বাইনেমে চেনেন। খুব কম নেতা এ যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন। তিনি ছিলেন একজন ইতিবাচক রাজনীতিবিদ।
বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, তরিকুল ভাই আমাদের নেতা ছিলেন। দীর্ঘ ৫০ বছর আমরা একসঙ্গে ছিলাম। তাঁর প্রথম ছিল রাজনীতি, শেষও রাজনীতি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরিকুল ইসলাম এক ইতিহাসের নাম। মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে মানুষ তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। তরিকুল ভাই ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর ৭২ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান। তিনি আর কখনো ফিরে আসবেন না। তবে তিনি আমাদের মাঝে রেখে গেছেন একজন আদর্শ রাজনীতিক, একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ও একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবকের দৃষ্টান্ত। এ দৃষ্টান্ত অনুশীলনের মাধ্যমেই তার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব হবে। তাঁর আদর্শের মাধ্যমে তিনি সবার মাঝে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব।

আমার দেখা তরিকুল ভাই
এলাহী নেওয়াজ খান

আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে কত উত্থান-পতন দেখেছি। কত বিচিত্র ও বৈশিষ্টের মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে। কত বিখ্যাত লেখক, কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদের ঘনিষ্ঠ সঙ্গ লাভ করেছি তার হিসাব নেই। চার দশকেরও অধিককাল ধরে এই পথচলা। কত মধুর স্মৃতি আছে, আছে তিক্ততায় ভরা কত ঘটনা। অনেকের সঙ্গে পরিচয় ছিল মর্যাদাপূর্ণ ও আনন্দের। তাঁদের সঙ্গে অনেক সুখের স্মৃতি জড়িত আছে। আবার অনেকের সঙ্গে পরিচয় ছিল দুঃখ ও বেদনার। ভাবতে অবাক লাগে, এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কত আপনজন মনের আড়াল হয়ে গেছে, কত অজানা লোক আপন হয়ে হৃদয় দখল করে নিয়েছে। বিপদে -আপদে দেখেছি কত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন দূরে সটকে পড়েছে, পিছে দু পয়সা খরচ করতে হয় একথা ভেবে। অথচ অনেক দূরের মানুষ, যাদের নিয়ে কখনো ভাবিনি, তারা এগিয়ে এসেছে দু হাত প্রসারিত করে। এই তো মানুষের জীবন প্রবাহ। সুখে, দুঃখে চলতে থাকা। এরকম চলতে চলতে দেখা হয়ে গেল তরিক ভাইয়ের সঙ্গে। পুরো নাম তরিকুল ইসলাম। তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন। ষাটের দশকে যশোহরের ছাত্র রাজনীতির প্রাণপুরুষ হয়ে উঠেছিলেন তরিকুল ভাই। বিয়ে করেছিলেন ষাটের দশকের আরেক বিপ্লবী নেত্রী নার্গিস আপাকে। ফলে এক পরিপূর্ণ রাজনৈতিক দম্পতি হিসাবে তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। দেখা না হলেও ষাটের দশকেই তাঁদের নামের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম।
তারপর কালক্রমে ৭০এর দশকের শেষের দিকে পরিচয় ঘটে তরিক ভাইয়ের সঙ্গে। কখন কিভাবে সে পরিচয় হয়েছিল তা এখন আর মনে নাই। সম্ভবত এটা ছিল ১৯৭৯ সাল। সবে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত ‘দৈনিক দেশে’ যোগদান করেছি শিক্ষানবিশ হিসাবে। সে একটা সময় ছিল। আমরা যারা বাম প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম তাঁরা যেন ঝাঁপিয়ে পড়লাম প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বে নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ায়। কি উন্মাদনা তখন। বর্তমানের এই বন্ধ্যা সময়ে তা বলে বুঝানো যাবে না।
জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত হয়ে তরিকুল ভাই ক্রমান্বয়ে জাতীয় রাজনীতিতে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। তাঁর এই উত্থানের পর্বগুলো কখনো সহজ-সরল ছিল না। কখনো কারাবন্দী হয়েছেন, কখনো মুক্ত থেকেছেন। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের সময় বন্দি হয়ে যে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তা ছিল অবর্ননীয়। সেই অমানবিক নির্যাতনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল – তার অমোঘ পরিনতিতে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে। যা আর কখনো স্বতস্ফূর্ত জীবন প্রবাহ সৃষ্টি করেনি। মাঝে-মধ্যেই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হতো।
আমি যখন ‘ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি ছিলাম ; তখনই তরিকুল ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আরও আন্তরিক ও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। সে সময়কালটা ছিল ২০০২ থেকে ২০০৬। তখন তরিকুল ভাই তথ্যমন্ত্রী ছিলেন। কি কারণে যেন তিনি আমাকে পছন্দ করতেন এবং মনের অনেক কথা শেয়ার করতেন। একবার আমরা ওয়েজবোর্ডের দাবিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলাম। বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছি। মিটিং মিছিল করছি। একদিন তরিকুল ভাই আমাকে ডেকে বললেন, বুঝেন না, ‘সরকার সহজে কিছু দেয় না তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন, বাকিটা আমি দেখছি।’ এটা শোনার পর প্রেস ক্লাবের সামনে সড়ক অবরোধ করাসহ আমরা সত্যি তুমুল আন্দোলন গড়ে তুললাম। এভাবে চলছে। এক রাতে আমি তরিক ভাইয়ের মিন্টু রোডে অবস্থিত সরকারি বাসায় গেলাম। তিনি আমাকে দেখে খুব উল্লসিত হলেন। আমি চেয়ার টেনে বসার পর চায়ের অর্ডার দিয়ে বললেন, ‘বলেছিলাম না। আন্দোলন করেন কাজ হয়ে যাবে। কাজ হয়ে গেছে। ম্যাডাম (প্রধানমন্ত্রী) রাজি হয়ে গেছেন।’ এ ব্যাপারে তরিকুল ভাই খুব আন্তরিক ছিলেন। কখনোই রাজনীতিবিদের স্বভাবসুলভ চাতুর্যতা প্রদর্শন করেননি। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সাংবাদিকদের সপ্তম ওয়েজবোর্ড গঠনের গেজেট প্রকাশিত হয়। আজ এ কথা বলতে দ্বিধা নাই যে, তরিকুল ভাইয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণেই খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা ওয়েজ বোর্ড পেয়ে গিয়েছিলাম।
এরকম আরও অনেক ঘটনা আছে যা ছিল সাংবাদিকদের প্রতি তাঁর অপরিসীম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। ঠিক ঈদুল ফিতরের প্রাক্কালের একটি ঘটনা। তখন ‘বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায়’ কোনো এমডি ছিল না। সাময়িক ভাবে একজন যুগ্মসচিব দায়িত্ব পালন করছিলেন। একদিন বাসস-এর কয়েকজন সাংবাদিক এসে আমাকে জানালেন যে, যুগ্মসচিব সাহেব বলেছেন, একটা আইনগত সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই ঈদের আগে বেতন-বোনাস দেওয়া যাবে না। শুনে তো আমার মাথায় হাত। খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। পরদিন খুব সকাল সকালই সচিবালয়ে তরিকুল ভাইয়ের অফিসে গিয়ে উপস্থিত হলাম। আমি বেশ উত্তেজিত ছিলাম। আমি তরিক ভাইকে সব ঘটনা অবহিত করে বললাম, আপনি যুগ্ম সচিবক ডাকেন এবং বলেন, যে আইনে বেতন, বোনাস দেওয়া যায় না ; ঠিক তার উল্টো এমন আইন দেখেন যার মাধ্যমে দেওয়া যায়। তরিক ভাই আমার যুক্তিটা বুঝলেন এবং যুগ্ম সচিবকে ডেকে এনে আমি যা বলেছিলাম তাই বললেন। যুগ্মসচিব কিছু একটা বলতে গেলে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি যা বলছি তাই করেন। যুগ্ম সচিব সাহেব তার কক্ষে ফিরে গেলেন এবং কিছু সময় পর মন্ত্রীর রুমে এসে বললেন, স্যার আরেকটি আইন আছে যার মাধ্যমে বেতন ও বোনাস দেওয়া যায়। আমি যেন বড় একটা বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে গেলাম। কারণ ঈদের আগে বাসস-এর সাংবাদিক, কর্মচারীরা বেতন-বোনাস পাবে না তা ছিল ডিইউজের সভাপতি হিসাবে আমার জন্য খুবই মর্মবেদনার। কিন্তু তরিকুল ভাই তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে ঈদের আগে সাংবাদিকদের বড় ধরনের কষ্টের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।
তরিকুল ভাই যতদিন তথ্যমন্ত্রী ছিলেন ; ততদিন সাংবাদিকদের কল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন। আমাদের বহু অনুষ্ঠানে তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন স্বতস্ফূর্তভাবে। কখনো কোনো প্রশ্ন তোলেননি। তাঁর মত নেতার এখন বড্ড অভাব। আমি তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি।