২৪ তম প্রতীষ্ঠাবার্ষিকীর বিশেষ সংখ্যার একগুচ্ছ লেখা–৩

0
শিক্ষার্থীদের শাসিয়ে মাউশির ৬ দফা ফরমান
রাজেকুজ্জামান রতন
নির্দেশ জারি করে ক্ষমতা প্রদর্শন করার প্রবণতা অনেক পুরনো। রাজকীয় ফরমান ছিল সব যুক্তির ঊর্ধ্বে, রাজার ইচ্ছাই সেখানে ছিল আইন। রাজার ইচ্ছায় দেশ চলবে নাকি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে আইনে এই বিতর্ক থেকেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল। আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামেরও মূল চেতনাতে তাই ছিল। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সেই অবিস্মরণীয় প্রতিবাদী গান, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’, বাঙালি জাতিকে প্রতিবাদমুখর করে তুলেছিল। মুখের ভাষা আর মনের ভাব প্রকাশের জন্য সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছিল চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা নামে ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে।
আইনপ্রণয়নের সংস্থার নাম জাতীয় সংসদ। বাংলাদেশের সংসদে আইন প্রণয়নের জন্য মাত্র ৯ শতাংশ সময় ব্যয় করলেও দ্রুতগতিতে আইনপ্রণয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবচেয়ে এগিয়ে। একটি আইন পাস করতে সময় লাগে মাত্র ৩২ মিনিট, যেখানে ভারতে লাগে ১৮৬ মিনিট। তারপরও আইনের বাইরে ফরমান যে কত জারি হয়, তার ইয়ত্তা নেই। এ রকম একটি ফরমান জারি করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ৭ অক্টোবর, ২০২০ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার-সংক্রান্ত এক নির্দেশনা জারি করেছে। একটা দারুণ ভূমিকার অবতারণা করে তারা বলেছেন, ‘যুগোপযোগী ও আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার পাঠদান এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অনেক ভূমিকা পালন করা হয়।’ এটুকু পড়ে হতবাক হয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন’-এ অনেক ভূমিকা পালন করা হয়, তাই কি? যেকোনো নীতি প্রণয়ন করতে গেলে বিতর্ক অবশ্যম্ভাবী। তাহলে স্বীকার করে নেওয়া হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্ক করা হয়। বিতর্ক মানে বিপরীত মতপ্রকাশের সুযোগ থাকা। নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তাহলে ঘাটতি দুর্বলতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা করা হয় এবং এর মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ কাজটাও করা হচ্ছে তাহলে। এ পর্যন্ত আলোচনা করলে মনে হবে যে, এত চমৎকার ও গণতান্ত্রিক একটি ফরমানের জন্য বিশ্বদরবারে আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চা একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। জীবনের আনন্দগুলো বড়ই ক্ষণস্থায়ী। উচ্ছ্বাস কেটে গিয়ে এই আনন্দ আতঙ্কে রূপ নিতে বাধ্য পরের ছয়টি দফা নির্দেশনা পড়লে। ‘ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য নিম্নে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার-সংক্রান্ত কিছু নির্দেশনা প্রদান করা হলো’ এই বাক্যের পরে যে ছয়টি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, তা যতটা না ‘সচেতনতা’ সৃষ্টির জন্য, তার চেয়ে বহু গুণ বেশি ‘সতর্কবার্তা’ দেওয়া জন্য তা বুঝতে কারও অসুবিধা হবে না। আক্কেলজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের জন্য নাকি ইশারাই যথেষ্ট!
এক নম্বর নির্দেশনাটা একমাত্র নির্দেশনা হলে আর কোনো নির্দেশনা জারি করার প্রয়োজনই ছিল না। বলা হয়েছে, ‘সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে সরকার বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় এমন কোনো পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, লাইক, শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।’ এই নির্দেশনা থেকে কি মনে হয় এটা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কোনো সার্কুলার? রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মহলের প্রতি কোনো ভরসা কি তারা রাখতে পারছেন না, নাকি ফরমান জারি করার এক প্রচণ্ড আকুলতা তাদের মধ্যে কাজ করছে? ফেইসবুকে কী লিখলে কী হয়, তা কি দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করছেন না? আমাদের রাষ্ট্রটাকে একটা ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠান ভেবে তারা কি খুব সাবধানে কথা বলতে বলছেন, যাতে কোনোভাবেই ভাবমূর্তি নষ্ট না হয়? পরের বাক্য তো আরও সতর্কবাণী দিচ্ছে। ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনো সার্ভিস বা পেশাকে হেয়প্রতিপন্ন করে এমন কোনো পোস্ট দেওয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে।’ বুঝে নিন এবার! দুর্নীতি করলে, ভুল সিদ্ধান্ত দিলে তার ব্যাপারে কিছু লিখলে যদি সেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হেয়প্রতিপন্ন হন, তাহলে কিন্তু বিপদ আছে!
দুই নম্বর নির্দেশনাটাও কম ভয়ানক নয়। রাষ্ট্র কি ভয় পাচ্ছে যে ছাত্ররা এমন কিছু লিখতে পারে, যা জাতীয় ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থী? তার জন্যও তো আইন আছে। কিন্তু না, মাউশিকেও বলতে হলো ‘জাতীয় ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থী কোনো রকম তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।’ আচ্ছা, তিন ধারার শিক্ষা যা চালু আছে, তা কি জাতীয় ঐক্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? তাহলে শিক্ষার্থীর মনে যদি এমন প্রশ্ন জাগে এবং সে যদি ফেইসবুকে তা নিয়ে লেখে, তাহলে কি তা অপরাধ হবে? ‘কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে বা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পরিপন্থী কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা যাবে না’ এই বাক্যটি পরস্পরবিরোধী হয়ে গেল না? ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও তো দেখি অনেকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে, তখন কী হবে? ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে এমন কোনো পোস্ট, ছবি, অডিও, ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে’ এ কথা কে বলছেন, কার উদ্দেশে বলছেন! এটা দেখার দায়িত্ব কার? আমাদের দেশে সংখ্যালঘুর ধর্মীয় অনুভূতি বলে কিছু নেই, সব সময় সংখ্যাগুরুরা অনুভূতিতে আঘাত পান এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে এটাই তো দেখে আসছে জনগণ এত দিন। মিথ্যা প্রচারে আক্রান্ত হয়েছে সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বহুবার। কোনো বিহিত কি হয়েছে? আবার নতুন সার্কুলার মাউশিকে দিতে হচ্ছে কেন?
তিন নম্বর নির্দেশনা নিয়ে কোনো কথা নেই। ব্রিটিশ, পাকিস্তান আমলেও এ কথা শুনেছে, এ ধরনের আইনের প্রয়োগ দেখেছে মানুষ ‘ জনমনে অসন্তোষ বা অপ্রীতিকর মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে এমন কোনো বিষয় লেখা… তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে।’ অসন্তোষ বা অপ্রীতিকর মনোভাবের ব্যাখ্যা কী, তা নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে কথা বললে তা কতখানি প্রীতির সঙ্গে ক্ষমতাসীনরা গ্রহণ করে, তা তো আমরা জানি। আর এসব জেনে যদি কেউ বিক্ষুব্ধ হন, তাহলে কী হবে! আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন শাখা এসব নিয়ে ব্যস্ত আছে। তারপরও মাউশির এসব নির্দেশনা দেখে একটা কথাই মনে হয়, এটা কি তাদের কাজ? এ দেশে কার কাজ কে করে! এভাবে চার, পাঁচ ও এরপর ছয় নম্বর নির্দেশনায় এসবের ব্যত্যয় হলে ‘অন্যথায় অ্যাডমিন ও পোস্টদাতা উভয়েই সরকারিবিধি অনুযায়ী অভিযুক্ত হবেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ শিক্ষকরা তো চাকরিবিধি অনুযায়ী একটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকেন, তাহলে এ কথা কার জন্য? উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র যারা ভাবতে শিখছে, বুঝতে শিখছে, তাদের বুঝিয়ে দাও তুমি কতখানি শৃঙ্খলিত। সবশেষে বলা হয়েছে ‘এমতাবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো ধরনের শৃঙ্খলা পরিপন্থী ও অপ্রীতিকর কার্যকলাপ যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’ যাক! এখন থেকে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা নিরাপত্তা পুলিশের মতো দায়িত্ব পালন করবেন। এমনিতেই শিক্ষাদান করা ছাড়া সব কাজই তাদের করতে হতো, এখন সাইবার পুলিশের দায়িত্বও তারা পালন করবেন। কড়া নজরে রাখবেন ছাত্রদের।
সীমিত গণতন্ত্র আর কর্তাব্যক্তিদের অসীম ক্ষমতার এ দেশে এমনিতেই বাক্স্বাধীনতা আইনের দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে আছে। নতুন নতুন আইন হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে ক্ষমতাসীনদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত হচ্ছে। এখন তরুণদের বুঝিয়ে দেওয়া হবে, তোমার স্বাধীনতার সীমা কতদূর। শাসকদের ইচ্ছা যতখানি, তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ততখানি। ভাবমূর্তি রক্ষার নামে তোমার মনের ভাব শৃঙ্খলিত হবে, তুমি মূর্তির মতো নিশ্চল থাকতে শেখো। এর সাময়িক সুফল পাওয়া যাবে কি না, তা অনিশ্চিত কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী মানসিক পঙ্গুত্ব অবধারিত।
ময়লায় উপচে পড়া দুর্গন্ধময় ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে যেতে নাকে হাত চলে আসে সবার। কিন্তু ময়লা পরিষ্কার না করে নাক বন্ধ করাটা কোনো কার্যকর সমাধান নয়। রাষ্ট্র ও সমাজের নানা অসংগতি নিয়ে ছাত্ররা কথা বলবে, লিখবে, বিতর্ক করবে, তবেই না পরিবর্তনের মনন গড়ে উঠবে! এই সার্কুলার সেই মনন গড়ে তুলতে এক প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
সহজ বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ কি আমাদের সহজাত? যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেয়ে শক্তি দিয়ে দমন কড়া সহজ। যারা নিজেদের শক্তিশালী বলে মনে করেন এবং প্রচার করতে ভালোবাসেন, তাদের মধ্যে অন্যের কষ্টের অর্জন ভোগ করা, দুর্বলের ওপর শক্তি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে আগ্রহ খুবই বেশি। এটা খুবই সহজ। কিন্তু তারা সমালোচনায় শুধু বিরক্তই হন তা-ই নয়, ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। সমালোচনাকারীকে শাস্তি দিতে ব্যগ্র হয়ে পড়েন। প্রশ্ন ওঠে, যদি তারা সঠিক এবং শক্তিশালীই হন, তাহলে সমালোচনায় এত বিচলিত হন কেন? ফরমান জারি করে মতপ্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতা তাদের তৈরি হলো কেন? ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হলে আইন ভঙ্গ হয় এই ধারণা গণতন্ত্রের ভিত্তিতে ভাঙন ধরায় না কি? অতীত তো তাই বলে। [ সংকলিত ]
লেখক রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামনিস্ট
‘খুঁটির জোরে ছাগল নাচে!’
রেজানুর রহমান
কী মারাত্মক স্বীকারোক্তি। একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য স্বয়ং স্বীকার করলেন তার এলাকায় একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী আছে। নোয়াখালী-৩ আসনের এই সাংসদের নাম মামুনুর রশীদ কিরণ। কোনও প্রকার রাখঢাক না করেই তিনি তার এলাকার সন্ত্রাসী বাহিনীর নাম বলে গেলেন। দেলোয়ার বাহিনী, সম্রাট বাহিনী, সুজন বাহিনী, কাশেম বাহিনী, আলাউদ্দিন বাহিনী…আরও কত নাম! একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে নামগুলো বললেন ওই সাংসদ। তিনি একজন মানবাধিকার নেতাও বটে। তার সহজ সরল স্বীকারোক্তি একদিকে যেমন আশা জাগিয়েছে, অন্যদিকে তেমনই আতঙ্কও ছড়িয়েছে। একজন সাংসদ হলেন দেশের নির্ধারিত এলাকার অভিভাবক। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে একজন সাংসদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। অথচ তিনিই যদি প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনীর নাম বলে নিজ দায়িত্ব এড়িয়ে যান, তাহলে কী বার্তা পাই আমরা?
বার্তাটা খুবই পরিষ্কার। একজন মাননীয় সাংসদের মুখে একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনীর নাম উঠে আসা মানে এক ধরনের অসহায়ত্ব প্রকাশ হওয়া। ব্যাপারটা যদি এমন হতো, সাংসদের মুখে সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর নাম উঠে আসার পর তারা অর্থাৎ বাহিনীগুলো ভয় পেয়েছে। অথবা সঙ্গে সঙ্গে বাহিনীগুলোর ওপর অ্যাকশন অর্থাৎ নজরদারি শুরু হয়েছে। কিন্তু সে রকম কিছুই ঘটেনি। বরং সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো আরও বেশি উৎসাহিত হয়েছে। সাংসদের মুখে তাদের নাম উঠে আসা মানেই ফ্রি পয়সায় বড় বিজ্ঞাপন। এতদিন হয়তো অনেকেই সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর নাম জানতো না। এখন জেনে গেলো! ফ্রি বিজ্ঞাপনে উপকার পেলো সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো। ভবিষ্যতে তাদেরকে হয়তো মুখ ফুটে চাঁদা চাইতে হবে না, জোর করে কারও জমি দখল করতে হবে না। এলাকার কোনও সুন্দরী মেয়েকে তাদের পছন্দ হয়েছে, ব্যস সহজেই উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কেউ হয়তো সাহস করে প্রতিবাদও করবে না। কারণ স্বয়ং মাননীয় সাংসদ এই সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর নাম বলেছেন। তার মানে এরা অনেক পাওয়ারফুল।
হ্যাঁ, বর্তমান সময়ে এই সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোই অনেক ‘পাওয়ারফুল’। শহরে তো বটেই গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। এরা কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য। বিশেষ করে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলে ভিড়ে যায়। দলের নীতি আদর্শের ছিটেফোঁটাও জানে না। শুধু জানে নেতা-নেত্রীর নাম। দিতে পারে শ্লোগান। আর যদি ভালো বক্তৃতা দিতে পারে তাহলে তো কথাই নেই। যেন সোনার টুকরো ছেলে। তবে সন্ত্রাসী ক্যাডার হতে পারলে গুরুত্বটা আরও বাড়ে। কাজ তো তেমন কিছুই না। চোখে থাকবে সানগ্লাস। পরনে জিন্সের প্যান্ট, শার্ট অথবা টিশার্ট। পায়ে দামি জুতা! নেতার আগে পিছে ছায়ার মতো থাকতে হবে। নেতাকে প্রটেক্ট করতে হবে। নির্ধারিত এলাকায় নেতা যাওয়ার আগেই যমদূতের মতো এলাকায় হাজির হতে হবে। যাতে এলাকার লোক ভয় পায়। যে যত ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে সে তত বড় ক্যাডার। নেতার আপন মানুষ। হরিহর আত্মা। নেতার কাছে হরিহর আত্মা হয়ে ওঠা সন্ত্রাসীরাই এক সময় কোনও না কোনোভাবে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী তৈরি করছে। এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে উঠছে। এদের প্রধান কাজই হলো কোনও না কোনোভাবে স্থানীয় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের নেতানেত্রীর সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করা। তাদের সঙ্গে ছবি তোলা। এবং এই ছবিকেই প্রভাব বিস্তারের খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা।
প্রতিটি রাজনৈতিক দল শেকড় পর্যায়ের রাজনীতিকে এখন গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে শেকড় পর্যায়ের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পরিচয় পেতেই সবার আগ্রহ। এখানে আদর্শের বালাই নেই। দলের নীতি ও আদর্শ নিয়ে কারও মাথা ব্যথাও নেই। যত পারো দলের লোক জড়ো করো। দলে ভেড়াও। দল ভারী করো। হ্যাঁ, দল ভারী হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এতে দলের কোনও লাভ হচ্ছে না। দলীয় পরিচয় পেয়ে সেটাকে দলের চেয়ে নিজের আখের গোছানোর কাজে লাগাতেই ব্যস্ত হচ্ছে অধিকাংশরাই। অতীতকালে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল মূলত শহরে। এখন শহরের চেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চর্চা শুরু হয়েছে। কোনও না কোনোভাবে দলের নেতা হতে পারলেই সামনের ভবিষ্যৎ ঝরঝরা। অর্থাৎ পরিষ্কার। সে কারণে দলের নেতা হওয়ার দৌড়ে সবাই ব্যস্ত। একবার নেতা হতে পারলেই আর পায় কে? কিসের নীতি, কিসের আদর্শ? কিসের আইন। সবই তো নেতার হাতে। সে যত ছোটো নেতাই হোক, যদি থাকে কূটবুদ্ধির যোগ্যতা তাহলেই কেল্লাফতে।
একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, আগের দিকে গ্রামের রাস্তাঘাটে নেতা-নেত্রীর ছবি দেখা যেতো না। এখন গ্রামের রাস্তাঘাটেই নেতা-নেত্রীর ছবিওয়ালা ব্যানারই বেশি। বড় ব্যানার, ছোট ব্যানার, ঢাউস আকারের ব্যানারে এলাকা সয়লাব। অধিকাংশ ব্যানারের ওপরের দিকে দায়সারাভাবে জাতীয় পর্যায়ের নেতা-নেত্রীর ছবি থাকে। নিচে থাকে স্থানীয় নেতার বড় ছবি। একজনের দেখাদেখি অন্যজন প্রতিযোগিতা করে ছবিওয়ালা ব্যানার টাঙিয়ে রাখে। অনেক সময় ব্যানার টাঙানো নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। জাতীয় পর্যায়ের নেতা-নেত্রীর সঙ্গে নিজের তোলা ছবি থাকলে ব্যানারে সেই ছবিতেই গুরুত্ব দেয় অনেকে। এতে নাকি প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ে। জাতীয় পর্যায়ের নেতা-নেত্রীর সঙ্গে ছবি থাকলে পাওয়ার খাটানোর ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়, এমনটাই বললেন গ্রামের একজন শিক্ষক।
বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা। গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আগে ছিল কাঁচা সড়ক। এখন সড়ক পাকা হয়েছে। দ্রুতগতির যানবাহনও বেশ শব্দ করে যাওয়া আসা করে। গ্রামের সড়ক পথে যতই হাঁটছি ততই অবাক হচ্ছি। কিছুদূর অন্তর অন্তর বড় গাছ অথবা কোনও স্থাপনায় শুধুই ব্যানার আর ব্যানার। ব্যানারে জাতীয় নেতা-নেত্রীর ছবি ওপরে রেখে নিচে স্থানীয় নেতাকর্মীর বিশাল বিশাল সাইজের ছবি স্থান পেয়েছে। অধিকাংশ ব্যানারে বানান ভুল। একটি বিশাল ব্যানারে একজনের ছবি দেখে একটু অবাক হলাম। ছবির ছেলেটি লেখাপড়া জানে না। এলাকায় বখাটে হিসেবে পরিচিত। জাতীয় পর্যায়ের এক নেতার সঙ্গে তোলা তার একটি ছবি ব্যানারে স্থান পেয়েছে। ওই একটি ছবিই তাকে এলাকায় নেতা বানিয়েছে। চাঁদা আদায় আর অন্যের জমি দখল করা তার মূল কাজ। সে নাকি ধর্ষণ মামলার আসামিও। অথচ দাপট দেখিয়ে বেড়ায় এলাকায়।
এখন প্রশ্ন হলো একজন অশিক্ষিত সন্ত্রাসী তরুণ এলাকায় এভাবে দাপট দেখিয়ে বেড়ানোর সাহস পায় কোত্থেকে? গত কয়েকদিন ধরে বেগমগঞ্জে গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে বেশ তোলপাড় চলছে। ঘটনার হোতা দেলোয়ার হোসেন তেমন কিছুই করে না। এক সময় সিএনজি চালাতো। সে-ই এখন হয়ে উঠেছে একটি সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান। তার উত্থানের কাহিনি অনেক চমকপ্রদ। স্থানীয় নেতাদের ‘চামচাগিরি’ করতে করতেই সে এখন সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান! এলাকার এমপি থেকে শুরু করে এমন কোনও নেতা নেই যার সঙ্গে তার ছবি নেই। এসব ছবির কল্যাণে সে ধীরে ধীরে ভয়ংকর সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়েছে। সে অপরাধ করলেও গ্রামের অসহায় মানুষ মুখ ফুটে কিছু বলে না। প্রতিবাদ করে না। তাদের একটাই ভয়, প্রতিবাদ করলেই যদি হিতে বিপরীত হয়। নেতাদের সঙ্গে যার দহরম মহরম, সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলতে তার তো সময় লাগার কথা নয়।
সিলেটে গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের কাহিনিও অনেকটা একই রকম। এক সময় নেতাদের পেছনে ঘুরেছে। জীবন বাজি রেখে অনেক অশোভন, অনৈতিক কাজে নেতাদেরকে সহযোগিতা করেছে। এভাবেই একদিন তারা ভয়ংকর সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছে।
খোঁজ নিলে দেখা যাবে দেশজুড়ে এই যে এতো সন্ত্রাসী ঘটনা বিশেষ করে ধর্ষণকাণ্ড চলছে, এর মূলে রয়েছে কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের মদত। অর্থাৎ রাজনৈতিক সাহস। বিশেষ করে সরকারি দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, বর্তমানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দলীয় পরিচয়ে সন্ত্রাসীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। একই উপজেলায় হয়তো একটি ছাত্র সংগঠনের পরিচয়ে ৩টি গ্রুপ, যুব সংগঠনের পরিচয়ে একাধিক গ্রুপ, মূল সংগঠনের পরিচয়েও একাধিক গ্রুপ সক্রিয়। ফলে পুলিশ কোন গ্রুপের সঙ্গে থাকবে, এই নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। ফলে অনেক সময় সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না।
কিন্তু প্রশ্ন হলো এভাবে আর কত দিন? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দেশের নানাস্থানে ধর্ষণকাণ্ডের দায় সরকার এড়াতে পারে না। ধর্ষণকারীদের তো বটেই পাশাপাশি প্রশ্রয়দাতাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
মাননীয় মন্ত্রীর কথায় আমরা ভরসা রাখতে চাই। কিন্তু এটা যেন কথার কথা না হয়! প্রসঙ্গক্রমে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের একটি বক্তব্য তুলে ধরতে চাই। তিনি বলেছেন, ধর্ষণ যারা করছে আমরা সেই অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি চাই। অপরাধীদের শাস্তি দেখলে তার চারপাশে থাকা মানুষগুলো সতর্ক হবে।
এটাই আসলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা। অপরাধীদের শুধু গ্রেফতার করলেই হবে না। দ্রুততার সঙ্গে বিচার সম্পন্ন করে দোষী ব্যক্তিকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ ব্যাপারে সত্যি কি আমরা আন্তরিক? একটি ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ করি। সিলেটে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের যেদিন প্রথম আদালতে তোলা হয়েছিল সেদিন তারা প্রকাশ্যে হম্বিতম্বি, দম্ভোক্তি করেছে। এমন কথাও বলেছে, কেউ নাকি তাদের কিচ্ছু করতে পারবে না? এই ধরনের দম্ভোক্তি করার সাহস তারা কোথায় পেয়েছে? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর আছে। সকলেই বোধকরি এই প্রবাদ বাক্যটা জানেন, খুঁটির জোরে ছাগল নাচে!
প্রিয় পাঠক, আশঙ্কা কী শেষ পর্যন্ত থেকেই যাচ্ছে?
[ সংকলিত ]
নারী-অধিকার ও পরিবেশ
আন্দোলন এক সূত্রে গাঁথা
বিধান চন্দ্র পাল
নারী সুরক্ষা ও মর্যাদা তথা অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন আর পরিবেশ সুরক্ষার আন্দোলন যেন এক সূত্রেই গাঁথা। দুটির মাঝে এক ধরনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির অর্জন সম্ভব নয়। একদিকে যেমন সার্বিক পরিবেশের সুরক্ষা সুস্থভাবে নিশ্চিত হলেই নারী সুরক্ষা ও মর্যাদা তথা অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে তেমনি নারীর ক্ষমতায়ন এবং সার্বিকভাবে নারী সুরক্ষা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনেরও অন্যতম পূর্বশর্ত। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতনকারী ও ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে যে এত প্রতিবাদ হচ্ছে, সকল পরিবেশকর্মী ও পরিবেশবাদীদের পক্ষ থেকেও সেটার পক্ষে পূর্ণ ও যৌক্তিক সমর্থন রয়েছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক বলে আমি মনে করি।
আমরা জানি, পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ হলো সামাজিক। এই সামাজিক পরিবেশের আওতায় পড়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের দিকটি। এই পারস্পরিক সম্পর্কও পরিবেশকে নানাভাবে বিপর্যস্ত করে। যেমন: নারী-পুরুষ উভয়ে মিলেই পরিবার ও সমাজ। উভয়ের শ্রম ও মেধার সমন্বয়েই জীবন-জীবিকা, পরিবার ও সমাজ পরিচালিত হয়। একত্রিত উদ্যোগেই সভ্যতার বিকাশ হয়। অথচ জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আমরা নারী ও পুরুষের মধ্যে অসমতা ও বৈষম্য দেখতে পাই।
বিবিসিতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, “বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৮৭ শতাংশেরই কর্মসংস্থান হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। যেখানে নারীর সংখ্যাই বেশি। শ্রম জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারীদের ৯২ শতাংশের কর্মসংস্থান এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতে। বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি চাকরি তথা আনুষ্ঠানিক খাতে নারী পুরুষের বেতন বৈষম্য অনেকটা কম হলেও অনানুষ্ঠানিক খাতে বৈষম্য এখনো অনেক বেশি।”
আবার বিশ্বব্যাংকের উইমেন, বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল ২০২০ ইনডেক্স শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে ক্লিনিং, লুব্রিকেটিং ও যন্ত্রাংশ সংযোজনের কাজে নারীদের অংশগ্রহণে আইনি বাধা আছে। অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে। (সূত্র: প্রথম আলো, ৮ মার্চ, ২০২০)
ফলে এটা সুস্পষ্ট যে, বৈষম্য বিরাজমান। এই বৈষম্য একদিকে কাজ ও দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে, সুযোগের ক্ষেত্রে, মর্যাদা ও অধিকার নিয়ন্ত্রণ কিংবা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, মতামত প্রকাশ ও পছন্দের ক্ষেত্রে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে। এটা শুধু কোন এক শ্রেণির মধ্যে নয় বরং শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষিত-স্বশিক্ষিত কিংবা নিরক্ষর, গ্রাম-শহর, বাঙালি-পাহাড়ী প্রতিটি ক্ষেত্রে ও পর্যায়েই রয়েছে। এই বৈষম্য যে শুধু আমাদের দেশেই রয়েছে তা নয়, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই এই অসমতা বিরাজমান, তবে এর মাত্রাগত তারতম্য রয়েছে। নারী-পুরুষের মধ্যেকার বিরাজিত এই বৈষম্য আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এবং সার্বিকভাবে উন্নয়নের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আর এর ফলাফল স্বাভাবিকভাবেই নারী-পুরুষ উভয়েই ভোগ করছে।
যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী বললেও বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না, নারী ও পুরুষের অসম সম্পর্কের কারণেই নানাভাবে নারীরা পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে নির্যাতিত হয়ে আসছে। নারীরা ঘরে ও বাইরে নির্যাতিত হয়েছে এবং হচ্ছে। নির্যাতন বন্ধের দাবিতে বিভিন্ন দেশে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা রয়েছে, প্রতিকারের জন্য সরব প্রতিবাদও রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতনের বৈচিত্র্য ও ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশে এখন নারী নির্যাতনের চিত্র খুবই উদ্বেগজনক। ঢাকা মহানগর পুলিশ কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য অনুসারে ২৬ মার্চ থেকে ৩ জুন, ২০২০ পর্যন্ত দুই মাস সাত দিনে শুধু ঢাকা মহানগরেই নারী-শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১৯৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৬৪টি মামলাই হয়েছে ধর্ষণের অভিযোগে (৮টি মামলা গণধর্ষণের)। যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয়েছে ৫১টি। নারী ও শিশু অপহরণের অভিযোগে এবং শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগে মামলার সংখ্যা যথাক্রমে ৩৬ ও ৭। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো ৮ জুন, ২০২০)। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যায, ২০১৯ সালে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হযেেছ ১৪১৩টি, যা তার আগের বছরের তুলনায দ্বিগুণ। (সূত্র: বিবিসি ১০ জানুয়ারি, ২০২০)
সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের বিভিন্নমুখি প্রভাবের কারণে নারী নির্যাতনের হার আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন। এই হার বৃদ্ধি পাওয়ার পুরোনো অনেক কারণ রয়েছে; যেমন: সন্ত্রাসী রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক চাপের নেতিবাচক প্রভাব, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতা ও অবনতি, মানুষের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা, উপযোগী বিনোদনের মাধ্যম কিংবা ক্ষেত্র খুঁজে না পাওয়া ইত্যাদি। সেইসাথে যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের নতুন প্রভাবসমূহ; যেমন: প্রযুক্তি ও আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে অশ্লীল ছবি, খবর এবং ভিডিও’র সহজপ্রাপ্যতা, দরকারি কিংবা প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিষয়ে যেমন: অনলাইনে কেনাকাটা, অনলাইনে পত্রিকা পড়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে অশ্লীল দৃশ্য ও প্রলোভনের হাতছানি। পুঁজিবাদী সমাজে যথেচ্ছাচারে বিভিন্ন উপকরণ কিংবা পণ্যের সাথে নারীকে অশোভনীয়ভাবে উপস্থাপন করার কথাও এর সাথে বিশেষভাবে যোগ করা যেতে পারে।
ফলে নারী নির্যাতন এখন আর স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। এই নির্যাতন এখন নিকৃষ্টতম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। আর এই নিকৃষ্টতার অন্যতম উদাহরণ ধর্ষণ। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত কোন নারীই এখন ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। আমরা জানি ধর্ষণ, এটা অন্য আর দশটা অপরাধ থেকে একটু ভিন্ন। কারণ এটা নারীর শরীর, স্বাতন্ত্র্যবোধ, আত্মমর্যাদাবোধ ও সত্তার ওপর আঘাত হানে। এখানে নারী এই অপরাধের শিকার হয়ে যাবার পর তাকে পারিবারিকভাবে করুণার চোখে দেখা হয়, সামাজিকভাবে বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখিন হতে হয়, তার ওপর কলঙ্ক লেপে দেয়া হয় এবং এই একটি ঘটনার জন্য তাকে সারাজীবন নানা রকমের সামাজিক গঞ্জনাও মেনে চলতে হয়। অথচ এই ঘটনার জন্য সেই নারী কোনভাবেই দায়ী নয়। সুতরাং পরিবার ও সমাজের এসব নানামুখি দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনাই গোপন থেকে যায়, স্বাভাবিক কারণে থানাতেও ধর্ষণের অভিযোগ কম আসে।
আবার অন্যদিকে আইনি প্রক্রিয়াটিও নারীর জন্য খুব সহায়ক নয়। সেজন্য অনেক মামলাই আদালত পর্যন্ত যেতে পারে না। আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার মতো ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্যে অনেকে যেতে অনাগ্রহ পোষণ করেন। আবার পরিবার থেকেও এসব ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়। থানায় যাওয়া, মেডিক্যাল পরীক্ষা করানো, আদালতে দাঁড়ানো এ সবকিছুই নারীর জন্য এক কঠিন পরীক্ষার মতো একটা বিষয়। এ অসহনীয় পরীক্ষার মুখোমুখি হতে না চাওয়াটাই স্বাভাবিক, ফলে বেশিরভাগ নারীই নীরব ও নিশ্চুপ হয়েই থেকে যায়। কারণ আইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়াকে অনেকেই দ্বিতীয়বার ধর্ষণের শিকার হওয়ার সামিল বলেই গণ্য করেন।
এই ধরনের একটি প্রেক্ষাপটে ধর্ষণকারী সহজে রেহাই পেয়ে যান অন্যদিকে তেমনি সমাজে জন্ম নেয় আরেকটি ধর্ষণের সমূহ সম্ভাবনা। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইনের খসড়া অনুমোদন করায় ধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতম সামাজিক অপরাধের অবসান হবে কি-না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। একইসাথে শুধু এই সাজা যোগ হবার কারণে (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩৪টি ধারার মধ্যে ৭টি ধারায়, মৃত্যুদণ্ডের বিধান আগেই আছে। সূত্র: প্রথম আলো ১৩ অক্টোবর, ২০২০) ধর্ষণকারীরা শাস্তির ভয়ে আর ধর্ষণ করবে না- এটা ভাবাটা অমূলক হবে। ফলে এটা সুস্পষ্ট যে, এর মধ্য দিয়ে মূল সমস্যার সমাধান আসলে হবে না।
মিডিয়ায় চোখ মেলে দেখলেই আমরা বুঝতে পারি যে, সমস্যাটা আসলে বাড়ছে। ফলে এই সমস্যা শুধু নারীদের সমস্যা হিসেবে ছোট করে বা খাটো করে দেখাটা মোটেও ঠিক হবে না। আমি বলব, এটা সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতির বিচারে বিরাট এক সমস্যা, অনেক বড় হুমকি। এটা নিয়ে নানামুখি গবেষণা করে সমাধানের সুষ্ঠু পথ উন্মোচন করাটা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে নিকৃষ্ট এই কাজের মধ্য দিয়ে সামাজিক পরিবেশ নানাভাবে বিঘ্নিত হতেই থাকবে। সামাজিক পরিবেশ কি পরিমাণে কলুষিত ও নোংরা হচ্ছে এবং কত মানুষ ও বিশেষভাবে ভবিষ্যত প্রজন্ম যে অমানুষে রূপান্তরিত হচ্ছে, জঘন্য ও কুৎসিত মানসিকতার মানুষজনের সংখ্যা যে ক্রমশই বাড়ছে, তা যদি এখনই আমরা থামাতে না পারি, তাহলে তা ভবিষ্যতের জন্য বড় কলঙ্কজনক এক অধ্যায় রচনা করবে- এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এর পাশাপাশি পরিবেশ ধ্বংস বা দূষণের কারণে কী পরিমাণ নারী শিশু, সার্বিকভাবে নারীর স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়েও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নির্ভরযোগ্য গবেষণা হওয়াটা জরুরি।
ফলে সংশ্লেষিত সবার মতামত নিয়ে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার (তদন্ত, বিচারপ্রক্রিয়া ইত্যাদি) নিশ্চিত করাটা এখন একান্ত জরুরি। জরুরি আইনের প্রতি মানুষের পূর্ণ আস্থা ফিরিয়ে আনা।
পরিবেশগতভাবে একটি সুস্থ সমাজ নিরূপণের মাপকাঠি যদি হয় সমাজের নারীর সুরক্ষা কিংবা নিরাপত্তা। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশের সমাজ আসলে এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র- বাংলাদেশ। লাখো শহীদের তাজা রক্ত, আপামর জনসাধারণের বহু ত্যাগ ও তিতিক্ষার ফসল আমাদের এই দেশ। এর রয়েছে দীর্ঘ এক সংগ্রামের ইতিহাস। এই সংগ্রামের সাহসী সৈনিক হিসেবে এদেশের নারী সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সবসময়, সবক্ষেত্রে। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণ আদৌ কি সম্ভব হয়েছে?
যে স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল সেই গণতন্ত্র, পরিবেশসহ সবক্ষেত্রে সুশাসন এবং মানুষে মানুষে সম-অধিকার সত্যিকারভাবেই কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে? কেনো এদেশের নারীরা আজও সুরক্ষার দাবিতে, নিরাপত্তার দাবিতে, ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এবং সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার আন্দোলনের মুখোমুখি হবে? এদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারীকে বাদ দিয়ে সার্বিক জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয় জেনেও এক শ্রেণির ক্ষমতালোভী মানুষ নারী উন্নয়নের স্রোতকে কেন বারবার বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্থ করে চলেছে? কীভাবে তারা এই সুযোগগুলো পাচ্ছে? কেন পাচ্ছে? কেন নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েও সেসব বন্ধ করা যাচ্ছে না?
পরিবেশের ক্ষেত্রেও দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই- বিভিন্ন ক্ষেত্রেই দখল, দুষণ, দুর্নীতিসহ নানাভাবে পরিবেশ অবক্ষয়ের ধারা অব্যাহত আছে। এর সাথে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। কেননা এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এর ফলে সবচাইতে যে জনগোষ্ঠী বেশি ভুক্তভোগী হবে তার মধ্যে নারীরা অন্যতম। প্রসঙ্গত বলতে হয় পরিবেশের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত যেসব সাফল্য অর্জিত হয়েছে, কিংবা ভবিষ্যতে যদি অর্জিত হয়- তাহলে সেটা নারী সুরক্ষা ও মর্যাদা তথা অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
একথা সত্য যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সরকারি, বেসরকারি ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নারী সুরক্ষা ও মর্যাদা তথা অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এইসব উদ্যোগের ফলে কিছু সুফলও আমরা ভোগ করা শুরু করেছি। কিন্তু নারীর প্রতি নির্যাতন বৈষম্য কমিয়ে এনে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখনো আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। এর প্রধান কারণ পুরুষের নেতিবাচক মনোভাব এবং সিদ্ধান্তগ্রহণে একক কর্তৃত্ব বজায় রাখা। ফলে এক্ষেত্রে পুরুষের ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলাটা খুব জরুরি। নারীর প্রতি নির্যাতন বৈষম্য নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখতে হলে তথা পরিবেশ সমুন্নত রাখতে হলে নারী সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পুরুষদেরকেও সংবেদনশীল করে তুলতে হবে।
বাংলাদেশে বিদ্যমান পরিবেশ সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য এবং নারীর সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি ও আইন রয়েছে। এগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা ছাড়া এসডিজি গোলসমূহের লক্ষ্যমালা অর্জন করা তথা স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বিভিন্ন সদূরপ্রসারী ফলাফল ও প্রভাব নির্ণয় করা। এ লক্ষ্যে দেশব্যাপী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে ঘনিষ্ঠভাবে কাজে লাগিয়ে পরিবেশ ও নারী সুরক্ষা বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং সে জাতীয় কার্যক্রমকে স্থানীয় ও প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত করাটা এখন খুবই প্রয়োজন।
অন্যদিকে এটাও আজ সর্বজনস্বীকৃত যে, শুধু আইনগত প্রতিকার ধর্ষণসহ যেকোন ধরনের নারী নির্যাতন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ। কেননা ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের বিপরীতে বিচারহীনতা পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। ফলে সামাজিক প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা আরো তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। আর এই প্রতিরোধ কর্মকাণ্ডেও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক প্রতিরোধ শুধু তাৎক্ষণিকভাবে নয়, বিচার হওয়া পর্যন্ত বিভিন্নভাবে অব্যাহত রাখাটা জরুরি। ইতোপূর্বে এ ধরনের অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে অপরাধীর শাস্তির দাবিতে জনগণ যখন লাগাতারভাবে কঠোর আন্দোলন করেছে, তখনই ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে।
এ দেশকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নেয়ার কাজটি এখন সবাইকে মিলেই করতে হবে। অনেক দেশের অভিজ্ঞতাও আমাদের সামনে রয়েছে, সেসব অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই সেটা হলো, পরিবেশ ও নারীকে উপেক্ষা করে উন্নয়ন বিশেষভাবে স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের উইমেন, বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল ২০২০ ইনডেক্স শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরা যেতে পারে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, পৃথিবীর আটটি দেশের অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ পুরোপুরি অবাধ। সেখানে নারীর অংশগ্রহণে আইনি বাধা নেই। এই দেশগুলো হলো বেলজিয়াম, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, লাটভিয়া, লুক্সেমবার্গ, সুইডেন ও কানাডা। (সূত্র: প্রথম আলো, ৮ মার্চ, ২০২০)।
ফলে রাজনীতিবিদ, উন্নয়নবিদ, পরিকল্পনাবিদসহ সর্বস্তরের মানুষকে সকল নারীর সুরক্ষা ও মর্যাদা নিশ্চিতকরণে এবং সার্বিক পরিবেশ সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনাকে করে তুলতে হবে অন্যায়হীন, পরিবেশের সাথে সঙ্গতি ও সমতাপূর্ণ এবং নির্যাতনমুক্ত নারীবান্ধব।
‘সচেতনতা’ একটি শব্দ কিন্তু এই শব্দটিকে জয় করতে হবে প্রতিটি মানুষকে- প্রতিটি ক্ষেত্রে ভিন্নরকমভাবে। এজন্য জাতীয়ভাবে উপযুক্ত সচেতনতামূলক শিক্ষা এবং বিভিন্ন কার্যক্রমও থাকতে হবে। নারীর জন্য সুরক্ষার সচেতনতা এবং নারীদের প্রতি মর্যাদা ও সংবেদনশীল আচরণ পালনে সচেতন হয়ে উঠতে হবে যেমন সবাইকে, তেমনিভাবে পরিবেশের প্রতিও সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে প্রতিটি মানুষকে। এই দুটি ক্ষেত্রেই দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। তাহলেই হয়তো আমাদের চারপাশ সবদিক থেকে সুস্থ, সুন্দর ও আবারও স্বাভাবিক হবে।