করোনাকালে ভারত বাংলাদেশ বাণিজ্য অর্ধেকে নেমে এসেছে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার ভারত। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়, যার ৯০ শতাংশই ছিল বাংলাদেশের আমদানি। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে আঘাত হানা বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯-এর প্রভাবে মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরে প্রতিবেশী এ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য কমেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
মার্চ শেষে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকেও বাণিজ্যে খরা অব্যাহত ছিল দুদেশের মধ্যে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমেছে ২৪ শতাংশ। আর এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ভারত থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি কমেছে ৫১ শতাংশ।
ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের এমন ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য কমে যাওয়ার মূল কারণ করোনার আঘাত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে করোনার প্রকোপ কমেনি। তাই তারা আগের মতো বাংলাদেশে পণ্য পাঠাতে দিচ্ছে না, আবার বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিতেও দিচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানিতে ১৭ থেকে ১৮ দিন বিলম্ব হচ্ছে। আবার বাংলাদেশ থেকে যখন রফতানি পণ্য নিয়ে যায় গাড়ি তখনো অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের যে সীমান্ত আছে, তার সবগুলো ব্লক করে দিয়েছে প্রদেশটি। সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে খুব সীমিত আকারে পণ্য আনা-নেয়া হচ্ছে। এ কারণে ভারতের অভ্যন্তরেও পশ্চিম বাংলার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বিঘ্নিত হচ্ছে।
ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের ৮০ থেকে ৯০ ভাগই হয়ে থাকে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে। আমদানি ও রফতানি বাণিজ্য পরিচালনায় বাংলাদেশ-ভারত ঘোষিত স্থলবন্দরের সংখ্যা ২৩টি। এর মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ১১টি। চালু এসব স্থলবন্দরের ছয়টিই পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। বন্দরগুলো হচ্ছে বেনাপোল, হিলি, ভোমরা, বুড়িমারী, সোনামসজিদ ও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। করোনা পরিস্থিতির কারণে এসব বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের গতি অনেক কমে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) সদস্যরা। তারা বলছেন, এ রকম একটা অবস্থায় একমাত্র উপায় হলো রেল বেশি ব্যবহার করা। আরেকটা বিকল্প হলো নদীপথ ব্যবহার করা। কিন্তু নদীপথের ব্যবহারও সীমিত।
আইবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, সম্প্রতি কলকাতার রফতানিকারকরা জানিয়েছেন, সীমান্তে বিলম্বকাল দুদিন করে কমিয়ে আনা হচ্ছে। আজকে যদি ১৮ দিনের বিলম্ব থাকে আগামীকাল বিলম্ব হচ্ছে ১৬ দিনের। এভাবে বসে থাকা ট্রাক বেশি করে ছেড়ে সময় কমিয়ে নিয়ে আসছে। আশা করা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে আর আগের মতো বিলম্ব থাকবে না, আগের মতো এক বা দুদিনের বিলম্ব থাকবে। টাটার স্পেয়ার পার্টস রফতানিকারকরা এমনটাই আশা করছেন।
আবদুল মাতলুব আহমাদ আরো বলেন, আগামী বছর শুরুর আগে দুই দেশের বাণিজ্য গতি স্বাভাবিক হবে না, এমন আশঙ্কা কারো কারো থাকতেই পারে। কিন্তু আমি আশা করছি, পেঁয়াজের মতো কোনো সংকটময় পরিস্থিতি ছাড়া দুই দেশের স্বাভাবিক বাণিজ্য সম্পর্ক অক্টোবরের প্রথম থেকেই দৃশ্যমান হবে।
ভারতে বাংলাদেশ রফতানি করে এমন পণ্যের মধ্যে আছে পোশাক শিল্পের ওভেন ও নিটওয়্যার, হোম টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, হিমায়িত খাদ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার, কাঁচা পাট, পাটজাত পণ্য, বাইসাইকেল। অন্যদিকে বাংলাদেশ আমদানি করে এমন পণ্যের মধ্যে আছে পেঁয়াজসহ মসলাজাতীয় পণ্য, তুলা, সুতা, সিরিয়াল, যানবাহন, সবজি, প্লাস্টিক, লবণ, বৈদ্যুতিক পণ্য, দুগ্ধজাত পণ্য, ফল, কাগজসহ আরো অনেক পণ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুন সময়ে ভারতে পণ্য রফতানির বিপরীতে বাংলাদেশে এক্সপোর্ট রিসিপ্ট বা অর্থ এসেছে ৪৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০২০ সালের একই সময়সীমায় ভারতে রফতানির বিপরীতে বাংলাদেশে অর্থ এসেছে ৩৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এ হিসেবে চলতি বছরের প্রথমার্ধে গত বছরের একই সময়ে তুলনায় ভারতে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশের আয় কমেছে ২৪ শতাংশ।
বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ১৪ শতাংশের উৎস দেশ প্রতিবেশী ভারত। বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি তথ্যে এক্ষেত্রেও নেতিবাচক ধারা প্রকাশ পাচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়ে ভারত থেকে পণ্য আমদানির বিপরীতে বাংলাদেশের ১৭১ কোটি ৮ লাখ ডলার অর্থ ব্যয় হয়েছে। এর পরের প্রান্তিক এপ্রিল থেকে জুনে আমদানির বিপরীতে অর্থ ব্যয় হয়েছে ৮৮ কোটি ৫২ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৮৩ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। সে হিসেবে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ভারত থেকে আমদানি ৫১ শতাংশ কমেছে।
ভারত সরকারের পরিসংখ্যানেও দুই দেশের বাণিজ্য কমে যাওয়ার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। দেশটির অর্থবছর শুরু এপ্রিলে, শেষ হয় পরের বছর মার্চে। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ মাসে শেষ হওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ-ভারত আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৯৪৬ কোটি ৫৪ লাখ ডলার, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ১ হাজার ২৫ কোটি ৪৮ লাখ ডলারের। এ হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য কমেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
করোনার প্রভাব মোকাবেলা করে চলতি বছরের অক্টোবরে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বাণিজ্য আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা করেছিলেন ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এর মধ্যে নতুন করে ধাক্কা এসেছে ভারত সরকার কর্তৃক পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণায়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, পেঁয়াজ পরিস্থিতিটা খুবই সরল। ভারতে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় এমন যেসব এলাকা আছে সেখানে অতিবৃষ্টির কারণে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারতে রাজনীতির বড় একটি অংশ পেঁয়াজ। অনেক দরিদ্র জনগোষ্ঠী আছে যারা পেঁয়াজ ছাড়া ভাত খেতেই পারে না। ভারতের অনেক অঞ্চলের মানুষ সবজি বেশি খায়, তাদের পেঁয়াজের ব্যবহারটা অনেক বেশি। আমাদের এখানে যেমন চালের রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ভারতেও পেঁয়াজের রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ভারতের যত বড় বাজার সেই তুলনায় বাংলাদেশে পেঁয়াজের আমদানি খুব বড় কিছু না। কিন্তু হঠাৎ করে রফতানি বন্ধ ঘোষণার মতো সিদ্ধান্তের প্রতিফলনস্বরূপ আমাদের বাজারে খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে অন্তত প্রতিবেশী দেশ হিসেবে যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো হচ্ছে সেগুলোর আলোকে ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, মোটর ভেহিকেল এগ্রিমেন্ট, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিসহ বিভিন্ন রকম দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগ যখন নেয়া হচ্ছে এ রকম একটা সময়ে শুল্ক কর্তৃপক্ষগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা দেখা যায়নি। শুল্ক কর্তৃপক্ষগুলো সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ ক্ষেত্র হিসেবে ভূমিকা পালন না করে ক্রসিং ক্ষেত্র হিসেবে ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। ভবিষ্যতের জন্য এ বিষয়গুলোকে এখনই বিবেচনায় নিতে হবে।
কভিডের সময়ে সমস্যা হয়েছে আমদানি-রফতানি দুই ক্ষেত্রেই। আর সেটা বিশ্বের সব দেশের সঙ্গেই দৃশ্যমান ছিল। ভুক্তভোগী ছিলেন কাঁচামালের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর বাংলাদেশী রফতানিকারকরা। আবার বিশ্ববাজার থেকে আমদানীকৃত ফিনিশড প্রডাক্টের বাংলাদেশী ভোক্তারাও ভুক্তভোগী হয়েছেন। সবাইকেই ভুক্তভোগী হতে হয়েছে কভিডের প্রভাবে। তবে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বিঘ্ন বেশি দেখা গিয়েছে। কারণ সমুদ্রপথ ব্যবহার করে অন্যান্য দেশের সঙ্গে হওয়া বাণিজ্যিক কার্যক্রম কম-বেশি সচল ছিল। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ৯০ শতাংশই স্থলপথভিত্তিক হওয়ায় সমস্যা ছিল বেশি। কভিডের প্রাদুর্ভাবে স্থলবন্দরের শুল্ক বিভাগের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছিল। অনেকটাই আরবিটারি বা স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যার প্রভাবে করোনাকালে অর্ধেকে নেমে আসে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য।