জাতীয় শিক্ষানীতির খবর নেই

0

যুগের চাহিদা মেটাতে এবং বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে, বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বারবার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হচ্ছে যথাসময়ে। এর পাশাপাশি হ্রাস পাচ্ছে বইয়ের বোঝা ও পরীক্ষার চাপ। অপর দিকে, শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত দক্ষতা ও কর্মমুখী শিক্ষা অর্জনের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এমনকি, প্রতিবেশী ভারতে এই করোনাকালেই নতুন শিক্ষানীতি অনুমোদিত হয়েছে। সে দেশে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ১৫ বছরে মাত্র পাঁচটি পরীক্ষার বিধান রাখা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজো বিপরীত দিকে চলছে। শুধু প্রতি বছর নয়, মাসে মাসে পরীক্ষা আর পাঠ্যবইয়ের নামে অপ্রয়োজনীয় বোঝার চাপে শিক্ষার্থীদের নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে ছাত্রছাত্রীদের ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয় নি¤œমানের ক্লাস, কোচিং এবং মানহীন নোট ও গাইডের পেছনে। প্রকৃত সৃজনশীলতা নয়, মুখস্থ করাই তাদের সর্বাধিক আবশ্যক বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। অভিভাবকরা সন্তান বা পোষ্যদের প্রকৃত জ্ঞান ও যোগ্যতা হাসিল করার বদলে ব্যস্ত রাখছেন ‘জিপিএ ৫’ পাওয়ার জন্য। এ অবস্থায় বাংলাদেশ দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে বিশ্বে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার অঙ্গনে।
একটি জাতীয় দৈনিকের প্রাসঙ্গিক প্রতিবেদনে এ ব্যাপারে আরো বলা হয়েছে, অদক্ষ গ্র্যাজুয়েট বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে বেড়ে চলেছে বেকার। অথচ গত এক দশকেও বাস্তবায়ন করা হয়নি আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি। তদুপরি দীর্ঘ ৯ বছর পার হলেও শিক্ষাসংক্রান্ত আইন করা হয়নি। শিক্ষাবিদরা পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার মোহ থেকে মুক্ত হওয়ার তাগিদ দিলেও দলে দলে ‘পরীক্ষার্থী’ তৈরি করা হচ্ছে, ‘শিক্ষার্থী’র পরিবর্তে। জ্ঞান লাভ করাকে মানসিক চাপ বোধ করা নয়, বরং আনন্দের ব্যাপার করে তোলার ওপর ওয়াকিবহাল মহল জোর দিয়ে স্কুলজীবন শেষে কেবল একটা পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখার ওপর জোর দিয়েছে। তারা মাতৃভাষার প্রকৃত শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা এবং বিশ্লেষণ ও চিন্তাভাবনার সক্ষমতাকে অপরিহার্য মনে করেন।
ভারতের নয়া শিক্ষানীতি মোতাবেক কেবল তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে পরীক্ষা নেয়া হবে। দশম শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষার পর চার বছর মেয়াদের স্নাতক কোর্স থেকে দুই বছর পরই কেউ বের হয়ে এলে তাকে ডিপ্লোমা দেয়া হবে। মাত্র এক বছর পড়েই বের হলে ভোকেশনাল কোর্স উত্তীর্ণ বলে গণ্য করা হবে।
বাংলাদেশে ২০১০ সালের পর আর শিক্ষানীতি প্রণীত হয়নি। ফলে শিক্ষার আধুনিকায়নও আর সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কমিটি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আজ পর্যন্ত চার-পাঁচটি শিক্ষানীতি তৈরি করা হলেও একটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি। এমনকি, সর্বশেষ শিক্ষানীতি জাতীয় সংসদে পাস করেও কার্যকর করা হলো না। এতে সুপারিশ ছিল অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা, অভিন্ন কারিকুলাম, শিক্ষা কমিশন গঠন প্রভৃতির। এসব নীতি বাস্তবায়নের জন্য যে আইন থাকা চাই, তাও আজ পর্যন্ত করা হয়নি। উল্লিখিত শিক্ষানীতিতে দুই বছর মেয়াদি প্রাক প্রাথমিক, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক এবং এরপর দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষার কথা ছিল। শিক্ষক নিয়োগ ও উন্নয়নের উদ্দেশ্যে পৃথক কমিশনের বিষয়ও ছিল এতে। বলা হয়েছিল তৃতীয় শ্রেণীর আগে পরীক্ষা না নিতে এবং পঞ্চম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষা তুলে দিতে। বাস্তবে আরো অনেক ঘাটতি ছাড়াও কারিগরি শিক্ষার প্রতি পর্যাপ্ত আগ্রহ সৃষ্টি করা যায়নি। অথচ দক্ষতা ছাড়াই কারিগরি ছাত্রছাত্রী বাড়ছে। ব্যবহারিক ক্লাসের সুযোগ সুবিধা আজো কম। গত ৯ বছরে শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে চারবার, তবু চূড়ান্ত হয়নি একবারও। এ দিকে, সন্ধ্যার পর কোচিং সেন্টার চালু রাখার বিধান করা হবে বলে জানা গেছে। উচ্চ শিক্ষাস্তরে পড়–য়া বাড়ছে; কিন্তু গবেষণা নামেমাত্র। ফলে নতুন জ্ঞান সৃজন করা যাচ্ছে না। অথচ গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় লক্ষ্য। আমরা আশা করি, উপযুক্ত শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত আইন, বিধান, লোকবল, প্রতিষ্ঠান, অর্থ ও লজিস্টিকসসমেত সার্বিক নিশ্চয়তা প্রদানে আর ত্রুটি করা হবে না।