ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য চলে গেলেন

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ প্রায় ছ’ দশক ধরে রাজনীতির পথ চলা স্তব্ধ হলো। জীবনাবসান হলো ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ছটা নাগাদ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পুত্র বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় টুইট করে বাবার মৃত্যু সংবাদটি জানান। রাজাজি মার্গ-এর বাড়িতে বাথরুমে পড়ে গিয়ে তিনি মাথায় আঘাত পান। তাঁকে দিল্লির আর্মি রিসার্চ অ্যান্ড রেফারাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে রুটিন পরীক্ষার সময় ধরা পড়ে তিনি করোনা পজেটিভ। টুইট করে প্রণব বাবু সেই কথা দুনিয়াকে জানান। সেটিই ছিল তাঁর শেষ টুইট।
দিল্লির হাসপাতালের চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার করে তাঁর মস্তিষ্ক থেকে একটি জমাট রক্তপিণ্ড অপসারণ করেন। এরপরই কোমায় চলে যান প্রণব বাবু। সেই ঘুম আর ভাঙেনি। রোববার রাত থেকে অবস্থার অবনতি হয়। সোমবার বিকালে জীবনাবসান হয় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। ভারতীয় রাজনীতির একটি যুগের অবসান হলো। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার শোকবার্তায় বলেছেন, ২০১৪-তে যখন দিল্লিতে আসি তখন আমি ছিলাম আউটসাইডার। প্রণব দা’র অভিভাবকসুলভ গাইডেন্স আমি পেয়েছিলাম। তার প্রয়াণ আমার ব্যক্তিগত ক্ষতি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তার শোকবার্তায় বলেছেন, আমার সংসদীয় জীবনের শুরু থেকে আমি প্রণব দা’র সাহচর্য পেয়েছি। আমি আমার দাদাকে হারালাম। প্রণব বাবুর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল নিবিড়। তার শ্বশুরবাড়ি ছিল বাংলাদেশের নড়াইলে। প্রয়াত স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি নড়াইলেও গেছেন। উনিশশো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় যুবক প্রণব মুখোপাধ্যায় মানসিক উদ্দীপনা জোগান মুক্তিযোদ্ধাদের। ঢাকা সফরে গিয়ে বারবার তিনি বলেছেন, ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রী বৃহৎ শক্তিকে ভীত করতে পারে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশ সম্পর্কে আলাদা একটি আবেগ কাজ করতো প্রণব বাবুর মনে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম এক বন্ধু। বেহালার একটি কলেজে এবং পরবর্তী পর্বে সিউড়ি কলেজে তিনি অধ্যাপনা করতেন।
বীরভূমের কীর্ণাহারের সন্তান প্রণব বাবু এই চুরাশি বছর বয়সেও নিজের বাড়ির পুজো নিজের হাতে করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। গ্রামের মানুষের কাছে তিনি পল্টু দা। পুরোটা গ্রামে দিদির কাছে তিনি স্নেহের পল্টু। মন্ত্রী থাকাকালীন তো বটেই রাষ্ট্রপতি পদে থাকার সময়েও প্রণব বাবু নিজের বাড়ির পুজো নিজের হাতে করেছেন। এবারও পুজো হবে। থাকলেন না শুধু প্রণব বাবু। উনিশশো ঊনসত্তর সালে রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে প্রণব বাবুর সংসদীয় জীবনের সূত্রপাত হয়। উনিশশো তিয়াত্তর সালে তিনি মন্ত্রী হন। অচিরেই হয়ে ওঠেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রধান পরামর্শদাতা। প্রণব বাবু তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অর্থ, প্রতিরক্ষা, বিদেশ, শিল্প, জাহাজ মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন। পঁচাত্তর, একাশি, তিরানব্বই ও নিরানব্বই সালে তিনি রাজ্য সভার সাংসদ হন। উনিশশো চুরাশি সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মতানৈক্যের জেরে কংগ্রেস ছেড়ে রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে একটি দল গড়েন। কিন্তু ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরে আসেন ঊননব্বই সালে সব তিক্ততার অবসানে। ২০০৪ সালে জীবনের প্রথম নির্বাচনটি জিতে লোকসভার সদস্য হন তিনি। রাহুল গান্ধীর রাজনীতিতে সক্রিয় হতেই ধীরে ধীরে প্রণব বাবু নিষ্ক্রিয় হতে আরম্ভ করেন। ২০১২ সালে কংগ্রেস সরকার তাঁকে দেশের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি করে। মোদি সরকার ২০১৯ সালে তাঁকে ভারতরত্ন দেয়।
২০১১ সালের শেষদিকে প্রণব বাবুর একান্ত একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম বহরমপুরের সার্কিট হাউসে। ব্যস্ত অর্থমন্ত্রীর সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন কংগ্রেসের বিশিষ্ট নেতা অধীর চৌধুরী। সারাদিনের কর্মসূচির ক্লান্তির পর রাত দশটায় টেলিভিশন ক্যামেরার মুখোমুখি হওয়া সত্যিই যন্ত্রণাদায়ক। প্রণব বাবু শুকনো মুড়ি আর চা খাচ্ছিলেন। একটু শ্লথ, আলগা আলস্য। কিন্তু, স্টার্ট-ক্যামেরা-অ্যাকশন হতেই এ যেন এক অন্য প্রণব বাবু। ক্ষিপ্র, কম্বুকণ্ঠে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন। মাঝে মাঝে কব্জির পেছন দিকে রিস্টওয়াচ ফেলছেন, অর্থাৎ এবার শেষ করো বাপু। কিন্তু ভারতের অর্থমন্ত্রীকে এরকম এক্সক্লুসিভ আর কখনো পাবো? ইনক্লুসিভ ব্যাংকিং নিয়ে একটি প্রশ্নের উত্তরে যা বললেন- তা পরবর্তী পর্বে ইতিহাস হয়ে গিয়েছিল। সাক্ষাৎকারের শেষে ভেবেছিলাম বিরক্ত হয়েছেন। একটি কথাতে সব ভুল ভেঙে গেল- ওরে অধীর, দেখিস এরা যেন না খেয়ে চলে যায় না। রাত অনেকটা গড়িয়ে গেল… অভিভাবক তো একেই বলে!