আলু হিমাগারে ঢুকেছে ১২ টাকায়, বের হচ্ছে ৩৫ টাকায়

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা ৭০-৭৫ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সবজিপণ্যটির উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ টনেরও বেশি। উদ্বৃত্ত উৎপাদন সত্ত্বেও কয়েকদিন ধরে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছে আলুর বাজারে। ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি কেজি ৫০ টাকা ছাড়িয়েছে সবজিপণ্যটির দাম। অথচ সেই আলুই উৎপাদন মৌসুমে এক-চতুর্থাংশ দামে কৃষকের কাছ থেকে কিনেছিলেন হিমাগার মালিক ও মজুদদার ব্যবসায়ীরা।
দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি বছরের উৎপাদন মৌসুমে তারা প্রতি কেজি আলু ১২-১৫ টাকায় বিক্রি করেছেন। সেই আলু কিনে মজুদ করেন হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ীরা, যা এখন হিমাগার গেটে বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকার বেশি দামে। ৬০ কেজির এক বস্তা আলু হিমাগারে সংরক্ষণে তাদের খরচ পড়ে ১৮০-২২০ টাকা। ক্রয়মূল্য, হিমাগার খরচ ও অন্যান্য খরচ মিলে প্রতি বস্তা আলুতে মোট খরচ হয় ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা। কিন্তু সেই আলু এখন ২ হাজার ১০০ টাকারও বেশি দামে বিক্রি করছেন হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
আলুর দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দেয়ায় ব্যবসায়ীদের সমালোচনা করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক। গতকাল এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, এ বছর আলুর বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিচ্ছেন ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকরা। এক কেজি আলুতে ২০ টাকা লাভ করছেন তারা। বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি এবং নানা কারসাজির কারণে দাম নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন একটা কাজ। তবে আমরা নীরব দর্শকের ভূমিকায় নেই।
হঠাৎ বাজার অস্বাভাবিক হয়ে ওঠায় হিমাগার ও খুচরা বাজারে আলুর দাম নির্ধারণ করে দিতে বাধ্য হয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর (ডিএএম)। সরবরাহে কৃৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতিমুনাফা হাতিয়ে নেয়া রোধ করতেই দাম নির্ধারণ করে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।
ডিএএমের তথ্য অনুযায়ী, মৌসুমে কেনা দাম, হিমাগার ভাড়া ও অন্যান্য খরচ মিলে প্রতি কেজি আলুর পেছনে খরচ পড়ে ১৮ টাকা ৯৯ পয়সা। সে হিসেবে প্রতি কেজি আলু ২০ টাকা দামে বিক্রি করলেও লাভবান হতে পারেন হিমাগার মালিকরা। ফলে হিমাগার পর্যায়ে ২ থেকে ৫ শতাংশ মুনাফা যোগ করে ২৩ টাকা, পাইকারি পর্যায়ে ৪-৫ শতাংশ মুনাফা যোগ করে ২৫ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ১০-১৫ শতাংশ মুনাফা যোগ করে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা বেঁধে দেয়া হয়েছে প্রতি কেজি আলুর দাম।
চলতি বছর দীর্ঘমেয়াদি বন্যার কারণে দেশের অধিকাংশ জেলায় সবজি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এ কারণে সব ধরনের সবজির দাম চড়া। এ অবস্থায় সবজি হিসেবে আলুই ছিল নিম্ন আয়ের মানুষের ভরসা। কিন্তু এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পণ্যটির বাজার অস্থির করে তুলেছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।
বাজার গবেষকরা বলছেন, আলুর দামের অর্ধেকের বেশি পাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। মজুদ সক্ষমতা না বাড়ার কারণেই ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক। তাই উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষক পর্যায়ে মজুদ সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তাছাড়া প্রক্রিয়াজাত শিল্পে আলুর বিকল্প ব্যবহার বাড়াতে হবে।
কৃষিপণ্যে ব্যবসায়ীরা কী মাত্রায় মুনাফা করবেন, সে বিষয়ে সঠিক তদারকি নেই। ব্যবসায়ীদের অনৈতিক মুনাফার কারণে উৎপাদকরা যেমন লোকসান দিচ্ছেন তেমনি ঠকছেন দেশের ভোক্তারাও। তবে আলু নিয়ে কোনো ব্যবসায়ী অতিমুনাফা করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিযোগিতা কমিশন-সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, যেকোনো পণ্যের ক্ষেত্রে বাজারে কোনো ধরনের যোগসাজশ কিংবা মনোপলি আচরণ করলে প্রতিযোগিতা কমিশন গুরুত্বসহকারে বিষয়টি তদারক করে। আলুর ক্ষেত্রে বাজারে এক ধরনের অস্বাভাবিকতা বিরাজ করছে। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব।
এদিকে আলুর বাজার অস্থির করার পেছনে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হচ্ছে সেই হিমাগার মালিকরা বলছেন, ২০১৯-২০ মৌসুমে আলু উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে। উৎপাদিত আলুর ৪০ লাখ টন হিমাগারগুলোতে সংরক্ষণ করা হয়। এর মধ্যে গত সপ্তাহ পর্যন্ত ৫৫ শতাংশ আলু হিমাগারগুলো থেকে বের করা হয়েছে। এছাড়া বাকি আলু থেকে প্রায় ৮-১০ লাখ টন বীজআলু হিসেবে রাখতে হয়। এখন এসব আলু যদি চলে যায় তাহলে সামনের দিনে উৎপাদন বাড়ানো অসম্ভব হবে।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএসএ) পরিচালক ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু এ প্রসঙ্গে বলেন, কয়েক দশকের ব্যবধানে আলুতে সর্বোচ্চ মুনাফা করেছেন ব্যবসায়ীরা। এতে আমার কোনো দ্বিমত নেই। তবে সেই মুনাফার সুযোগ হিমাগার মালিকরা নিতে পারছেন না। হিমাগার মালিকরা গত কয়েক বছর এ ব্যবসায় লোকসান করার কারণে অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছেন। ফলে চলতি মৌসুমের শুরুতে অনেকেই আলু কিনতে ব্যর্থ হয়েছেন। আলু রফতানি ও ত্রাণে আলু থাকার কারণে চলতি বছর মৌসুমের শুরুতে আলুর বেশি দাম ছিল। এ কারণে হিমাগার মালিকরা সেই দামে আলু কিনে ব্যবসা করতে চাননি। কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়ে রেখেছেন। তবে সেটির পরিমাণ খুবই কম। আমরা অতিমুনাফা করছি কিনা সেটি যাচাই করার জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব, তারা যেন আমাদের প্রতিটি হিমাগারে গিয়ে চেক করেন।
তার দাবি, বর্তমান সময়ে নতুন মজুদদাররা ব্যবসা করছেন বেশি। সবজি কম উৎপাদনের কারণে আলুতে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। কম উৎপাদন ও বাড়তি চাহিদার কারণে আলুর দাম বেড়েছে।