চট্টগ্রাম বন্দরের যথাযথ ব্যবহারে বাধা ১৬ সমস্যা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ দেশে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমের ব্যাপকতা বৃদ্ধির ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রমের ব্যাপ্তি বেড়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১২ শতাংশ হারে বাড়ছে কার্গো-কনটেইনার হ্যান্ডলিং। সরকারের নেয়া নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে এ হার আরো বাড়বে। তবে জাহাজ আগমন বাড়লেও পিক সিজনে (এপ্রিল-অক্টোবর) চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দেয় জেটির অপ্রতুলতা।
শুধু জেটির অপ্রতুলতা নয়, দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরটির যথাযথ ব্যবহারে ১৬ ধরনের সমস্যা চিহ্নিত করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরটির কী কী সমস্যা ও তা সমাধানের উপায় জানতে চেয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি সংসদীয় কমিটির কাছে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেখানে এ ১৬টি সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এসব সমস্যা সমাধানের উপায়ও জানিয়েছে তারা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যেসব সমস্যা চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে জেটির অপ্রতুলতার বিষয়টি। এ সমস্যার সমাধানে দ্রুত পিসিটি, মাতারবাড়ী পোর্ট এবং বে টার্মিনাল নির্মাণকাজ শেষ করা এবং পুরনো জেটিগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
প্রতিবেদনে দ্বিতীয় যে সমস্যাটির কথা বলা হয়েছে সেটি হলো পর্যাপ্ত কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট সংগ্রহে না থাকা। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি সংগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। অধিকাংশ ইকুইপমেন্ট একনাগাড়ে কর্মক্ষম রাখার প্রয়োজনে প্রায় ২৫ শতাংশ সার্ভিসিংয়ে থাকে। ফলে কখনো কখনো অপারেশনাল কার্যক্রমে ইকুইপমেন্ট সংকট পরিলক্ষিত হয়। এ সমস্যাটির সমাধান হিসেবে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্টের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি সংগ্রহ করে রাখার কথা বলেছে, যাতে কিছুসংখ্যক যন্ত্রপাতি মেরামতে থাকলেও অন্যান্য যন্ত্রপাতি দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে অপারেশন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
তৃতীয় সমস্যা হিসেবে কনটেইনার সংরক্ষণের ইয়ার্ড বা স্পেস সংকটকে চিহ্নিত করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ সমস্যা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে কনটেইনারবাহী আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ধিত পরিমাণ এ কনটেইনার সংরক্ষণের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ পর্যায়ক্রমে ইয়ার্ড ও স্পেস বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ সময়সাপেক্ষ বিধায় সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কনটেইনার সংরক্ষণের ইয়ার্ড বৃদ্ধি করা যায়নি। ফলে কখনো কখনো কনটেইনার সংরক্ষণ স্থানের সংকট দেখা দেয়। এ সমস্যা সমাধানে দ্রুত সময়ে কনটেইনার সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত ইয়ার্ড বা স্পেস নির্মাণ করা এবং বে-টার্মিনাল এলাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি নতুন নতুন অফডক স্থাপনের অনুমোদন প্রদান করা হলে এ সমস্যা সহজে লাঘব হবে বলে প্রতিবেদনে মত প্রকাশ করা হয়েছে।
চতুর্থ সমস্যা হিসেবে ৩৩ বছরের পুরনো ট্যারিফের কথা উল্লেখ করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তেত্রিশ বছরের পুরনো ট্যারিফে চলছে বন্দরের কার্যক্রম। ১৯৮৭ সালে ট্যারিফ চালুর পর থেকে ২০০৭ সালে আটটি আইটেম ছাড়া আর কোনো ট্যারিফ চার্জ পরিবর্তন হয়নি। ফলে বন্দরের ক্যাপিটাল আইটেমের খরচ বাড়লেও তা ট্যারিফের সঙ্গে সমন্বয় না করায় তা এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। ফলে ভবিষ্যতে বন্দর কর্তৃপক্ষের রাজস্ব ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তাছাড়া বন্দরের ভেতরের জায়গার ভাড়াও তুলনামূলক কম। এ কারণে আমদানিকারকরা তাদের পণ্য বন্দর অভ্যন্তরে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এতে জেটি এলাকায় স্পেস সংকট এবং যানজটও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমস্যাটি সমাধানে ট্যারিফ হার বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দরের অভ্যন্তরে এফসিএল কনটেইনার খুলে পণ্য ডেলিভারি নেয়াটাকেও সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ৭০ শতাংশ এফসিএল আমদানি কনটেইনার বন্দর অভ্যন্তরে বা ইয়ার্ডে খুলে পণ্য খালাস করা হয়। এ কারণে জেটি এলাকায় ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ড্রাইভার-হেলপারের সমাগম বাড়ায় হ্যান্ডলিং কার্যক্রম ব্যাহত হয়। তাছাড়া এটি বন্দরের নিরাপত্তার জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। এটি বন্দরের উৎপাদনশীলতাকেও প্রভাবিত করে।
প্রতিবেদনে আরো যেসব সমস্যার কথা বলা হয়েছে সেগুলো হলো অকশনযোগ্য কনটেইনার ও গাড়িগুলোর অকশন কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা ও প্রক্রিয়াগত জটিলতা, শুল্ক কর্তৃপক্ষের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের অটো ইন্টিগ্রেশন না থাকা, চ্যানেল ও বার্থগুলোর অপর্যাপ্ত গভীরতা, জোয়ার-ভাটার ওপর জাহাজ অপারেশন নির্ভরশীল হওয়া, লুজ স্ক্র্যাপ, পাথর, ভারী প্রজেক্ট মালামাল ইত্যাদি জেটি অভ্যন্তরে হ্যান্ডল করা, পশ্চাৎ সুবিধা বৃদ্ধিতে বাধা, পুরনো আমলের টিওঅ্যান্ডই এখনো চালু থাকা, পরিবেশ ইউনিট পুরোদমে চালু না থাকা, ট্যাগের স্বল্পতা, চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য পোর্ট অ্যাকসেস রোডটি দুই লেনের হওয়ায় বন্দরের আসা ও যাওয়ার ক্ষেত্রে যানজট লেগে থাকা এবং বন্দর থেকে কার্গো ও কনটেইনার খালাসের ক্ষেত্রে সংযোগ সড়কের স্বল্পতা।
চট্টগ্রাম বন্দরের এসব সমস্যা সমাধানের বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী বলেন, সংসদীয় কমিটির বৈঠকে চট্টগ্রাম বন্দরের যেসব সমস্যার কথা উঠে এসেছে তা সমাধানে মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।