২৪ তম প্রতীষ্ঠাবার্ষিকীর বিশেষ সংখ্যার একগুচ্ছ লেখা-১

0

উনিশ শতকের বৌদ্ধিক পরাজয় কোন রেনেসাঁ নয়
আমিরুল আলম খান
রেনেসাঁর বাংলা তরজমা যদি পুনর্জাগরণ হয়, তবে আগে এ প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া দরকার বাংলার প্রথম জাগরণ হয়েছিল কবে? সেটি কি পাল যুগে? আলাউদ্দীন হোসেন শাহের কালে? নাকি পাঠান বা মুঘল যুগে? যদি পালযুগে বাংলায় প্রথম জাগরণ হয়েছিল, তাহলে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, গোটা মুসলমান যুগ ছিল অন্ধকার যুগ। তবে যে রিচার্ড বুচার দ্বৈত্য শাসনের কুফল লিখতে গিয়ে লিখেছেন, “দেওয়ানি লাভের পর এদেশ থেকে যত বেশি সম্ভব টাকা তুলে নেওয়াই ইংরেজের প্রাথমিক বিবেচনা ছিল…এত সমৃদ্ধ দেশটি ধ্বংসের কিনারায় চলে যাচ্ছে” (উদ্ধৃত পুলক)। দেওয়ানি লাভের পর ১৭৬৫-তেই ভবিষ্যৎ শাসনের যে প্রথম পরিকল্পনা ক্লাইভ কোম্পানির ডিরেক্টরদের কাছে পেশ করেছিলেন তার ভিতরেই ধরা পড়ে বণিকের নগ্ন অর্থলোলুপতা। …এদেশের মানুষকে বঞ্চিত করে ইংল্যান্ডকে সমৃদ্ধ করে তুলবার মারাত্মক অর্থনৈতিক শোষণ-নীতি ছিল সমগ্র ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনপর্বের প্রধান অবলম্বন। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার একে ‘ফ্যাটাল ইকোনমিক ড্রেন’ বলে বর্ণনা করেছেন।
তাহলে পুনর্জাগরণ কোন যুগে? ইংরেজ আর বাঙালি পন্ডিতরা একযোগে কীর্তন গায় পুনর্জাগণের কাল হল উনিশ শতক যখন কলকাতায় ব্রিটিশ আধিপত্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার চর্চা চলছে। তাহলে কি মেনে নিতে হবে যে, পাশ্চাত্য শিক্ষাই হল রেনেসাঁর মূল শর্ত? এত সোজা সাপটা বক্তব্য বদ্ধ উন্মাদও স্বীকার করবে বলে মনে না।
তাহলে জাগরণের সংজ্ঞা কী? শিল্প-সাহিত্যে অগ্রগতি? টানা উনিশ শতকে বাংলা গদ্য একটি নতুন ফর্মে আবির্ভূত হচ্ছে। কিন্তু সে গদ্য দীর্ঘকাল ধরে বিকশিত হওয়া সাধারণ মানুষের বুলি থেকে একেবারেই আলাদা। শুধু গদ্যের বিকাশ কি চিন্তাচর্চার চাবিকাঠি হতে পারে? নিশ্চয়ই নয়। পন্ডিতের হাতে তৈরি হওয়া এ গদ্য বাংলার ৯০ ভাগ আমজনতাকে ‘অশিক্ষিত’ ‘মূর্খ’ বানিয়ে দিল। আমজনতার মুখের বুলিকে অস্বীকার করে এক কৃত্রিম ভাষা চাপিয়ে দেওয়া কি কখনও ‘জাগরণ’ বলে চিহ্নিত হতে পারে? তাহলে উনিশ শতকে বাংলায় এমন কী ঘটনা ঘটেছিল যে পশ্চিম আর পুবের তামাম পন্ডিত একজোট হয়ে তাকে রেনেসাঁ বলে ধিন ধিন করে নাচে?
চিন্তার সর্বোচ্চ বিকাশ নিশ্চয় শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞানের মেলবন্ধনে সম্ভব। জাতি হিসেবে স্বাধীন না হয়ে কিংবা স্বাধীনতার সুতীব্র আকাক্সক্ষা ও লড়াই ভিন্ন কি রেনেসাঁ কল্পনা করা যায়? স্বীকার করি উনিশ শতকে কলকাতায় কিছু লোক ইংরেজি শিখেছিল যা দিয়ে চিঠিপত্র লেখা কিংবা কেরানিগিরির কাজ চালানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এক মেঘনাদবধকাব্য ছাড়া গোটা উনিশ শতকে বাঙালির কালোত্তীর্ণ সাহিত্য কীর্তি আর কিছু আছে কি? আর বিজ্ঞানের চর্চা? সেটি মুঘল আমলে যেটুকু ছিল তারও পতন ঘটেছিল। যন্ত্র শিল্পের বিকাশ এখানে ঘটে নি এ কথা ঠিক। শক্তি হিসেবে বাষ্পের ব্যবহার সপ্তদশ শতকে স্পেনে শুরু হয়েছিল সীমিত পরিসরে। কিন্তু ১৭৮৬ সালে জেমস ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কৃত হবার আগ পর্যন্ত গোটা পৃথিবী তো ছিল আগুন আর বায়ু নির্ভরই। পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে তো ইউরোপেও বাষ্পীয় ইঞ্জিন অজানাই ছিল। এমন কোন একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা আমরা জানতে পারি নি যেটি উনিশ শতকের বাংলায় হয়েছিল। বরং উল্টোটাই হয়েছিল মর্মান্তিকভাবে। বাংলার যে বস্ত্রশিল্পের গৌরব প্রাচীন কাল থেকে গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল ১৭৬৫ সালের পর বিলেতে কোম্পানির ইন্ডিয়া অফিস থেকে তা ধ্বংস করার সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এদেশীয় কর্মীদের। এককালে যে বৈদেশিক বাণিজ্য ছিল সর্বাংশে বাংলার অনুকূলে সে বাণিজ্য চলে গেল বিলেতি পণ্যের দখলে। গোটা ভারতের শস্যভান্ডার বাংলায় প্রথমবারের মত ভয়াবহ মহামন্বান্তরে (ছিয়াত্তরের মহামন¦ান্তর)। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে (১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ) এই মহামন্বান্তরে প্রাণ হারায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। বাংলা কোম্পানির দখলিত হবার মাত্র এগারো বছরের মাথায়। শতবর্ষ পর আরও একটি প্রায় অনুরূপ মহামন্বন্তরে (১২৭৬ বঙ্গাব্দে) বাংলা প্রায় জনশূন্য হয়ে যায়। ব্রিটিশ শাসনের শেষ দশকে ১৯৪৩ সালে আরেকটি মন্বান্তর উপহার দিয়ে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান হয়। ব্রিটিশের ১৯০ বছরের শাসনকালে বাংলা এভাবে তিনটি মহামন্বান্তরের কবলে পড়ে। ভারতবর্ষের দুহাজার বছরের ইতিহাসে এমন মন্বান্তরের নজির নেই।
এবার আসি শিক্ষার কথায়। ব্রিটিশপূর্ব বাংলায় কার্যকর শিক্ষিতের হার ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ (নেহেরু, ২০১১, পৃ. ২৭৪-২৭৫)। তখন গোটা ইউরোপের কোথাও স্বাক্ষরতার হার ৪০ শতাংশ স্পর্শ করে নি। বাংলার প্রতিটি গ্রামে মক্তব এবং টোল ছিল। সেখানে সর্বশ্রেণীর শিশুদের যেমন শিক্ষালাভের সুযোগ ছিল, তেমনি শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত হতে পারত সমাজের উঁচু-নিচু সর্ব শ্রেণীর হিন্দু বা মুসলমান (আচার্য, ২০১১, পৃ. ১৭) । ব্রিটিশ যখন ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে তখন এখানে স্বাক্ষরতার হার নেমে এসেছিল মাত্র ১৩ শতাংশে!
ইউরোপে যন্ত্রশিল্পের বিকাশ এবং শিল্পবিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত ভারতের উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল ইউরোপের যে কোন দেশের চেয়ে চেয়ে উন্নততর। তখনও একমাত্র মুদ্রণযন্ত্র ভারতে প্রচলিত হয় নি। ফলে সকল দলিলদস্তাবেজ তৈরি, গ্রন্থাদি প্রকাশিত হত সময়সাপেক্ষ ও শ্রমসাধ্য হাতে লিখে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলা অধিকার করার মাত্র ২০ বছরের শোষণে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়ে তর তর করে এগিয়ে যায়। আর সে শিল্পবিপ্লবের অর্থ, কাঁচামালের যোগান যায় ইংরেজ অধিকৃত বাংলা থেকে (দত্ত, ১৯৬৩)। তাহলে কোন বিবেচনায় আমরা স্বীকার করব যে, উনিশ শতকে বাংলায় একটি রেনেসাঁ সংগঠিত হয়েছিল? যখন একটি জাতি নজিরবিহীন লুণ্ঠনের শিকার, যখন শিক্ষার হার ক্রমশ নি¤œমুখি, যখন গোটা জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি, যখন তার আপন গৌরব অন্তর্হিত, তার ভাষা-সংস্কৃতি, জাতীয় সংহতি ধ্বংসপ্রাপ্ত ঠিক সেই সময়কে বলা হচ্ছে রেনেসাঁ! ইতিহাসে এর চেয়ে বড় মিথ্যা দুটি নেই।
বৌদ্ধিক পরাজয়ই আসল পরাধীনতা। রাষ্ট্রীয় পরাধীনতাকে রেনেসাঁর কীর্তন বলে চালিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদ। আর তাতেই ধেঁই ধেঁই নেচে উঠেছিল উনিশ শতকের বাংলার তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ। কলকাতার ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা যখন রেনেসাঁর আতর মেখে ইংরেজ মহলে সুবাস ছড়াচ্ছিল তখন হাজারে হাজারে স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ ইংরেজ শাসকদের কামানের গোলায় নয়ত ফাঁসিতে ঝুলে প্রাণ বলি দিচ্ছিল। তখন একমাত্র ঈশ^র গুপ্ত ছাড়া কলকাতার কোন পত্রিকা সম্পাদকই স্বাধীনতার স্বপক্ষে কলম ধরার হিম্মৎ দেখায়নি। বরং শিক্ষিত, বিত্তশালী, জমিদার, বণিকরা হায় হায় করেছিল ‘অজ্ঞ মানুষের মূর্খতায়’! ধূর্ত ইংরেজ যখন ভারত ছেড়ে চলে যায় তখন প্রতিহিংসার শিকার হয় নি একজন ইংরেজও। বরং সাম্প্রদায়িকতায় অগ্নিগর্ভ ভারতে লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমান শিখ প্রাণ হারিয়েছিল নিজেদের মধ্যে কলহবিবাদে। অথচ এই ভারতেই প্রায় হাজার বছর ধরে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি শান্তিতে বসবাস করেছে, গড়ে তুলেছিল এক মহান সাংস্কৃতিক মৈত্রীবন্ধন। ইংরেজ এসে সে বন্ধন ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। আর নাম দেয় রেনেসাঁ!
সমাজ নৈতিকতা বর্জিত হলে অনাচার বাড়বে তাতে আর আশ্চর্য কি? দীর্ঘ ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনে শোষণে সে বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। আজও সেই বিষবাষ্পে গোটা উপমহাদেশ জ¦লেপুড়ে ছারখার হচ্ছে।
মুঘল সম্রাট ফররুখ সিয়রের (রাজত্বকাল ১৭১৩-১৭১৯) কাছ থেকে ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে নামমাত্র করের বিনিময়ে বাণিজ্য ফরমানে মৌরসি পাট্টা দিয়েছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। অতি দ্রুতই তারা এতই প্রতাপশালী হয়ে ওঠে যে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে। তারা বাংলার স্বাধীন নবাবদের তোয়াক্কাই করত না। ফলে শাসন ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছিল চরম নৈরাজ্য। মুর্শিদকুলি খান (রাজত্বকাল ১৭১৭-১৭২৭) যদিও কঠোর হস্তে এসব দমন করতে পেরেছিলেন এবং আলীবর্দী খানও (রাজত্বকাল ১৭৪০-১৭৫৬) সে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন তবু বৃদ্ধ নবাব আলীবর্দী খাঁর আমলে মারাঠা বর্গীর হাঙ্গামায় নাস্তানাবুদ হন। একদিকে ইংরেজের বেপরোয়া বাণিজ্য ও লুটতরাজ অন্যদিকে বর্গীর হাঙ্গামা দমনে আলীবর্দী খাঁ এতটাই নাকাল হয়ে পড়েন যে, তার বিশাল সা¤্রাজ্যের একটি অংশ উড়িষ্যা বর্গীদের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরপর তিনি মনোযোগী হন ইংরেজ বণিকদের বেপরোয়া বাণিজ্য ও লুটতরাজ বন্ধ করতে। কিন্তু ক্লান্ত বৃদ্ধ নবাবের পক্ষে সেটা কঠিন ছিল। তার মৃত্যুর পর তার দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাহ ১৭৫৬ সালে বাংলার সিংহাসনে আসীন হলে মুর্শিদাবাদ আর কলকাতার ইংরেজভক্তরা নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করে।
প্রথমদিকে এ চক্রান্তে যারা লিপ্ত হয় তাদের অধিকাংশ হিন্দু, স্বল্প সংখ্যক মুসলমান। মুঘল দরবার বা মুর্শিদাবাদের নবাবী চলত হিন্দু প্রাধান্যে। তার কারণ ছিল, মুসলমানরা বিদেশাগত হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূমিপুত্র হিন্দুদের সাথে যথাসম্ভব মিত্রতা বজায় রেখেছিল। অন্যথায় টিকে থাকার জন্য গোটা সা¤্রাজ্যে শক্তি প্রয়োগ করে ইসলাম প্রচার করতে হত। সালতনাতের কালে তেমন কিছু যে ঘটেনি তা নয়; তবে পাঠান-মুঘলরা হিন্দুদের মন জয় করেছিল পরধর্ম সহিষ্ণুতা আর ধৈর্য দিয়ে। পারসিক সুফিবাদ ভাল ফল দিয়েছিল। হিন্দু-মুসলমানের থানগুলো উভয় ধর্মের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। মুসলমানদের দীর্ঘ শাসনামলে তাই ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয় নি।
মুঘল স¤্রাট ফররুখ সিয়র ১৭১৭ সালে ইংরেজ কোম্পানিকে নামমাত্র শুল্কের ফরমান উপহার আর ১৭৬৫ সালে স¤্রাট শাহ আলম (রাজত্বকাল ১৭৬০-১৮০৬) বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানি দিয়ে যে অপরিণামদর্শিতার সূচনা করেছিলেন ভারতবাসীকে তার চরম মূল্য দিতে হয়েছে; এখনও ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ তার মাশুল গুনছে।
পলাশির যুদ্ধের মাত্র আট বছরের মাথায় বিলেতের ইন্ডিয়া অফিস বাংলা থেকে রেশমী বস্ত্রের পরিবর্তে কাঁচা রেশম বিলেতে পাঠানোর নির্দেশনা দেয়। তারা বঙ্গীয় তাঁতীদের ধবংস করার জন্য নিষ্ঠুর পথ বাৎলে দেয়। ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের সেই প্রথম লগ্নে বাংলা পরিণত হয় পণ্য রপ্তানির পরিবর্তে কাঁচামাল রপ্তানির দেশে। বাংলায় ক্লাইভ (ভারতে সৈনিক জীবন ১৭৪৬-১৭৭৪) আর কোম্পানির কর্মচারীরা যে লুণ্ঠণ করে ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। সে মহা লুণ্ঠনের ফলে ১৭৭০ সালে ঘটে ইতিহাসের ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষ (ছিঁয়াত্তরের মহামন্বন্তর)। বাংলা ও বিহারে এই দুর্ভিক্ষে মারা যায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ (প্রায় ১ কোটি)। বিপরীতে কোম্পানির লোকেরা সম্পদের পাহাড় গড়ে। ইংল্যান্ডে সম্ভব করে তোলে শিল্পবিপ্লব। আর কলকাতায় এসব কাজে তাদের সোৎসাহে সহযোগিতা করে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর কিছু মুৎসুদ্দি, আদর করে যাদের আমরা ভদ্রলোক বা মধ্যবিত্ত বলি। সাথে ছিলেন সে কালের সবচেয়ে বড় ব্যাংকার জগৎ শেঠ।
পলাশির যুদ্ধের পর মুঘল দরবার থেকে বাংলার দেওয়ানি লাভ ছিল কোম্পানির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। কোম্পানির সাথে ফড়িয়াগিরি, মুৎসুদ্দিগিরি করে কলকাতায় জন্ম নিয়েছিল এক নতুন মধ্যবিত্ত সমাজ। ইতিহাস বলে, এই মধ্যবিত্ত সমাজই হয়ে উঠেছিল কলকাতায় কোম্পানির শক্তি সঞ্চয়ের আসল কারখানা।
কলকাতার বণিক, তথাকথিত বনেদি সমাজ, রাজা, ব্যাংকার আর মুর্শিদাবাদের কুচক্রীরা একজোট হয়েছিল স্বদেশের স্বাধীনতা পরদেশী বণিকের হাতে তুলে দিয়ে নিজেরা লাভবান হতে। স্বাধীনতার বিনিময়ে সাময়িক লাভ তাদের হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু স্বাধীনতা হারানোর মূল্য তারা বোঝে নি। এমন কি, ১৭৫৭ সালের পর থেকে ঊনিশ শতক জুড়ে কলকাতার এই কুচক্রীমহল ‘স্বদেশপ্রেমের একচেটিয়া অধিকার’ ভোগ করেছিল। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে যখন উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোটা ভারত, বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে, দিল্লিতে মুঘল সা¤্রাজ্যের পতাকা আবার উড়তে শুরু করেছিল পতপত করে তখনও কলকাতার বাবুরা শুধু নিষ্পৃহ থাকে নি, বরং তাদের সর্বশক্তি দিয়ে ইংরেজ রাজের পক্ষে একজোট হয়েছিল।
কলকাতার তথাকথিত আধুনিক পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা ইংরেজ শাসনের অবসান কল্পনাও করতে পারত না। তারা স্বপ্ন দেখত, আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মত সাদা ইংরেজ কালো ভারতে এসে বসত গাড়বে, সভ্যতার আলো ছড়াবে। সে জন্য তারা কম সাধ্যসাধনা করে নি। সে পদসেবার যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদ তাদের ললাটে ‘রেনেসাঁ’ বা নবজাগরণবাদের জনক বলে বিজয় তিলক এঁকে দিয়েছিল। সে ট্রাডিশন আজও সমানে চলছে।
বাংলায় রেনেসাঁ বা নবজাগরণ শব্দবন্ধ শুনলে আমার হাসি পায়, লজ্জা লাগে। যে জাতি পরাধীনতার গ্লানি অনুভব করতে ব্যর্থ সে জাতির পুরোহিতদের রেনেসাঁর পুরোধা বলার চেয়ে লজ্জার আর কি থাকতে পারে?
মুদ্রার এক পিঠে বাংলার রাজনৈতিক কুশীলবদের আমরা নানা রঙের সাজ পোশাকে মঞ্চে নাচতে দেখে বাহবা দিই। পরাধীন যুগে যেমন যেমন তাদের চরিত্র মহান রূপে চিত্রিত করা হয়েছিল, স্বাধীন যুগেও তার বিন্দুমাত্র অবসান ঘটে নি। বরং আরও সমারোহে আমরা সে ঢাক পিটিয়ে চলেছি। স্বাধীন জাতি হিসেবে এ লজ্জা রাখি কোথায়?
বাংলার স্বাধীনতা হারানোর ইতিহাসে আমরা শুধুই সৈনাধ্যক্ষ আর ব্যাংকারের ভূমিকা সামনে এনেছি। কিন্তু সে যুগের কলকাতার প্রতাপশালী বিত্তশালী শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বোদ্ধাদের আড়ালে রেখেছি। কলকাতায় গড় বানোনোর সকল আয়োজনে সে কালের কলকাতার সবচেয়ে বিত্তশালী দুটি পরিবারের ভূমিকা আমরা কমই বিচার করেছি। অথচ তাদের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া কলকাতায় ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়াম বানাতেই পারত না। শুধু তাই নয়, নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর কলকাতা জয়, আলিনগরের সন্ধি এবং পলাশির সাজানো যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে নবারের পরাজয়ের পর কলকাতার দুটি পরিবার যেভাবে ইংরেজ বণিকদের সাহায্য সহযোগিতা করেছে সেটা না হলে, পলাশির পরাজয়েই বাংলার স্বাধীনতা সূর্য হয়ত অস্তমিত হত না। মাত্র একটা খ- যুদ্ধে একটি জাতির পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায় ইতিহাসে এ রকম ঘটনা বিরল। ভারতে একেকটা খ-যুদ্ধের পর আরও অসংখ্য যুদ্ধ হয়েছে এবং প্রথম যুদ্ধের পরাজয় পরবর্তী যুদ্ধে বিজয়ের সম্মান বয়ে এনেছে। পাঠানদের কাছে পরাজিত হয়ে মুঘল হুমায়ুন পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই হুমায়ুন আবার পুনরুদ্ধার করেছিলেন মুঘল সিংহাসন। তাই যদি হয়, তাহলে, পলাশির সাজানো যুদ্ধের পর বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় শুধুমাত্র মীর কাসিম ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, আর সবাই নিশ্চুপ দর্শক হয়ে গেল কোন যাদুমন্ত্রে?
শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রেই একটি জাতির জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় না। সশস্ত্র যুদ্ধের বাইরে চলে আরও অনেক খন্ড যুদ্ধ। এবং সে যুদ্ধ হয় অনেক বেশি গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। সাংস্কৃতিক কাঠামো না ভেঙে কোন সশস্ত্র যুদ্ধ শেষ বিচারে জয়ী হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধিক পরাজয় না ঘটা পর্যন্ত একটি জাতির ললাটে পরাধীনতার লজ্জাচিহ্ন এঁকে দেয়া কোন কালেই সম্ভব হয় না। অথচ আমাদের জাতীয় ইতিহাস রচনায় এই অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে সামান্যই। যদি এ বিষয়ে ব্যাপকতর চর্চা হত, তাহলে আমাদের ইতিহাসের বহু তথাকথিত মহাপুরুষ আবর্জনার পূতিগন্ধে হারিয়ে যেতেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর কয়েক জন মহাপুরুষের নাম আমরা আলোচনা করতে পারি। চরিত্রগতভাবে এঁরা সবাই ছিলেন মুৎসুদ্দি। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে এদের কেউ কেউ বড় জমিদার হয়েছেন। প্রায় সবাই ফোর্ট উইলিয়ামে কেরানিগিরি, দেওয়ানগিরিও করেছেন। কেউ পেয়েছেন রাজা, মহারাজা, প্রিন্স খেতাব। এ মুৎসুদ্দিদের মধ্যে বয়সে সবার বড় রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করেছিলেন পীরেলি ব্রাহ্মণ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৩৯)। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন ঈশ^রচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় (১৮২০-১৮৮৭, যাঁকে আমরা বিদাসাগর বলেই বেশি সম্মান করি)। এঁদের জুনিয়র আরও ছিলেন সাহিত্যস¤্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪), কবি রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় (১৮২৮-১৮৯১) প্রমুখ। এঁরা দুজনই ডেপুটি কালেক্টর হয়েছিলেন।
রেনেসাঁ নিয়ে বাঙালির গর্বের শেষ নেই। সেটি নাকি ঘটেছিল ঊনিশ শতকে ইংরেজি ভাষায় পশ্চিমা কেতাব মুখস্থ করে। খোদ বিলেতেও যখন শেক্সপিয়র, মিল্টন, শেলী, কীটস, বাইরন বা বেকন পাঠ্য হয় নি তখন ইংরেজি শিক্ষায় উন্মাদ হয়ে ওঠা কলকাতার মুৎসুদ্দি ঘরের ছেলেরা দল বেঁধে তা মুখস্থ করেছে। সাথে মিল, বেন্থামও ছিলেন বটে। তবে তাতে কলকাতার নববাবুদের মন গণতন্ত্রের জন্য, স্বাধীনতার জন্য উতলা হয় নি। আর বিজ্ঞানের চর্চা হয়েছে নাম কা ওয়াস্তে। নূর মোহাম্মদ সাম্রাজ্যবাদী এই শিক্ষাব্যবস্থাকে বর্ণনা করেছেন “রুল অব নলেজ প্রজেক্ট” নামে (নূর মোহাম্মদ, পৃ. ৪২)।
পলাশীর যুদ্ধকে “মধ্যযুগের অবসান এবং আধুনিক যুগের স্বর্ণালী সূর্যোদয়” বলে বন্দনা করতে অতটুকু লজ্জা পাননি বাঙালি ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার। “পলাশীর রক্তাক্ত যুদ্ধের ময়দান পিছনে ফেলে সূর্য যখন অস্ত গেল সেই সঙ্গে মধ্যযুগের অবসান ঘটল এবং আধুনিক যুগের শুরু হল” (বঙ্গানুবাদ নূর মোহাম্মদ, পৃ. ৪০)। ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতি এমন নির্লজ্জ দালালী শুধু বাঙালি বুদ্ধিজীবীর পক্ষেই বোধহয় সম্ভব।
কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষার পত্তন অবশ্য পলাশি যুদ্ধের ৩০ বছর আগে, ১৭২৭ সালে। ফোর্ট উইলিয়ামের পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষার সূচনা করেছিলেন পলাশি যুদ্ধের অন্যতম ষড়যন্ত্রী, বিশ^াসঘাতক উমিচাঁদ (আচার্য, ২০১১, পৃ. ১৫৫)।
রাজা রামমোহন রায়
রামমোহন রায় জন্মেছিলেন হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে তার মামার বাড়িতে। কলকাতা থেকে এই গ্রাম ১২০ কিলোমিটার দূরে। রামমোহনের বাল্যশিক্ষা নিজ গ্রামে, পরে পাটনার বিখ্যাত মাদরাসায়। সেখানে তিনি ফারসি আর আরবি শেখেন। সংস্কৃত শেখেন বারাণসিতে। আর কলকাতায় এসে ইংরেজি। খুব অল্প বয়সে তিনি কলকাতায় আসেন অর্থোপার্জনের নিমিত্তে। ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ পর্যন্ত তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান হিসেবে রংপুরে কাজ করেন। স্থায়ীভাবে কলকাতা আসেন ১৮১৫ সালে। তিনি গ্রিক, লাতিন ও হিব্রু ভাষায় পান্ডিত্য অর্জন করেন। কলকাতায় আসার পর তিনি লেখালেখি ও সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। অনেকের মতে, তিনি বাংলা গদ্যের জনক। তবে সে বাংলা উইলিয়াম কেরির মত যেমন নয়, তেমনি বিদ্যাসাগরের বাংলাও নয়। সতীদাহ প্রথা নিবারণে তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। ১৮২৮ সালে তিনি একেশ^রবাদী ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।
ভারতবর্ষ ইংরেজের অধীন হওয়াকে তিনি ঈশ^রের আশীর্বাদরূপে গণ্য করতেন। মেকলের শিক্ষানীতি (১৮৩৫) রচনারও ১২ বছর আগে রামমোহন বড়লাট আমহার্স্টকে লেখা এক চিঠিতে (১১ ডিসেম্বর, ১৯২৩) ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, সংস্কৃত, আরবি বা ফারসি কোন ভাষাই আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উপযুক্ত নয়। রামমোহন চিঠি লিখেছিলেন বড়লাট আমহার্স্টকে, যখন বড়লাট সংস্কৃত কলেজ খুলতে চেয়েছিলেন, “সংস্কৃত একটা বাতিল বিদ্যা” আর “সারা জীবনেও তা আয়ত্ব করা কঠিন”।
রামমোহন, দ্বারকানাথরা বিশ^াস করতেন ইংল্যান্ড থেকে দলে দলে শে^তাঙ্গরা এসে ভারতে স্থায়ী বসতি গাড়লেই কেবল ‘কালো ভারত’ মুক্তি পেতে পারে। এজন্য ১৮২৯ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় এক প্রকাশ্য সভায় সদাশয় ব্রিটিশ পার্লমেন্টের কাছে “ভারতীয়দের পক্ষে” সানুনয় আরজি জানিয়েছেন রামমোহন আর দ্বারকানাথরা। ব্লেয়ার কিং লিখছেন, এদেশে ইউরোপীয়ানদের বসতি স্থাপনের পক্ষে সবচেয়ে সোচ্চার ওকালতি করেছিলেন রামমোহন রায়। সেই আরজি শুধু সা¤্রাজ্যবাদের পক্ষে নির্লজ্জ দালালিই নয়, রীতিমত রাষ্ট্রদ্রোহ। বাংলার ‘নব জাগরণের’ এই দুই পুরোধাপুরুষ “অন্ধকারে নিমজ্জিত ভারতবর্ষীয়দের উদ্ধারে ‘শ্বেতকায় ইংরেজদের এদেশে বসতি স্থাপন, খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা ও ইংরেজি ভাষায় পাশ্চাত্য শিক্ষার’ জন্য যে সব আরজি জানিয়েছিলেন মেকলের হাতে পৌঁছেছিল সে সব দলিলও। স্বয়ং বড়লাট বেন্টিঙ্ক সেসব দলিল তুলে দেন মেকলের হাতে। মেকলে নিশ্চিত হন, ‘আধুনিক বাঙালিরা’ই ইংরেজি ভাষার শিক্ষার জন্য জোর তদবির করে চলেছেন। সেকালের কলকাতায় রামমোহন বা দ্বারকানাথের মতো অন্ধ ইংরেজ ভক্তের অভাব ছিল না। তাদের অনেকেই আবার পত্রিকা সম্পাদনা করে এইসব অভিনব মতবাদ সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে তৎপর ছিলেন।
এদেশে ইংরেজ রাজত্ব চিরস্থায়ী হোক, এমনটাই ছিল তাঁদের একান্ত মনোবাঞ্ছা। রামমোহনই প্রথম বিলেতযাত্রী ভারতীয় এবং সেখানেই তিনি ১৮৩৩ সালে দেহরক্ষা করেন। ব্রিস্টলে তাঁর সমাধিতে সৌধ নির্মাণ করে দ্বারকানাথ তাঁর নমস্য গুরুকে সম্মান জানান। ইংরেজি ভাষা চালু, সতীদাহ নিবারণ, এদেশে ইংরেজ জাতির স্থায়ী বসতি স্থাপন প্রকল্প এবং ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে রামমোহনের প্রধান সেনাপতি হন বিত্তশালী দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম
মিজানুর রহমান
বহু বছর আগে আঠারো শতকে ইঙ্গ-আইরিশ লেখক, রাজনৈতিক তত্ত্ববিদ এবং দার্শনিক এডমন্ড বার্ক বলেছিলেন ‘পার্লামেন্টের তিনটি রাষ্ট্র রয়েছে, ঐ যে দূরে সাংবাদিকদের আসন সারি রয়েছে সেটি হচ্ছে পার্লামেন্টের চতুর্থ রাষ্ট্র এবং আগের তিনটি রাষ্ট্রের চেয়ে তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ’! এডমন্ড বার্কের কবেকার সে উক্তি থেকে সংবাদপত্রের গুরুত্ব অনুধাবন করলে সহজেই বোঝা যায় যে, সংসদ ও সংবাদপত্র হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
যার নাম সংবাদপত্র সেটা কি তা তার নামই বলে দেয়। আধুনিক সংবাদপত্র সংঘটিত বিষয়ের বিবরণই শুধু পরিবেশন করে না, বরং তার ভূমিকা বিশাল ও বিচিত্র। জীবন ও জগতের সবকিছুই তার উপজীব্য। আধুনিক জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ এই সংবাদপত্র। জীবনের সঙ্গে যুক্ত যেকোনো গুরুতর বিষয়ের দার্শনিক ভিত্তি যদি শক্ত না হয় তাহলে তা দিয়ে মানুষের কল্যাণ হয় না। সংবাদপত্রের দর্শন থাকে এবং থাকে সাংবাদিকতার নৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি। তাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সংবাদপত্রের ভূমিকা অসামান্য। শুধুমাত্র খবর জানার জন্য সীমাবদ্ধ থাকেনি এর ব্যবহার, সংবাদপত্র কালে কালে হয়ে উঠেছে মেধা-জ্ঞান বিকাশের সিঁড়ি, নির্মল বিনোদনের উপাদান, এমনকি জনগণের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হিসেবেও সংবাদপত্রের ভূমিকা শীর্ষেই।
বাংলা ভাষায় প্রথম দৈনিক পত্রিকা ছিল শ্রী ঈশ্বরগুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’। সংবাদ প্রভাকর ১৮৩১ সালে প্রথম সাপ্তাহিক হিসেবে, পরে ১৮৩৯ সালে দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’ ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। এই বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় রংপুর জেলা কুন্ড্রী পরগণার বিদ্যোৎসাহী জমিদার শ্রী কালীচন্দ্র রায় চৌধুরীর অর্থানুকূল্যে।
অদ্যাবধি অজ¯্র সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়ে এদেশের মানুষকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ও বিপ্লবের পথে পরিচালিত করেছে। ধীরে ধীরে সংবাদপত্র হয়ে উঠেছে দৈনন্দিন জীবনের তৃতীয় নয়ন। এর মাধ্যমে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে পৃথিবী। সংবাদপত্রের প্রধান কাজ সমাজ জীবনের নানা ত্রুটি বিচ্যুতি পর্যালোচনা করে পথনির্দেশ করা। এজন্যই সংবাদপত্র চতুর্থ রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের চোখ। এ চোখ দিয়েই সরকার তথা রাষ্ট্র সমাজের অনেক ভেতর পর্যন্ত দেখতে পায়।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নাগরিকের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ক্রমাগত যুক্তিগ্রাহ্য, মানবিক ও কল্যাণকর হবার অব্যাহত প্রচেষ্টার মাঝেই নিহিত আছে সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে মানুষের আদি আকাঙ্খা। জনমানসে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে নাগরিক বোধ, ক্রমশ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে সার্বভৌমত্বের ধারণা। আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের সাথে যুক্ত হয়েছে গণমাধ্যম, যা কার্যত রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। প্রকৃত গণতন্ত্র তথ্য অধিকারকে নিশ্চিত করে, যা জনগণকে তথা রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে। গণতন্ত্রে অবাধ তথ্যপ্রবাহ আইনের দ্বারা অধিকারকে নিশ্চিত করে। মত প্রকাশের অধিকার যে কারণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অধিকার, যা ‘ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটসের ১৯ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশই স্বাক্ষর করেছে এখানে।
সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশে সংবাদপত্র নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়েছে। ক্রমেই মানুষের ভাবনা-চিন্তা, ধর্ম, রাজনীতি ও আদর্শের বাহনে পরিণত হয় প্রিন্ট মিডিয়া। ‘মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ কথাটি লাভ করে নতুন ব্যঞ্জনা। ঔপনিবেশিক আমল এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সংবাদপত্রে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রাধান্য সুস্পষ্ট ছিল। আবার সরকার বা সরকারবিরোধী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা বা জনমত সংগঠনে সংবাদপত্রের প্রচ্ছন্ন বা প্রকাশ্য প্রবল ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে যুগ নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পাকিস্তান শাসনামলে দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ, জনপদ, অবজারভার যেভাবে বাঙালির অন্তর্গত চেতনার স্ফুরণ ঘটিয়েছিল এবং গণমাধ্যমের মহত্ত্ব, সক্ষমতা ও জনসম্পৃক্ততা যেভাবে একটি জাতিসত্তার বিকাশে ইতিহাস-নির্ধারণী ভূমিকা রেখেছিল, তা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জয় বাংলা, বাংলার বাণী, সংগ্রামী বাংলা, মুক্তবাংলা, জাগ্রত বাংলার মতো অনেক পত্রিকা কখনও মুক্তাঞ্চলে, কখনও প্রবাসে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী জনতাকে যেভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মাতৃভূমির মুক্তির জন্য শহীদুল্লা কায়সার, নিজামুদ্দিন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, সিরাজউদ্দিন হোসেন ও গোলাম মুস্তফার মতো মহৎপ্রাণ গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের মহান আত্মত্যাগ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে। এই জাতি-রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পথে শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে আত্মোৎসর্গের এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। আমাদের গৌরবময় সর্বাত্মক জনযুদ্ধের প্রকৃতি, ব্যাপ্তি ও চরিত্র, অনাগত সময়ে সমাজ গবেষকদের যথেষ্ট উপাদান জুগিয়ে চলবে- এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা কতটা গণতান্ত্রিক, কতটা বিরুদ্ধমত সহনীয়, তা পরিমাপের মাপকাঠি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। গণতান্ত্রিক চর্চাকে নিশ্চিত করতে হলে মতের বহুত্ব, পথের ভিন্নতা, আচরণিক বৈচিত্রের প্রতি সম্মান দেখাতে হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য। সমালোচনা বন্ধ হলে গণতন্ত্র সৌন্দর্য হারাবে, বিকল্প অশুভ প্রবাহ চালু হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। তাই সরকার শুধু ভিন্নমতকে সহ্য করবে তাই নয়, বরং নিরাপত্তাও দেবে। গণতন্ত্রের এই প্রহরীকে রক্ষা করা জীবন্ত ও প্রাণবন্ত সমাজের অস্তিত্বের জন্য ভীষণ জরুরি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সামরিক এমনকি গণতান্ত্রিক সরকারও কখনও কখনও মুক্তচিন্তার প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করেছেন। অনাকাঙ্খিত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বা বিধিনিষেধ বাস্তবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে গুরুতরভাবে আঘাত করে। মনে রাখতে হবে সাংবাদিকের কাজ কখনোই শুধু দর্শক হিসেবে খালি চোখে যা দেখা যায় তা দেখে সাঁটলিপিকার হিসেবে তা লিখে পাঠকের কাছে তুলে ধরা নয়। দৃষ্টির আড়ালে থাকা ছবি আলোয় নিয়ে আসা, সব ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তুলে ধরাটাই বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে এবং কোনো ধরনের সুবিধার বিনিময় না করে স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতির আলোকে এসব দায়িত্বপালনই সংকটের সময়ে সংবাদমাধ্যমের জন্য অনেক জরুরি কাজ। সংকটকালে ক্ষমতাধরদের জবাবদিহির জন্য সম্পাদকীয় স্বাধীনতার অপরিহার্যতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাঠকের তথা জনগণের হয়ে ক্ষমতাধরদের, তা সে হোক সরকার, প্রশাসন কিংবা সমাজপতি সবার কথা ও কাজের অসংগতির ব্যাখ্যা খোঁজার চেয়ে বড় জনস্বার্থ আর কিছু নেই।
তারপরও খুব মজার ব্যপার হচ্ছে, পাঠক মূলত সেই খবরগুলোকেই গ্রহণ করে, যা তারা গ্রহণ করতে চায়। এভাবে নিজেদের অজান্তে ও অগোছালো ভাবনার প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা মতামতকেই তারা পুষ্ট করে চলে নীরবে, নিভৃতে। নিজের আবেগের কাছে নিজের পরাজয়কেই প্রতিনিয়ত নিশ্চিত করে চলে। মানুষের জৈবিক প্রবণতার আরেকটি অদ্ভুত দিক হলো-পাঠক বা শ্রোতা অনেকেই বস্তুমুখী সত্য খবর পছন্দ করেন না। নিজের পছন্দের কাগজ থেকে নিজ মতাদর্শের পাথেয় জোগাড় করে নেন। কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে বস্তুনিষ্ঠতা কী হবে, তা নিজস্ব ধারণা, মত ও গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই তৈরি করতে চান। বিশ্লেষণ বস্তুনিষ্ঠ হলেও মতের মিল না ঘটলে পাঠক তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। এখানেই চ্যালেঞ্জ এসে যায় নিরপেক্ষ গণমাধ্যমের টিকে থাকার প্রশ্ন। একদিকে প্রিন্ট উপকরণের ব্যয়বৃদ্ধি, সংকুচিত বিজ্ঞাপনের বাজার, সোশ্যাল মিডিয়ার উল্লম্ফন আর অন্যদিকে সাংবাদিকতার পেশাগত নৈতিকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীলতার মূল্যবোধকে আঁকড়ে থাকা হয়ে যায় সুকঠিন। এ পরিস্থিতিতে সস্তা জনপ্রিয়তা বা মুনাফার আশায় পত্রিকা আপোস বা সমঝোতা করলে সমষ্টিগত ধারণার গতিমুখ পাল্টে যায়। এক পর্যায়ে পাঠক বস্তুনিষ্ঠতার অভাবে পত্রিকা পাঠে আগ্রহ হারায় এবং সমাজের তাতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়ে যায়।
পাকিস্তান শাসনামলে এক সময় মিথ্যা খবর ছড়িয়ে দিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামার পরিস্থিতি উসকে দেয়া হয়েছিল। এ সম্ভাব্য মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবদুস সালামসহ তারকাতুল্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে রয়ছে। ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’- তৎকালীন একাধিক শীর্ষ জাতীয় দৈনিকে এমনই আবেগঘন বলিষ্ঠ উচ্চারণ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিলকে সত্যি সত্যিই রুখে দিয়েছিল। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বা অতীতেও আমরা দেখেছি- কল্যাণকর ভাবনায়, সৎ ও নির্ভীক সাংবাদিকতায় সত্যকে তুলে ধরতে গিয়ে অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন এসএম আলাউদ্দিন, সাইফুল আলম মুকুল, শামসুর রহমান, গৌতম দাস, মানিক সাহা ও হুমায়ুন কবির বালু সহ অনেক সংবাদকর্মী।
এই মুহুর্তে বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর করোনা ভাইরাসের ছোবলে বহুমুখী সংকটের বাস্তবতায় প্রিন্ট মিডিয়া কার্যত নিষ্প্রভ, কোণঠাসা, অসহায়। অনেকটা অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে নিজের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে চলা, পেশাদারিত্ব প্রমাণ করা এবং জনমানসে নিরপেক্ষতার ধারণাকে বাঁচিয়ে রাখা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য বিষয়। মুক্তমনে, নির্মোহ দৃষ্টিতে কোনো বিষয়কে বিশ্লেষণ করার সততা, সাহস ও পেশাদারিত্ব এখন সুকঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিরপেক্ষতার ধারণা যদিও আপেক্ষিক এবং তা বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শ্রেণিভিত্তিক সূচকের ওপর নির্ভরশীল। তবুও নৈতিক দৃঢ়তা ও সত্যের সঙ্গে নিবিড়তা, তথ্য পরিবেশনে মান বজায় রাখতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। এই নৈতিক স্থিতি পাঠকের কাছে খুবই স্পর্শকাতর বিষয়, কারণ যে ঘটনাকে ভিত্তি করে সংবাদ প্রকাশ করা হয়, তার সত্যতা পাঠকের কাছে স্থায়ীভাবে আড়াল করা সম্ভব হয়না। সংবাদের উপস্থাপন, অগ্রাধিকার নিরূপণ, গুরুত্ব আরোপ বা বাছাই করার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে পত্রিকার নীতিগত কৌশল, সততা কিংবা দায়িত্বশীলতার অঙ্গীকার। এই কাজটি বর্তমান আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় খুব সহজ কাজ নয়। মফস্বল সংবাদপত্রের জন্য তা আরো বেশী কঠিন। সমকালীন বিশ্বব্যবস্থা, ভূ-রাজনীতি, জটিল আর্থ-সামাজিক সমীকরণ ও প্রযুক্তির জয়োৎসবের যুগে একটি মফস্বল সংবাদপত্রের দীর্ঘদিন টিকে থাকাটা তাই যথেষ্ট গৌরবের।
যশোরের দৈনিক লোকসমাজ গৌরবের ২৫ বছরে পদার্পণ করছে। বিভিন্ন সময় ও প্রেক্ষাপটে এ প্রতিষ্ঠানটিকে নানা প্রতিকুল পরিবেশের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এতদসত্বেও একথা ভাবার সঙ্গত কারণ রয়েছে যে, লোকসমাজ সংবাদ পরিবেশন, বাছাই ও সংবাদ বিশ্লেষণে তার পাঠকদের কাছে গ্রহনীয় থেকেছে এবং তার পাঠকের আস্থাকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
অভিনন্দন লোকসমাজকে। সে সাথে প্রত্যাশা- লোকসমাজ বস্তুনিষ্ঠতা ও নৈতিকতা নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর এই শুভক্ষণে অযুত শুভকামনা লোকসমাজ পরিবারের প্রত্যেকের জন্য।