যেভাবে চীন-মার্কিন বাণিজ্য দ্বৈরথের শিকার ভলভো কারস

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ক্রমবর্ধমান মুক্ত বাণিজ্যের যুগে গাড়ি শিল্প যে কী মাত্রায় বৈশ্বিকভাবে আন্তঃসংযুক্ত, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ভলভো কারস। মূলে কোম্পানিটি সুইডিশ হলেও এর বর্তমান মালিক একজন চীনা বিলিয়নেয়ার। অন্যদিকে আমেরিকার দক্ষিণে যে কারখানায় কোম্পানিটি সেডান তৈরি করে, তার গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ আসে মেক্সিকো থেকে। মূলত ২০১৮ সালে সাউথ ক্যারোলাইনার চার্লসটনে আনুষ্ঠানিকভাবে কারখানা খোলে ভলভো। উদ্দেশ্য ছিল, এ কারখানায় উৎপাদিত গাড়ি চীনে রফতানি করা হবে। কিন্তু চলমান চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে কোম্পানিটি। এখন আর চীনে নয়, বরং আমেরিকায় তৈরি সেডান আমেরিকানদের কাছেই বিক্রি করতে চাইছে ভলভো।
আমেরিকায় কারখানা খোলার মধ্য দিয়ে তিনটি মহাদেশে ম্যানুফ্যাকচারিং কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পায় ভলভো। ফলে প্রকৃত অর্থেই কোম্পানিটির সামনে একটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড হিসেবে পুনরুত্থানের দারুণ সম্ভাবনা হাজির হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্রুত শুরু হয় কাজ। কিন্তু সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেয় মার্কিন-চীন বাণিজ্য সম্পর্কের পতন। তার ওপর এই বসন্তে নতুন উপদ্রব হিসেবে হাজির হয়েছে বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেয়ায় চার্লসটনের কারখানায় এরই মধ্যে তিনবার উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় কোম্পানিটি। তবে সংকটের শেষ এখানেই নয়। বর্তমানে দ্রুত বদলে যাচ্ছে মার্কিন ক্রেতাদের রুচিও। তারা এখন চার্লসটনে ভলভোর তৈরি সেডানের বদলে বেশি পছন্দ করছে স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকল (এসইউভি)।
মূলত ভলভোর চীনা মালিক লি শুফুর জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে চীনের অস্থির ও অনিশ্চিত সম্পর্ক। শুফু ফোর্ড মোটরসের কাছ থেকে ভলভো কিনে নিয়েছিলেন ২০১০ সালে। তার আশা ছিল, ভলভোকে আশ্রয় করে তিনি ইউরোপীয় গাড়ি প্রযুক্তি ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের আদ্যোপান্ত জেনে নেবেন। একই সঙ্গে প্রথমবারের মতো তৈরি করবেন সত্যিকারের একটি বৈশ্বিক চীনা গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি। প্রকৃতপক্ষে শুফু চীনের গিলি অটোমোবাইলের সঙ্গে ভলভোর একীভূতকরণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। আর এই একীভবন সম্ভব হলে ভলভোর পক্ষে মূলধন বৃদ্ধি করা আরো সহজ হতো। উভয় কোম্পানি একসঙ্গে মিলে পরিণত হতে পারত বৈশ্বিক গাড়ি শিল্পের এক শক্তিশালী প্রতিযোগীতে। কিন্তু বাস্তবে বাণিজ্যযুদ্ধ শুফুর পুরো পরিকল্পনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও মার্কিন-চীন সম্পর্কের উন্নতির বিষয়ে ভলভোর নির্বাহীদের মধ্যে তেমন কোনো আশার সঞ্চার করছে না। তারা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী বাধামুক্ত বাণিজ্যের সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতেও অনিশ্চিত।
ভলভো কারসের যুক্তরাষ্ট্র ইউনিটের প্রধান আন্দ্রেস গুস্তাফসন বলেন, আমার মনে হয় না কোনোভাবে পরিস্থিতি শিগগিরই বদলাবে। এমনকি আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন যে মার্কিন নেতৃত্বে পরিবর্তন হলে পরিস্থিতি পাল্টানোর বিষয়ে আমি আশাবাদী কিনা, তাহলে আমার পরিষ্কার উত্তর হলো, না। পরিস্থিতি খুব সম্ভবত পাল্টাবে না।
ভলভো কারসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হাকান ম্যামুয়েলসনও প্রায় একই মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, হোয়াইটহাউজে যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাতে বিশ্বায়নের ওপর বর্তমানে চলমান নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার অবসান হবে না। তবে এ নির্বাচন অন্ততপক্ষে বাণিজ্যের ওপর রাজনীতির নেতিবাচক অবস্থানের অবসান ঘটাক, তা তিনি চান। তার মতে, উভয় পক্ষই বাণিজ্যকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। কে কার থেকে বেশি শক্তিশালী, তা প্রদর্শনের জন্য মরিয়া চেষ্টা চলছে। নির্বাচনের পর এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও পরিস্থতি স্বাভাবিক হবে, এটুকু প্রত্যাশা করাই যায়।
স্যামুলেয়লসন আরো বলেন, ভলভোর চার্লসটন কারখানায় ২০১৫ সালে ১১০ কোটি ডলার বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে তার কোনো অনুশোচনা নেই। কারণ ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রে কোম্পানিটির পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল, যা মোটেই মেনে নেয়া সম্ভব নয়। কেউ যদি সত্যিই বাজারে বিশ্বাস করে, তবে তাকে অবশ্যই শিল্প উপস্থিতি দেখাতে হবে। আর এজন্যই এটি শুধু কারখানা নয়, বরং তার থেকেও বেশি কিছু। কারণ চার্লসটনে উৎপাদিত এস৬০ মডেলের সেডান বিক্রি আশানুরূপ না হলেও সার্বিকভাবে কারখানাটি ভলভোর প্রোফাইলের উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে। সুইডেন ও বেলজিয়ামের কারখানা থেকে আমদানীকৃত এসইউভি মডেলের সহায়তায় ২০০৭ সালের পর প্রথমবারের মতো গত বছর কোম্পানিটি যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি বিক্রি করেছে ১ লাখেরও বেশি।
ভলভো এখন তাদের পরবর্তী প্রজন্মের সবচেয়ে বড় এসইউভি এক্সসি৯০ বাজারে আনতে চাইছে। আর তারা এ গাড়ি তৈরি করতে চাইছে চার্লসটনের কারখানায়। আর এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বছরে এক লাখ গাড়ি তৈরির প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী হাকান ম্যামুয়েলস।
অন্যদিকে সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত চালর্সটনে দুর্ভাগ্যের পরও গুস্তাফসন মনে করছেন, ভলভো ও তার মার্কিন কারখানা ফের ছন্দ ফিরে পেয়েছে। কারণ গত জুলাইয়ের শেষের দিকে ফের শুরু হয়েছে উৎপাদন কার্যক্রম। একই সঙ্গে সরবরাহের ঘাটতি এড়াতে মজুদ করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ। তাছাড়া বরছরওয়ারি গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রে ভলভোর বিক্রি বেড়েছে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর জুলাই ও আগস্টেও এ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। গুস্তাফসন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে টানা তিন মাস বিক্রি প্রবৃদ্ধি ভাগ্যের জোরে হয়নি; বরং এর পেছনে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের নিরন্তর প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনার সফলতা। ব্লুমবার্গ অবলম্বনে