বস্তিতে সংক্রমণ কম, নেপথ্যে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সরকারি সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকার বস্তিতে করোনা সংক্রমণ তুলনামূলক কম। তবে কী কারণে বস্তিতে করোনা কম তা নিয়ে এখনও বিস্তর কোনো গবেষণা নেই। বলা হচ্ছে বস্তির বেশির ভাগ মানুষ খোলা পরিবেশে কায়িক পরিশ্রম করেন বিধায় তাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি। আবার করোনা উপসর্গ থাকলেও অনেকে পরীক্ষা না করায় জানা যাচ্ছে না তাদের করোনা সংক্রমণ হয়েছে কি না। উচ্চ ঘনত্বের বস্তির পরিবেশে করোনা সংক্রমণ বেশি হতে পারে এমনটা আশঙ্কা করা হচ্ছিল শুরু থেকে। তবে রাজধানীর বেশ কয়েকটি বস্তি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে শহরের অন্যন্য এলাকা থেকে বস্তি এলাকায় করোনা সংক্রমণ নিয়ে সচেতনতা অনেকটা কম। সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করেন না বেশির ভাগ বাসিন্দা। তবে করোনা একেবারে যে নেই তা কিন্তু না।
বস্তি থেকেও কেউ কেউ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন এমন তথ্যও পাওয়া গেছে।
রাজধানীসহ সারা দেশে বস্তিবাসীর সংখ্যার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। জনসংখ্যার উচ্চ মাত্রায় ঘনত্ব, ঠাসাঠাসি করে এক ঘরে পরিবারের সবাই থাকা, একই রান্নাঘর, টয়লেট, পানির উৎস অনেকে মিলে ব্যবহার, খোলা নর্দমা সামগ্রিকভাবে বস্তিবাসীদের জীবন ব্যবস্থা অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ। করোনার এই সময়ে কেমন আছেন রাজধানীর বস্তিতে বসবাসরত নিম্নআয়ের মানুষজন। এ বিষয়ে রাজধানীর কড়াইল বস্তি, মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ী বস্তি, ভাষানটেক বস্তিতে ঘুরে দেখা গেছে একই চিত্র। করোনার ন্যূনতম ভীতি নেই বাসিন্দাদের মনে। দোকানে আড্ডা, কাজ করা, ন্যূনতম শারীরিক দূরত্ব বজায় না রেখে সবই চলছে স্বাভাবিক গতিতে। করোনা আক্রান্ত হওয়া বা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কড়াইল বস্তিতে ২০১৪ সালে করা বিবিএস-এর জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ১০ হাজার ২২২টি ঘর বা খানা রয়েছে। এসব খানায় ৩৬ হাজার ৭১৯ জন বাস করেন।
সরজমিন দেখা গেছে, কড়াইল বস্তির বাসিন্দারা করোনা ভাইরাসকে পাত্তাই দিতে চান না। তাদের মতে, করোনা ভাইরাস বস্তিতে আসে না। বস্তির সামনে মোবাইল ফোনের দোকানের মালিক মারুফ বলেন, আমাদের এখানে এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হওয়া বা মারা যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। করোনার কথা চিন্তা করলে কি পেট চলবে। তবে করোনার বিষয়ে আমরা সবাই সচেতন। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সীমা বলে, খুব বেশি বাইরে যাই না। মায়ের সঙ্গে বাসায় থাকি। সীমার মা শিউলী আক্তার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বাসায় থাকেন। তিনি বলেন, বস্তিতে একজনও আক্রান্ত হওয়ার কথা শুনিনি। তবে ভয়তো কিছুটা লাগে। তারপরও সাবধানে চলাফেরা করার চেষ্টা করি। ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরি। সাবান দিয়ে হাত ধুই। বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন মনি। তিনি বলেন, ভয় নিয়ে বসে থাকলেতো পেট ভরবে না। ভয় যেমন আছে, আবার ভয়কে জয়ও করতে হবে। গৃহবধূ রাবেয়া বলেন, করোনাকে ভয় পেয়ে কী লাভ। ভয় পেলে অসুস্থ আরো বেশি হবো। আমাদের এখানে করোনার কোনো সমস্যা নেই। বস্তির ঘরের সামনেই পুতুল নিয়ে খেলছিল ছোট্ট মৌ। ৫ বছর বয়সী মৌ জানায়, করোনা কি সে জানে না। তবে বাইরে গেলে মাস্ক পরা হয়। গৃহবধূ আইরিন বলেন, গত চার বছর ধরে আমরা এখানে থাকছি। কারোই করোনা হয়নি এখনো। এমনকি বস্তির আশপাশেও কারো আক্রান্ত হওয়া এবং মারা যাওয়ার কথা শুনিনি। এমনিতে বাইরে গেলে মাস্ক পরি। বাসায় ফিরে পরিচ্ছন্ন হই। আমার স্বামী অফিসে মাস্ক পরে যায়। আবার গোসল করে ঘরে প্রবেশ করেন। দেখতে বস্তি মনে হলেও আমরা পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করি। গরিব মানুষকে করোনা আক্রান্ত করবে না। বস্তির মুদি দোকানদার কবির বলেন, ১০ বছর ধরে মুদি দোকান দিয়েছি। অবস্থা খুব খারাপ। ব্যবসা-বাণিজ্য নেই।
চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলেন জুয়েল, কবির ও আবুল। জুয়েল বলেন, আমাদের এখানে কোনো করোনা নাই। সৃষ্টিকর্তার রহমত আছে গরিব মানুষের ওপর। বস্তির ভেতরে আজ পর্যন্ত করোনা রোগী দেখিনি। যে সকল স্থানে আশিঊর্ধ্ব বয়সী লোক থাকে সেখানে বেশি করোনা আক্রান্ত হয় বলে শুনেছি। এখানে ৮০ বছর বয়সী মানুষ খুব কম আছে। পাশ থেকে কবির বলেন, প্রথম প্রথম অনেক ভয় পেতাম। এখন আর পাই না।
মিরপুরের ভাষানটেক বস্তিতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকেন মো. ইমরান। তিনি রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। করোনার কারণে কাজ চলে গেছে। বৈশাখী টেলিভিশনের ভবনে চাকরি করতেন কিশোর রাশেদুল। এখন অফিস বন্ধ। রাশেদুল বলেন, ভয়তো করবেই। জীবনের ভয় আছে না। বস্তির বাসিন্দা এবং দোকানি নাসিমা বলেন, ৯ বছর ধরে চায়ের দোকান চালাচ্ছি। করোনার কারণে এখন কিছুটা বিক্রি কম। ১৬ বছর ধরে বস্তিতে ইলেকট্রনিকস পণ্য সারাইয়ের কাজ করেন জসিম। তিনি বলেন, করোনায় আছি খারাপ অবস্থায়। ব্যবসা-বণিজ্য নাই। কাজ নাই। তবে এখন পর্যন্ত আমরা অনেক শান্তিতে আছি। কেউ আক্রান্ত হয়নি। এজন্য শুকরিয়া আদায় করছি। বস্তিবাসীদের কণ্ঠে প্রবল আত্মবিশ্বাস দেখা গেলেও সামপ্রতিক সময়ে স্বাস্থ্য বিভাগের এক জরিপে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। এতে দেখা গেছে, কম হলেও বস্তিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে করোনা কতটা বিস্তার লাভ করেছে তা জানতে জরিপ পরিচালনা করা হয় রাজধানীর ছয়টি বস্তিতে। গত ১৮ই এপ্রিল থেকে ৫ই জুলাই পর্যন্ত খানা জরিপ পরিচালনা করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি’)। গত ১৬ই অগাস্ট আইইডিসিআর’র প্রকাশিত জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার সামগ্রিক জনসংখ্যার ৯ শতাংশের মধ্যে কোভিড-১৯ উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আর বস্তিবাসীদের ৬ শতাংশের শরীরে করোনাভাইরাস রয়েছে।
এ বিষয়ে আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, করোনা আক্রান্ত হওয়া নিয়ে বস্তির মানুষজনের খুব বেশি তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। এটা নিয়ে তারা যদি আত্মতুষ্টিতে ভোগে তাহলে কিন্তু বিপদে পড়বে। এটা শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয়। সুদূর আমেরিকা থেকে শুরু করে ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকায় একই রকম কথা প্রচলিত। আমেরিকায় যারা বাংলাদেশি অভিবাসী তারা মনে করেন করোনা তাদের আক্রান্ত করবে না। তারা কিন্তু বাইরে কাজ করেছে। সন্ধ্যার পরে দোকান পাট খোলা ছিল। হোম ডেলিভারির কাজ করেছেন। কারণ মূল ধারার মানুষেরা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ঘরে থেকেছেন। পরবর্তীতে তারা এমনভাবে সংক্রমিত হয়েছে যে মৃত্যুর হারটা নিউ ইয়র্কের অভিবাসীদের মধ্যে বেশি। ব্রাজিলে অনেক বস্তির মানুষ মারা গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকাতে কৃষ্ণাঙ্গরা সংখ্যানুপাতে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের এখানে প্রথম দিকে করোনার ধাক্কাটা লাগেনি। যেটাকে তথাকথিত পিক পয়েন্ট বলে। এখন দরিদ্র এলাকায় করোনা সংক্রমণে মানুষ কম মারা যাচ্ছে কারণ এখানে প্রবীণ মানুষ খুব একটা নেই। অর্থাৎ যারা কর্মক্ষম তারা সবাই গ্রামে। ফলে যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী আছেন বা বয়স ৪০ এর নিচে তাদের মধ্যে মৃত্যু হার সব জায়গায় কম। বস্তির মানুষজন আক্রান্ত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু টের পাচ্ছে না। আক্রান্ত হলেও পেটের তাগিদে প্যারাসিটামল খেয়ে কাজে বের হয়। তবে এটা ঠিক তাদের মধ্যে গুরুত্বর রোগী কিন্তু নাই। তাদের মধ্যে অসুস্থ হওয়া, হাসপাতালে যাওয়ার সংখ্যা কম হলেও তাদের বয়স কাঠামো এবং কর্মক্ষমের জন্য আক্রান্ত কম হচ্ছে এটা আমার ধারণা। এই দু’টো কারণেই হয়তো তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার রাজধানীর অন্যান্য এলাকা থেকে কম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু বলেন, তাদের ক’জন টেস্ট করে? এখন বস্তি এলাকার মানুষের কাজ নেই। তারা ১০ টাকা পেলেও সেটা তারা খাওয়ার কাজে ব্যয় করেন। সেই হিসেবে করোনাতো তারা অনুভবই করছেন না। তাদের উপরতো সরকারিভাবে কোনো জরিপ করা হয়নি এখন পর্যন্ত। বস্তি এলাকায় করোনা কমেনি বা নাই এটা ঠিক নয়। তারা হয়তো আক্রান্ত হচ্ছেন কিন্তু বুঝতে পারছেন না। বা উপসর্গ নেই। প্রথমত, করোনা কমেনি বরং পরীক্ষা কমেছে। দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ রোগীর উপসর্গ দেখা যায় না। এবং পরীক্ষার বাইরেও অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। যেটা রিপোর্টেট হচ্ছে না।