কাজী জাফর থেকে শিখলাম আন্ডার গ্রাউন্ডটা কী জিনিস- ড. ইউনূস

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির (জাফর) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমেদের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার (২৯ আগস্ট) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক ভার্চুয়াল আলোচনায় তার স্মরণে পুরনো দিনের গল্প শোনালেন বন্ধু-সহকর্মীরা। কাজী জাফরের মেয়ে কাজী জয়া আহমেদের সঞ্চালনায় ‘ইতিহাসে সমুজ্জ্বল কাজী জাফর আহমেদ’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার, প্রবাসী শিক্ষাবিদ আতিকুর রহমান সালু এবং ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী।
ড. ইউনূস বলেন, সে আমার বিশেষ বন্ধু ছিল। আমার ক্লাস ফ্রেন্ড ছিল। আমি এসএম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম, কাজী জাফরও এর ছাত্র ছিল। সে প্রায়ই আসতো, রাজনৈতিক কারণেই আসতো। তখন দেখা সাক্ষাৎ হতো, আলাপ হতো, হলকে উপলক্ষ করেই জানাশোনা শুরু হয়। বন্ধুত্ব হলেও সেই বন্ধুত্বটা একটা বিশেষ বন্ধুত্বে পরিণত হয়। তবে আমি ছাত্র রাজনীতি করিনি, কাজেই সেই দিক থেকে তার সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার কারণ ছিল না। এস এম হলে তখন বাম রাজনীতিরও খুব একটা জায়গা ছিল না। তবু উনি আসতেন সেখানে এটার প্রসার করা যায় কিনা এই ভেবে। কাজী জাফরের আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘আইয়ুব খানের আমলে চট্টগ্রাম থেকে একটা পিআইএর (পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স) ফ্লাইট ছিল। ঢাকায় আসার মাঝখানে কুমিল্লায় থামতো। একটা ফ্লাইটে আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছি, কুমিল্লায় থামল। যারা কুমিল্লার যাত্রী তারা নেমেছে। কুমিল্লা থেকে ঢাকার যাত্রী উঠল। তার মধ্যে লক্ষ্য করলাম, একজন দাড়ি-গোঁফওয়ালা একজন চাদর গায়ে আমার দিকে তাকাতে তাকাতে ঢুকল। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, কেন তাকালো! যেই আমার পাশে আসলো, মাথা নিচু করে বলল-আমি কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ডে আছি, আপনি কিছু বলবেন না। আমি এই মাত্র চিনলাম, আগে তো বুঝিনি। এই হচ্ছে কাজী জাফর। তখন বুঝলাম যে, আন্ডার গ্রাউন্ডটা কী জিনিস (হেসে)। বুঝলাম ছাত্র রাজনীতি করার ফল।”
আরেকটা ঘটনা মনে পড়ে। আমি বিদেশে লেখাপড়া করে ফিরে এসেছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি, জাফর তখন (জিয়াউর রহমান ক্ষমতায়) শিক্ষামন্ত্রী হলেন। একদিন তার ফোন, আমি একটি কাজ করছি, আপনি সাহায্য করুন। আমি একটি শিক্ষা কমিশন করবো৷ আপনি থাকবেন। আমি বললাম, আপনি যখন বলেছেন নিশ্চয়ই থাকবো, আর কারা থাকবেন। তিনি বললেন, আপনিই বলুন আর কাদের রাখা যায়। আমি দু-চারজনের নাম বললাম। যাই হোক পরে সেটা হলো। সেটাকে শিক্ষা কমিশন না বলে শিক্ষা কমিটি বলা হলো। ‘শিক্ষা নীতি কমিটি’ বলা হয়েছিল সম্ভবত। তখন কুদরত-ই-খুদা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে হইচই হচ্ছে। অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছিল। ঢাকায় ওই কাজ করতে এসে ভালো লাগছিলো৷ অনেক কথা বলার সুযোগ হলো। বিশেষ করে অনেক বন্ধু পেলাম। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিল, শিল্পী কামরুল হাসান ছিল, হোসেন আরা শাহেদ, শফিউল্লাহ সহ অনেকেই ছিল। নারী শিক্ষার উপর জোর দেয়া হলো, ধর্মীয় শিক্ষা যোগ করা হলো। তখন আমি গ্রাম সরকার নিয়ে লেখালেখি করছি। আমি সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করছিলাম, যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে হয় সেটা গ্রাম থেকে শুরু করতে হবে। গ্রামের মধ্যেই একটা সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তারপর ইউনিয়ন সরকার, থানা সরকার এভাবে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সরকার। আমি চাচ্ছিলাম, এ ধরনের কাঠামো শিক্ষানীতির মধ্যে আনা যায় কিনা। সবার অবশ্য এর মধ্যে আপত্তি ছিল।
আমার সেই গ্রাম সরকারের ধারণায় আমি বলেছিলাম, গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গ্রামবই বলে একটা বই থাকবে। প্রত্যেক গ্রামে বইটা আলাদা হবে। বাকি সব বই একই রকম থাকবে, শুধু ওইটা আলাদা থাকবে। ওই বইয়ে গ্রামের মানচিত্র, রাস্তাঘাট, বাজার, ইতিহাস, ভূগোল, বৈচিত্র্য, কৃষি, কারা এখানে জন্মেছেন ইত্যাদি বিষয় থাকবে যেগুলো ছেলেমেয়েরা পড়ে আনন্দ পাবে। আর সেই বইটা লিখবে স্কুলের ওই অঞ্চলের শিক্ষকরা মিলে। এর উদ্দেশ্য ছিল শুধু আমেরিকা-জাপান সম্পর্কে না জেনে নিজের সম্পর্কেও জানা। একইভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে একটা মাধ্যমিক স্কুল হবে, বই হবে- ইউনিয়ন বই। কথাগুলো একারণে বললাম, কাজী জাফর এটাকে সমর্থন করছিলেন। যাই হোক, পরবর্তী কালেও তার সাথে সেই বিশেষ সম্পর্ক টিকে থাকলো। বিশেষ কিছু হলে আলাপ হতো। আমার কোন সংবাদ পেলে খোঁজ নিতেন। শেষ দিন পর্যন্ত তার সাথে সেই বিশেষ সম্পর্ক, পারস্পারিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক রয়ে গিয়েছিলো। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুন।