জননেতা তরিকুল ইসলামের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরন সংখ্যাার একগুচ্ছ লেখা-৪

0

যুগস্রষ্টা তরিকুল
এমএ আজিজ

মানুষের আদিম সমাজ ব্যবস্থা হতেই শোষনভিত্তিক জীবন গড়ে ওঠে। ‘জোর যার মুল্লুক তার,’ প্রচলিত ছিল অহরহ সব সময়। বন জঙ্গলে গোত্র ও এলাকাভিত্তিক বসবাস শুরু হয়। গোত্রে গোত্রে কলহের কারণে হেরে যাওয়া মানুষগুলো দাসে রূপান্তরিত হতে থাকে। দাস সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। পরবর্তীতে সামন্তবাদ পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের আবির্ভাব ঘটে। এর পরেও মানুষের দুঃখ কষ্টের অবসান হয়নি কখনও।
তরিকুল ইসলাম ছিলেন ছোটবেলা থেকেই সরলমনা। মানুষের অভাব ও দুঃখ কষ্টে কাঁদতো তার মন। যে কোন বিপদে-আপদে ছুটে যাওয়া ছিল তার স্বভাবজাত প্রবনতা।
ছাত্র জীবনের শেষ বেলায় তরিকুল ইসলাম ছিলেন অর্থনীতির ছাত্র। সেই সুবাদে রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও ইতিহাস তথা ইউরোপের ইতিহাস ব্যাপকভাবে তার পড়ার সুযোগ ঘটে। জার রাজাদের শোষণের কাহিনী, লেনিনের ভাই আলেকজান্ডারের প্রকাশ্যে আগুনে ফাঁসিতে ঝুলানো তার মনে রেখাপাত করে। রোমান ক্যাথলিক চার্চের অত্যাচারে বিউগেলে বাজে করুণ সুর। স্পেনে মুসলমানদের নির্যাতন শেষে কর্দোভা মসজিদের দখলের সময় উপস্থিত ছিলেন কলম্বাস। রাজী ইসাবেলার অর্থানুকূল্যে বৃটেনে নেভিগেশন স্কুলের ছাত্র হন তিনি। পরবর্তীতে সমুদ্র যাত্রা করে আমেরিকা আবিস্কার করেন। এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশবাদ ও তার অন্তর্নিহিত শোষণের কথা।
ছাত্রজীবন শেষ করে যৌবনের পদার্পণ করেই সারা দুনিয়ায় মানুষ শোষণের কলকাঠি বুঝতে শেখেন তরিকুল। বৃটেনে রেনেসাঁর যুগে মার্টিন লুথার কিং-এর আবির্ভাব ও মানুষের মুক্তির জন্য তার কর্মকান্ড তরিকুল ইসলামের মনে দারুণভাবে দাগ কাটে। ছোটবেলায় সেই তরিকুল ইসলাম ধীরে ধীরে এই ভাবধারার সাথে মিশতে থাকেন।
১৯৫৫ সাল। আমরা যশোর জিলা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। সাদা সফেদ পোশাকধারী টলটলে চোখ। সুদূর প্রসারিত দৃষ্টি। একটি ছেলের নাম তার তরিকুল ইসলাম- কোন এক অজানা আহ্বান মনে প্রাণে। দুঃখে ভরা মানুষের করুণ আকুতি। হৃদয়ের পরতে পরতে তার ছাপ। পাখির পাখনায় উড়ে যেতে চায় মন এক সাথে তাদের সারিতে।
ছোট ক্লাশে মনিটর হলো তরিকুল। এই তার নেতৃত্বের সর্বপ্রথম ধাপ। শ্রেণি মনিটর হলো তরিকুল। এই তার নেতৃত্বের সর্বপ্রথম ধাপ। শ্রেণি পাঠ্যক্রমের মাঝে শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি সব বন্ধু বান্ধবের লেখাপড়ার উন্নয়নের খেয়াল ছিল তার। ছোটবেলা থেকেই ধাপে ধাপে এগিয়ে যান তিনি।
পিতা ছিলেন আলহাজ্ব মো. আব্দুল আজিজ। ধর্মভীরু পিতার যোগ্য সন্তান তরিকুল ইসলাম। ছোটবেলা থেকে আমার নিজের নামাজ পড়ার অভ্যাস ছিল। একদিন জেলা স্কুলের পূর্ব পাশের সিঁড়িতে আমরা একটি গ্রুপ ফটো তুলতে বসি। পাশে বসা তরিকুল। আমার বই-এর মাথায় নকশী করা টুপিতে আটকানো। দেখতে ভালোই লাগছিল। তরিকুল দেখে হেসে বলল, কেমন মোল্লা সাহেব। দেখো, মোল্লা হও, কিন্তু কবি মোল্লা হয়ো না।
স্কুলে নিয়ম ছিলো প্রতিদিন ছাত্রদের এসেমবিলিতে যোগদান। সামনে উঁচু টেবিলে উঠলো তরিকুল। সুরা ফিলের অনুবাদ, ব্যাখ্যা ও সানে নজুল দিতে হবে। ইয়েমনের শাসন কর্তা আবরাহার হস্তিবাহিনীর মক্কা আক্রমণের আবাবিল পাখির অজস্র প্রস্তর নিক্ষেপের ঘটনা তরিকুল ইসলামের মনকে আপোষহীন প্রতিবাদি হিসেবে গড়ে তোলে।
১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সময়ে তরিকুল ইসলাম অংকে ও ইংরাজীতে বুৎপত্তি লাভ করতে থাকেন। জাফর স্যার, সোবহান স্যার ও নবী স্যারের সাহচার্যে তার মুক্তিমত্তা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এরই মধ্যে তার মাঝে একটি গোপন অভাস দানা বাঁধতে থাকে। সিগারেট ধরলেন তরিকুল। নবী স্যার খুব করে বুঝিয়েছেন। কোন কাজ হয়নি। পরবর্তীতে ব্রঙ্কাইটিস ইত্যাদি রোগে ভুগতে হয়েছে তরিকুল ইসলামের।
স্কুল জীবনে মানুষের কল্যাণে কাজ করা আমাদের ছাত্র বন্ধুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কেউ যে কোন অসুবিধায় পড়লে তরিকুল ইসলামের নেতৃত্বে আমরা ছুটেছিলাম তাদের পাশে। এই লক্ষ্যে আমাদের নিজস্ব সহপাঠীদের নিয়ে ‘ফরটি মেম্বার্স’ নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। তার সেক্রেটারি ছিলেন তরিকুল। সর্বধরণের অসুবিধা আমরা এক সাথে ফেস করতাম। অর্থ সরবরাহে থাকতেন তরিকুল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মত সবার ব্যাংকের ব্যাংকার হিসাবে কাজ করে গেছেন তিনি।
সব ধরনের ক্ষুদে জ্ঞানীগুনি সমন্বয়ে তৈরি হয় ‘ফরটি মেম্মার্স।’ খালেক অংকে পাকা, তরিকুল ইংরেজীতে শাহ মোরশেদ গানে, আমি ছবি আঁকার। শান্তি ছিল সব দিক দিয়ে অগা। পিছিয়ে পড়া বন্ধুদের তুলে উঠাতে সার্বক্ষণিক চিন্তা ছিল তরিকুলের। স্কুল সময়ের বাইরে আমরা একটি নির্দিষ্ট সময়ে রেলস্টেশনে এক বন্ধুর বাড়িতে মিলিত হতাম। কেউ অংক শেখাতো, কেউ ইংরেজী, কেউবা গান। আর শত্রুদের থেকে নিরাপত্তার ধরণ শেখাতে নিয়মিত ক্লাশ নিতেন তরিকুল। এইভাবে ধীরে ধীরে ফরটি মেম্বার্স একটি দুর্ভেদ্য সংগঠনের রূপ নেয়।
স্কুল ছেড়ে কলেজ অঙ্গনের আমার পর আমাদের এই জোট মহাজোটে পরিণত হয়। মধুর ক্যান্টিনের মত ‘ক্যাফে দ্য লা পেয়াজা’ নামে একটি ক্যান্টিন সৃষ্টি হয়। স্থানটি ছিল আমাদের মূল ভবনের সুতিকাগার। তরিকুল ইসলামের প্রথম জন্ম হয় ছাত্র সংসদের জিএস হিসাবে। তাই কলেজের দেয়াল পত্রিকায় লিখেছিলাম-
কাফে দ্যা লা পেয়াজার নামটি নহে ভুল,
সুবাস ভরা রক্ত গোলাপ প্রভাত মুকুল।
মিলিয়ে দিতে আপনাকে নামটি তোমার তরিকুল,
এদেশেরই গুলবাগিচায় তুমি সেরা একটি ফুল।
এরপর থেকে তরিকুল ইসলামের চেতনার গতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। নিজেকে পরিপূর্ণভাবে আত্মত্যাগে সমর্পণ করতে শুরু করেন।
১৯৬৩ সাল। অর্থনীতিতে অনার্সে ভর্তি হন তরিকুল ইসলাম। শোষণের মূল সূত্রগুলি পরিস্কার হতে থাকে। বিশেষ করে মার্কস এর ‘থিওরি অফ সারপ্লাস ভ্যালু’ তাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তাই প্রথমে ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করেও পরবর্তীতে পার্টি বদল করতে হয় তাকে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তদানীন্তন বিভাগীয় প্রধান ড. মোশারেফ হোসেন ছিলেন আমাদের কাফেলার প্রথম সাথী।
পারিবারিক জীবনে তরিকুল ইসলাম ছিলেন। সহজ, সরল মাটির মানুষ। পাঞ্জাবী-পাজামা ছিল তাঁর নিত্য পরিধেয় বস্ত্র। নিজের ঐশ্বর্য থাকা সত্ত্বেও এর প্রভাব পরিবারে ফেলতে চাননি কখনও।
একদিন দেখলাম তরিকুলের দ্ইু শিশু সন্তান সুমিত ও অমিত গলাগলি ধরে হেঁটে যাচ্ছে স্কুলে। সাদামাঠা পোশাকে আবৃত শিশু ক্লাশে পড়ার জন্য। আমি বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম- রাস্তায় বিপদ-আপদ এড়াতে একটি রিকশা ডাকলেন হতো না ? উত্তর এল- কোনভাবে ঐশ্বর্যে ধরা খেলে তারা মানুষের বদলে অমানুষ হবে।
পৈত্রিক সূত্রে তরিকুল ইসলাম ছিলেন একজন ধার্মিক ব্যক্তিত্ব। এমপি ইলেকশনের সময় এক আধ্যাত্মিক শিক্ষকের সাথে তার পরিচয় হয়। এক বিশেষ মুহূর্তে তিনি তার দোয়া কামনা করেন। সাথে ছিলেন সে সময়ের যশোরের জেলা প্রশাসক মহিউদ্দিন খান আলমগীর। নিঝুম নিরবে অন্ধকার গভীর রাতে দোয়া রোমন্থনে স্নাত তরিকুল ইসলাম সিক্ত হন। সে বছরই তরিকুল ইসলাম জিতে যান প্রথমবারে এমপি নির্বাচনে। আমার ছোট মেয়ে ছুটে আসে উল্লাসে গেয়ে উঠে গান।
ইলিশ মাছের ত্রিশ কাটা, বোয়াল মাছের দাড়ি,
কদম আলি ভিক্ষে করে তরিকুল চাচার বাড়ি।
পরদিন সকাল বেলা। বন্ধু তরিকুলের সাথে বের হলাম। তার রংধনু ব্রিক ফিল্ডের দিকে। যেতে যেতে বলতেন লাগল,
জান, সেদিন হুজুরের সাথে হাত মেলাইনি কেন ? আবার বলতে লাগল, ‘আমার ইট ভাটায় যে সব শ্রমিক কাজ করে তাদের শ্রমলব্ধ মজুরীর কিছু অংশ গোপনভাবে আমার পকেটে আসে। এটা অন্যায়। পুঁজিবাদি, অর্থনীতিতে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় নেই। এই অন্যায় থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না বলে আমি হুজুরের হাতে হাত দেইনি।
তরিকুল ইসলাম ছিলেন সুস্থ মানবতার অগ্রদূত। সারাজীবন শরীরিক অসুস্থতা তাহার ভাবনার অগ্রযাত্রা গুরুতরভাবে ব্যাহত করে। বারডেমে চিকিৎসাধীন, তাকে একদিন দেখতে যাই। নার্গিস ইসলামকে জিজ্ঞেস করি, তাকে দেখতে হাতে কি নিয়ে যাব ? উত্তর এলো বিড়ি, বিড়ি! এক প্যাকেট বিড়ি। চমকে উঠি এই কথায়। পিছনে অনেক দূরে চোখ ফেলে দেখি তরিকুলের মুখে সেই পুরানো বিড়ির টান।
ম্লানমুখে ঢুকলাম বারডেম কেবিনে। বিষন্ন চিত্তে বসে আছে তরিকুল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার গলার হুলিয়া ঝুলে আছে। খোলামেলা বসে আছ। লাঠির এক বাড়িও সইবে না তোমরা।
উত্তরে সে বলল, মৃত্যুর ভয় করে লাভ নেই। ডাক আমাকেই যেতে হবে।
তরিকুল ইসলাম চলে গেলেন। কাজ শেষ হলো না বলে গেলেন লাঞ্ছিত নিপীড়িতদের চেতনার কথা। আপোষহীন সংগ্রামের কথা, মানুষের কল্যাণের জন্য শেষ কথা-
দাও দাও একমুঠো গ্রাস অতৃপ্ত ক্ষুধা মেটেনি, তবু বুবুক্ষু নিয়ে বক্ষে, যেন মৃগতৃষ্ণিকাাবিহরণে সংকল্পে লুপ্ত মরিচিকা হয়, এক ফোঁটা পানি জোটেনি!
মাস্টারের শেষার্ধে পড়েছিলাম অধ্যাপক পিগুর কল্যাণকামী অর্থনীতির কথা। পুঁজিবাদী অর্থনীতি ডিঙ্গিয়ে কল্যাণকামী মানুষের স্বর্ণযুগ দর্শনের কথা।
তরিকুল ইসলামের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার কথায় তাই লিখতে ইচ্ছা হয়-
এস এস বন্ধু আমার হাজার বছর ধরে
শুভযাত্রায় চল হোক মম তোমাকেও আপন করে।
লেখক: শিক্ষাবিদ, বন্ধু, সহপাঠী

অনুভবে অনুক্ষণ
রাজিয়া ইমাম

মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে যতক্ষণ। সে এক আচ্ছেদ্য বন্ধন ঃ জি এস তরিকুল ইসলাম, অভয়ের প্রতিক্ষপদ। শুধু প্রতিশব্দও নয় তরিকুল ভাই ছিলেন এক নির্ভর সান্ত¡না, উৎসাহ আর আশ্রয় দিয়ে মহাবিদ্যালয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপনের বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁর পরিচালনার শৈলী ছিল যেন শিল্পকলা সমৃদ্ধ অৎঃরংঃরপ খবধফৎবংযরঃ. এক পাড়ায় জন্ম আমাদের, এক বয়সী, একই ক্লাসে পড়া।
সবার বাড়ি তখন সবার নিরাপদ ঠিকানা মনে হতো, সবার বাবা মা সবার অভিভাবক। বন্ধু, স্বজন, সতীর্থ সবই ছিলেন তিনি আমাদের। আশ্বাস, বিশ্বাস, ভরসা ঃ জি এস তরিকুল ভাই।
হঠাৎ আব্বা মারা যাবার খবরে গিয়ে যখন আকুলি বিকুলি করছিলাম, তরিকুল ভাই ছুটে গিয়েছিলেন, কন্ঠভরে এমন করে সাহস দিয়েছিলেন, যা আজো মর্মমূলে মুদ্রিত। আমার বড় আপা ২০১২ সালে চিরবিদায় নিলেন, সেখানে জানাজার অগ্রভাগে তরিকুল ভাই, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। আলী রেজা রাজু, সেও আমার ভাই। তার কফিনে বুকফাটা আর্তনাদে তরিকুল ভাই। সেই ভাই আমাদের আপন স্বজন না ত আর কে ?
কত স্মৃতি কলেজ-এর চত্বরে। পরিহাসপ্রীতি ছিল তার স্বভাবসূলভ। কত মুক্তধারা হাসি সম্মিলিত স্বরে আকাশে-বাতাসে ভেসে যেত। কত সময় ডানায় ভীড় বিকেল গড়াতো।
এই সাথে সতীর্থ রফিকুজ্জামান ভাই, মনিরুজ্জামান, আকরাম ভাই, মিহির দা (একটু সিনিয়র) খায়রুল আলম রেখা, খায়রুলের সাথে নার্গিস (পরে যিনি তরিকুল ভাই-এর জীবনসঙ্গী) রাঙা, মমতাহেনা, চম্পা বেবী (আমাদের পাড়ার মেয়ে) আমার ছোট বোন রানা মনে হয়ে যাচ্ছে। মনে না হয়ে উপায় নেই। কারণ, সেটা ছিল সেকালের নিঃস্বার্থ এক পবিত্র আ্ত্মার কার্জন। স্মৃতি সম্পদ, আমাদের সময় মানে বলছি, প্রায় ৬১ বছর আগের যশোর কলেজের কথা। তখন মেয়েদের সহ-শিক্ষার বিদ্যাঙ্গণে পড়া একটু প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ ছিল। দেওয়াল লিপি, অরুচিকর মন্তব্য এসব উপেক্ষা করে অথবা চোখ মুছে কোন মতে পড়তে যাওয়া আসা, ভালো ছাত্রই বা এত কোথায়, এখানকার মত এড বিভাসিত সমাজ ‘ত’ লিখে গড়েনি। সেই সব বাধাবিপত্তির সময় আমার আবার বলতেন ‘মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে অপরাধ করেনি’। সোজা হয়ে হাট, মাথা উঁচু করে বলো, অধিকার তোমাদেরও সমান সমান। আরও বলতেন, ‘কাঁটার মনে ফুল হয়ে ফুটে উঠো মা’।
সেই সব অসম শক্তিধর অমৃত বাণীর সাথে কলেজ প্রাঙ্গণে সমবয়সী জিএস তরিকুল ভাইও দিতেন সপ্রাণ প্রেরণা, দারুণ আন্তরিক শব্দমালা। তার ব্যক্তিত্ব সংজ্ঞা তিনি নিজে।
যশোর যেমন সত্য, বাপের বাড়ির এখানে যেমন সত্য, অতিক্রান্ত সেই অতীত, যা এখন মনে হয়, যেন বাল্যবেলা-তেমন চিরয়ত সত্য আমাদের জেনারেল সেক্রেটারি তরিকুল ভাই, সজুন, অমায়িক কত যে আপন। হঠাৎই সেদিন সন্ধ্যাবেলা নার্গিস-এর ফোন পেয়ে এতোকাল পরে কেমন যেন হিল্লোল শুরু হয়েছিল অণুতে পরমাণুতে। বলল, তরিকুল ভাই‘র স্মৃতিচারণ করে কিছু যদি লিখি।
আমার কী যে হল, ভাবনা নেই, চিন্তা নেই তখুনি হাতের কাছে যা কাগজ ছিল ঝটিকার মতন, সেই মুহূর্তে তরিকুল ভাই’র নাম উচ্চারণের সাথে সাথে যা যা মনে এলো লিখে দিলাম। অগোছালো, এলোমেলো। টুকরা টুকরা অবিন্যস্ত। আরেকবার পড়েও দেখলাম না। সকালে কুরিয়ার যাচ্ছে যশোরে ঐ সাথে দিয়ে দিলাম। আসলে এই চুয়াত্তর বছর বয়সে কী আর ভাল, ময়, মাত্রা জ্ঞান থাকে ? আজ কেবল উচ্ছ্বাস ফেলে আসা স্মৃতির জন্য আবেগ।
নার্গিসকে বললাম, একটু ধফরঃ করে দিতে। ও বলল, না, আপা আপনার লেখার উপর হাত দেবো না।
রইল তবে তখনি, যে পড়বেন, নিজ গুণে ক্ষমাসুন্দর করে নেবেন।
এবার একটু বলি, তরিকুল ভাই-এর ব্যক্তিত্ব প্রসঙ্গত। ঐ যে উপরে একটু লিখেছি অৎঃরংঃরপ খবধফৎবংযরঢ়. স্টাজি তার পরিচয়। সাদাসিধা পোশাক। পাজামা-পাঞ্জাবী ছাড়া অন্য পোশাক আমি দেখিনি। তাও সাদা। আপন মনে বলতেন, অহমিকা নেই চাল চলনে। বক্তৃতায় ছিল না কৃত্রিম কন্ঠ বা সালংজত ব্যঞ্চনা। খবংং রং সড়ৎব এটাই তার উপমা দিতে পারি।
তার উদাত্ত উদার কথায় আকাশ ছায়া দেখতে পেতাম। তাই ‘ত’ আবার কিছু সাহস কিছু প্রেরণা ভক্তি চলে এসেছে আমার কথায় তরিকুল ভাই’র কথা বলতে গিয়ে।
সাংগঠনিক ক্ষমতাও ছিলই তার। বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমাদের সময়টুকু ছাড়া আর ত বেশি দেখার সুযোগ পাইনি। বলব, সেই সময়টুকুর ইতিহাসে বিনয় সমৃদ্ধ অথচ, ক্ষমতাদীপ্ত এক প্রতিভাময় নেতা তরিকুল ভাই এর নাম ছিল অমলিন থাকবে। মুছে যাবার কোনও পথ নেই।
আমাদের সেই সময়টুকু, আমাদের কাছে চির জাগরণে জীবনের সুবর্ণ যুগ। এমন একটা সুযোগ পেলাম আর তার প্রেমপর্বের কথা মোটেই বলবো না তা তো হয় না।
কী আর বলি, এমন ধহমবষরপ খড়াব দেখি নাই আগে। অশ্রুতপূর্বও বটে।
কখন হল, কিভাবে হলো, কি রূপে ভাবের আদান-প্রদান, কারোই দৃষ্টিগোচর হয়নি। কে কার দিকে তাকালো ?
তাই তো বলি, নেতা-নেত্রীর প্রেম অন্যরা কিছু করা। আগেই রটনা শুরু হয়, আর এই মহান প্রেমের সূচনা, বর্ণনা কিছুই জানা গেল না। একেবারে উপসংহারে মধুরেণ সমাপয়েত।
একই বলে অ-সাধারণ ব্যক্তিত্ব। ঝঁঢ়বৎ হধঃঁৎধষ সাধারণের জ্ঞানের বাইরে।
জীবনের সময় শেষ হয়েছে। চলে গেছেন চিরতরে। অপার অন্তহীন অন্তঃসলিলা সম শুভ ছোঁয়া আমাদের : তাদের উদ্দেশ্যে।
লেখক: শিক্ষাবিদ, বন্ধু, সহপাঠী

ক্ষমা করো পিতা
আনোয়ারুল কবির নান্টু

কোনো রাখঢাক নয় একেবারে নিরেট সত্যটা বলি, আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল কিছু একটা লিখি। লেখার অবশ্য দায়ও আমার আছে। কারণ, যাকে নিয়ে লেখার দায় ও ইচ্ছার কথা বলছি তিনি তরিকুল ইসলাম। মানুষের কাছে তাঁর হাজারো পরিচয়। আমার কাছে মাত্র দুটি, যার প্রথমটি তিনি আমাকে দিয়েছেন, আর দ্বিতীয়টি আমি তাঁকে দিয়েছি (মূলত নিয়েছি)। প্রথমটি হচ্ছে, আমি দৈনিক লোকসমাজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। যা তিনি পত্রিকার জনক হিসেবে আমাকে দিয়েছিলেন ২০০৭ সালে। ফখরুল-মঈনের অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতা দখলে পর যখন গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁর গোটা পরিবারকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছিল তখন তিনি লোকসমাজ নামক সন্তানটির দেখভালের ভার আমাকে দেন। তিনি আমার যোগ্যতা, অযোগ্যতা, দায়িত্ব কাণ্ডজ্ঞানবোধ, জেদ, সবই জানতেন। তারপরও তিনি আমাকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্বভার আমার কাঁধে চাপালেন। তৎকালীন এমডি মাহাবুবুর রহমান খোকন ভাই যখন প্রেস ক্লাবের সামনে ডেকে নিয়োগপত্রটি পড়তে দিলেন তখন হাতের লেখাটি দেখেই চোখ ভারী হয়ে যায়। খোকন ভাই বলেছিলেন, তোমার ভাই তোমার নাম লিখে চিঠিটি দিয়েছে। আমি হতবাক বিস্মিত হয়েছিলাম, গোলক ধাঁধায় পড়েছিলাম ভাই কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন। খোকন ভাইকে বলেছিলাম, সেখানে তো অনেক যোগ্যজন আছেন, অনেকে তো আমাকে নাও মানতে পারে। ভাই বলেছিলেন, সেটা দেখার বিষয় তোমার নয়, তোমার ভাই আমাকে এখানে আসতে আর তোমাকে লোকসমাজে যেতে বলেছেন। এখন তুমি তোমার উত্তরটা বলো। আমি সেকেন্ডের ভাবনায় বলেছিলাম ভাইয়ের নির্দেশ অমান্য করার কোনো স্পর্ধাতো আমার নেই। তবে আমাকে এক সপ্তাহ সময় দেন ধাতস্থ হতে। ভাই মাত্র দুদিন সময় দিয়েছিলেন। আর এই দু দিনেই ভাইয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লোকসমাজে একটি বিদ্রোহ হয়ে গেল। কাউকে কিছু না জানিয়ে পত্রিকা অরক্ষিত রেখেই চলে গেলেন দায়িত্বশীল কেউ কেউ। খোকন ভাই আমাকে বিষয়টি জানানোর সাথে সাথেই চলে এলাম লোকসমাজে। এর আগে শুধু রাজেক জাহাঙ্গীরের সাথে কিছু কথা বলেছিলাম আমি। আমার সাথে সেদিন প্রেস ক্লাব থেকে এসেছিল নোভা খন্দকার। আজ সে আর বেঁচে নেই। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন। শুরু হয় আমার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের যাত্রা।
এরপর কিছু নজীর ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। জেলা প্রশাসক অবিশ্বাস্যভাবে এক চিঠি দিয়ে আমাকে নির্দেশ দেন ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত পত্রিকার প্রিন্টার্স লাইনে আপনার নাম প্রকাশ করবেন না।’ অথচ প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে, প্রকাশক মালিক হিসেবে সম্পাদক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নিয়োগ দেবেন। বাকি সব তারাই দেখবেন। এখানে জেলা প্রশাসনের কোন এখতিয়ার রাখা হয়নি। যা হোক এখানেই ঘটনার সমাপ্তি ছিল না। জেলা প্রশাসকের পক্ষে এডিসি শিক্ষা আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদসহ সাংবাদিকতার যাবতীয় প্রমাণাদি দাখিলের নির্দেশ দেন। কী আর করি একেতো ১/১১ এর অসাংবিধানিক শাসন, তার ওপর জেলা প্রশাসন মানে পত্রিকা প্রকাশের অনুমতিদাতা। যাহোক একদিন বড় খোকন ভাই ও বন্ধু জাহিদ হাসান টুকুনের পরামর্শে জমা দিয়ে প্রমাণ করে এলাম কতটা মূর্খ আমি। শুরু হয়ে গেল গোয়েন্দা তদন্ত। একদিকে আমাকে ‘মূর্খ’, জালিয়াতি ও দুর্নীতিপরায়ণ বানানোর চেষ্টা। অপরদিকে তলে তলে শুরু হয় লোকসমাজের মালিকানা হরণের প্রক্রিয়া। তৎকালীন প্রশাসনের কারো কারো পরিকল্পনা ও সহযোগিতায় এই প্রচেষ্টা অনেক দূর এগিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত তার অপমৃত্যু ঘটে। জয় হয় সত্যের।
এদিকে এই ষড়যন্ত্র যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে, তখন শুরু হয় আরেক নির্যাতন। প্রতিদিন রাতে আমাকে বলা হতো ‘স্যার’ আপনাকে সকাল ৯টার মধ্যে আসতে বলেছেন চা খাবেন। ভুল করলে স্যার মাইন্ড করবেন। যাহোক আমি জানতাম ‘স্যারেরা’ কোথায় থাকেন, যশোর পাসপোর্ট অফিসের পাশে তরিকুল ইসলাম উন্নয়নের স্মৃতিবাহী একটি ভবনে তারা থাকেন। নির্দেশমতো কাউকে কিছু না জানিয়ে হাজির হলাম। গেটে পোশাকপরা ভারী অস্ত্রধারীদের কাছে সালাম দিয়ে পরিচয় দিলাম। একজন বললেন, ওখানে অপেক্ষা করুন স্যার আপনাকে ডাকবেন জানিয়েছেন। তারপর সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত রোদে দাঁড়িয়ে থাকার পর একজন এসে বললেন, স্যার বিশেষ জরুরি মিটিংয়ে আছেন আপনাকে কাল আসতে বলেছেন। এরপর শুরু হলো প্রতিদিন দু ঘন্টার হাজিরা। প্রায় এক মাস স্যারের দেখা না পেয়ে অতিষ্ঠ হয়ে দুদিন হাজির হলাম না। যা হয় হবে এমনভাবে থাকার পর ফরিদপুর জোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারের শরণাপন্ন হলাম। সব জানার পর তিনি একটি ফোন করলেন এবং আমাকে বললেন, যান কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন। তারপর এই ঝামেলা আর হয়নি। তবে আমার বাড়ির সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছিল গভীর রাতের কিছু ফোনালাপ জানতে পারে।
যাহোক এরই মাঝে একদিকে চলছিল আমার আদ্যোপান্ত তদন্ত। অন্যদিকে চলছিল আমাকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নিয়োগ দেওয়ায় সর্বস্তরের মানুষের শুভেচ্ছার বন্যা। যা প্রশাসনের ওপর একটি চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল অতঃপর তদন্ত শেষ হলো। সকল তদন্ত সংস্থা রিপোর্ট দিলো, যার সার কথা ছিল আমি অসৎ চরিত্রহীন নই, রাজনৈতিকভাবে কট্টর বিএনপি এবং তরিকুল ইসলামের অতিবিশ্বস্ত একজন। ছিলো আরও কিছু কথা যার সবই আমার প্রশংসা। এরপর জেলা প্রশাসক আমাকে চিঠি দিয়ে তাদের আপত্তি তুলে নিলেন এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে একটি অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্র দিয়ে ধন্য করলেন। আমি অফিসে মিষ্টি মুখ করে প্রিন্টার্স লাইনে নাম তুলে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হয়ে গেলাম। সেই থেকে আমি ১৪ বছর সম্পাদক তালিকাভুক্ত হয়ে আছি যা একজন পেশাদার সাংবাদিকের জীবনের শেষ স্বপ্ন। আমি নির্ধিধায় স্বীকার করছি, জীবনে আমি হয়ত কেনো দিন সম্পাদক হতে পারতাম না, কারণ পেশাদার সম্পাদক যশোরে নেই, সবাই মালিক সম্পাদক। আমার এমন টাকা বা ব্যাকিং নেই যা দিয়ে আমি মালিক সম্পাদক হতে পারি, আমার ওই যোগ্যতাও নেই, যা দিয়ে একটি কাগজের মালিক হয়ে সংবাদপত্র জগতকে কলঙ্কিত করতে পারি অতঃপর সার্বিক বিবেচনায় আমি হয়ত সম্পাদক হতে পারতাম না তাই আজ সবার সামনে মাথা উঁচু করে গলা ফাঁটিয়ে বলছি, ‘হে পিতা আমি অকৃতজ্ঞ নই, আমি তোমার কাছে ঋণী, আমি আমার সে ঋণ স্বীকার করছি, তুমিই আমাকে অযোগ্য জেনেও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করেছিলে বলেই আমি আজ সম্পাদক।’ আমি জানি না, আমার প্রতি আপনার আস্থার সে প্রমাণ আমি দিতে পেরেছি কিনা। আমার যোগ্যতার কোনো প্রমাণ আমার কাছে নেই, যা আছে তা পাঠকের কাছে। আমি শুধু এইটুকু বলছি, বৈরী শাসনের ধ্বংস প্রচেষ্টা থেকে আমি আপনার প্রিয় সন্তান লোকসমাজকে সুরক্ষিত রেখেছি। এক্ষেত্রে অবশ্যই আমার সকল সহকর্মীর প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা তাদের আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না। স্বীকার করছি, নির্বাহী সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের প্রতি, তিনিও ছিলেন আমার কান্ডারি সকল দুঃসময় পাড়ি দিতে কার্যকর পরামর্শ ও সাহস দানে আমি তার সমকক্ষ কাউকে দেখিনি, তবে অবশ্যই ব্যতিক্রম তরিকুল ইসলাম। বর্তমান প্রকাশক শান্তনু ইসলাম সুমিতের সাথে আমার কাজের সময়কাল মাত্র দু বছর। আমি তাকে দেখছি, তিনি খুবই বিচক্ষণ প্রশাসক পিতার অনেকগুণ তাঁর মাঝে স্পষ্ট। সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় থেকে অসহ্য মানসিক যন্ত্রণার মাঝেও তিনি যেভাবে প্রতি মুহূর্তে দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস লোকসমাজ তার হাত ধরে বহুদূর যাবে। আত্মপ্রকাশের অঙ্গীকারও থাকবে অবিচল। তবে সবারই সৌভাগ্য আমাদের সম্পাদক অধ্যাপক নার্গিস বেগম সম্পাদক তো নন, একেবারে সাক্ষাত ‘মা’। সব অপরাধের শাস্তি এক ধমকে শেষ। আমার অবশ্য একটু বাড়তি পাওনার সাথে মাঝে মাঝে মিষ্টিও জোটে ‘মা’ আমি তাঁকে প্রকাশ্যেই বলি তাই নতুন কিছু বলার নেই শুধু দোয়া চাওয়া ছাড়া।
এক জীবনে এ সবই আমি পেয়েছি যার কল্যাণে তাঁকে নিয়ে আর কিছুই বলতে চাই না, শুধু লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, প্রথমটি তিনি আমাকে দিয়েছিলেন, আর দ্বিতীয়টি আমি তাকে দিয়েছিলাম, সেই দ্বিতীয়টি হচ্ছে, একটি স্বীকৃতি। যা আমি তাঁকে দিয়েছিলাম চার দশকেরও আগে। যখন রাজনীতিতে আমি মিছিলের কর্মী এবং তিনি প্রধান অতিথি। মিছিল মিটিং শেষে রাস্তায় হাঁটার সময় আমার মাথায় হাত রেখে মজা করে কুকড়া চুলগুলো টেনে সোজা করার ক্ষমতা আছে কার বলে জিজ্ঞেস করতেন। সবাই অপারগতা প্রকাশ করে হাসতেন। মাথায় ওই পরশ পাথরের ছোঁয়াটা সেই শৈশবেই পেয়েছিলাম আমরা কয়েক বন্ধু হরিণ দেখতে এসেছিল তাঁদের বাড়িতে। সেখানেই তিনি আমাদের আদর করেন এবং আমার চুলে হাত বুলিয়ে বলেছিলেন এতো আমার চেয়েও শক্ত। আমরা তখন তাঁর নাম না জানলেও আদরে মুগ্ধ হয়েছিলাম। মজার ব্যাপার, আমরা সবাই পরে বিএনপি কর্মী হয়েছিলাম এবং এখনও আছি। শুধু এ ঘটনা নয়, অনেক ঘটনা রয়েছে। বলতে পারি, তার সাথে আমার স্মৃতির যে শেষ নেই তা সবারই জানা। তবে হয়তো অনেকেরই জানা নেই এর বিনিময়ে আমি তাঁকে কী দিয়েছি। না, তেমন কিছুই আমি তাকে দিইনি। শুধু দিয়েছি পরিচয়। যা জানেন একটি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া থেকে সারাদেশের সাংবাদিক সমাজ। যারা আজও আমাকে তাদের আসরে ওই পরিচয়েই পরিচিত করেন। সেই পরিচয় হচ্ছে ‘তরিকুল ইসলাম আমার রাজনৈতিক পিতা’Ñ আমি তাঁর আদর্শের সন্তান লোকসমাজও। রাজনীতির বাইরেও তিনি আমার পিতা। এই পরিচয় দিতে অবশ্য কখনই তাঁর অনুমতি আমি গ্রহণ করিনি, ঢাকার সাংবাদিক বন্ধুরা যখন তাঁকে বলতেন, আপনার ছেলে আছে আমাদের সাথে তখন তিনি বলতেন (নেতাদের ভাষায়) নান্টুর সাথে যোগাযোগ রাখেন। তারা আমাকে বলতেন, আপনার বাপ আমাদের সাথে থাকতে বলেছেন। এমন অসংখ্য ঘটনাতেই আমি নিশ্চিত ছিলাম আমার অবস্থা কোথায় এবং আমার দেয়া পরিচয় তিনি ধারণ করেন। আমাকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্বটা সেই বিশ্বাসেরই দালিলিক স্বীকৃতি ছিল বলে আজও আমি বিশ্বাস করি।
এই বিশ্বাস থেকে আমি আজ আবারো বলছি ‘তুমিই আমার আদর্শের পিতা।’ যেখানেই থাকিÑযেভাবেই থাকি, যতক্ষণ বেঁচে থাকবো ততক্ষণ তোমার পুত্র হয়েই থাকবো। আমার ঘরে বসে দেয়া সেই প্রতিশ্রুতি কখনই ভুলবো না। লোকালয়ের বাইরে গিয়েও উড়িয়ে যাবো তোমার উন্নয়নের ঝাণ্ডা। অধিকারের মাত্রাজ্ঞানহীনতা ছিল আমার অনেক। ক্ষমা পাবো বিশ্বাসে ক্ষমা চেয়ে তাই বিরক্ত করিনি কখনও। তবে আজ শুধু মনে হচ্ছে সে ছিল ভুল’ তাই করোজোড়ে মিনতি আমার হে পিতা ক্ষমা করো আমায়, একটু স্বস্তি দাও, বড়ো যন্ত্রণা এই বুকে- তুমি নেই তাই কেউ বোঝে না। তুমি জান্নাতে থাকো, শান্তিতে থাকো, তুমি ঘুমাও শান্তিতে, যেখানেই থাকি আমি জেগে রবো আমৃত্যু তোমারই আদর্শে।

 

“আমার স্মৃতিতে তরিকুল ইসলাম”
এ.এস.এম মিজানুর রহমান (কালাম)

আমি এ.এস.এম মিজানুর রহমান (কালাম), আমি যশোর মিউনিসিপ্যাল প্রিপারেটরী উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৮১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম। আমাদের বায়োলজি পড়াতেন এবং প্র্যাকটিক্যাল করাতেন ঐ প্রতিষ্ঠানের জোসনা জামান ম্যাডাম। কিন্তু ঐ সময় তিনি বি.এড. ক্লাস করার কারণে বিদ্যালয়ে পাঠ থেকে তিনি ছুটিতে ছিলেন। আমরা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা মহাবিপদের সম্মুখীন হলাম। কারণ আমাদের বায়োলজি প্র্যাকটিক্যাল করানোর মত যোগ্য কোন শিক্ষক প্রতিষ্ঠানে ছিল না। তখন আমি, রানা, উমু, আরও কয়েকজন মিলে তখনকার পৌরসভার চেয়ারম্যান জনাব তরিকুল ইসলামের সাথে সাক্ষাৎ করি। আমাদের অসুবিধার কথা জানালে তিনি বিচলিত হয়ে ওঠেন এবং সাথে সাথে টেলিফোন তুলে সম্মিলনী স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে ফোন করেন এবং আমাদের বায়োলজি প্র্যাকটিক্যাল করানোর জন্য একজন দক্ষ শিক্ষকের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেন। তারপর প্রায় পাঁচদিন আমাদের বায়োলজি প্রাকটিক্যাল করান। পরবর্তীতে আমরা সবাই বায়োলজির প্র্যাকটিক্যালে ২৫ নম্বরের মধ্যে ২৫ নম্বরই পাই। আমি ও আমরা সকলেই উপকৃত হই। তাই, আজ আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে প্রয়াত অভিভাবককে স্মরণ করছি এবং মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে তার শান্তির জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করছি, আল্লাহ তাকে যেন জান্নাতুল ফেরদাউস নছীব করেন। (আমিন)।