সুচি মিয়ানমারে শান্তি আলোচনা এনেছেন, শান্তি নয়

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ চার বছর আগেও রণক্লান্ত বার্মারা কল্পনা করতে পারতেন যে, একদিন অস্ত্রের ঝনঝনানি নীরব হয়ে যাবে। ২০১৬ সালের কথা। অং সান সুচি তখন ‘২১ শতক পাংলং কনফারেন্স’ আয়োজন করছিলেন। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার প্রতিষ্ঠার পর থেকে শুরু হওয়া নানা জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে আয়োজিত বেশ কয়েকটি শান্তি আলোচনার প্রথমটি ছিল সে সম্মেলন। এই শান্তি আলোচনার শুরু করেছিলেন মিয়ানমারের সাবেক নেতা ও সাবেক জেনারেল। তবে শান্তিতে নোবেলজয়ী সুচি সে আলোচনায় সত্যিকারের আশা জুগিয়েছিলেন যে, দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তবে পরবর্তীতে সে আশা ঝরে পড়ে। থেমে যায় আলোচনা।
কাচিন, কায়িন ও শান রাজ্যে বিচ্ছিন্নভাবে আজও সংঘর্ষ বিদ্যমান রয়েছে।
২০১৮ সাল থেকে রাখাইন ও চিন রাজ্যেও শুরু হয়েছে নতুন সংঘাত। এই দুই রাজ্যে বিভিন্ন সংঘর্ষে এখন অবধি মারা গেছেন প্রায় ১ হাজার বেসামরিক। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অন্তত ৮০ হাজার। ১৯শে আগস্ট থেকে ২২শে আগস্ট পর্যন্ত রাজধানী নেপিডোতে ফের আলোচনায় বসতে যাচ্ছেন সুচি, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর দলগুলো। আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে এটাই মিয়ানমারের বিদ্রোহ অবসানের শেষ চেষ্টা। তবে এখন সবার মনে একটাই প্রশ্ন: ভুলটা কোথায় হয়েছিল?
শান্তি প্রতিষ্ঠা কখনোই সহজ হওয়ার কথা ছিল না। অনেকের মতে, মিয়ানমারের নেত্রী হিসেবে উত্তরাধিকারসূত্রে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী গৃহযুদ্ধ পেয়েছেন সুচি। তার শান্তি প্রক্রিয়ার নামকরণ করা হয় প্রথম পাংলং সম্মেলনের নামানুসারে। ১৯৪৭ সালে সে সম্মেলন শুরু করেছিলেন সুচির বাবা, মিয়ানমারের স্বাধীনতার জনক অং সান। তখন থেকেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর একগুচ্ছ দল দেশের বহু অংশে অনবরত সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ট্রান্সন্যাশনাল ইন্সটিটিউট (টিআই) অনুসারে, ইতিহাসের সবচেয়ে গোলকধাঁধাতুল্য একটি শান্তি প্রক্রিয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন সুচি। তার পূর্বসূরী থেইন সেইন ন্যাশনওয়াইড সিজফায়ার এগ্রিমেন্ট (এনসিএ) বা দেশব্যাপি যুদ্ধবিরতি চুক্তির নকশা তৈরি করে গেছেন। এর আওতায় স্থাপন করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা।
যারা এনসিএ’তে স্বাক্ষর করেন, তাদের নিয়ে শুরু হয় শান্তি প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় ধাপ- রাজনৈতিক আলোচনা। কিন্তু ২০১৫ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে রাগিয়ে তোলে। সেনাবাহিনী জানায়, ছয় গোষ্ঠীকে এনসিএ’তে স্বাক্ষর করতে দেওয়া হবে না। প্রাথমিকভাবে সশস্ত্র বিদ্রোহী দলগুলোর মাত্র আটটি এনসিএ’তে স্বাক্ষর করে। মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মাত্র ২০ শতাংশ ছিল তারা। এনসিএ দেশব্যাপী হওয়া নিয়ে যে প্রচারণা চালানো হয়েছিল তা হাস্যকর প্রতীয়মান হয়।
এনসিএ দেশব্যাপী না হওয়ায় দেখা দেয় নতুন এক জটিলতা। শান্তি প্রক্রিয়া ভাগ হয়ে যায় দুই পথে- এনসিএ স্বাক্ষরকারী বিদ্রোহীদের সঙ্গে শুরু হয় রাজনৈতিক আলোচনা ও বাকিদের সঙ্গে শুরু হয় দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধবিরতি আলোচনা। সুচি ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকে এনসিএ’র বাইরে থাকা দলগুলোকে চুক্তিটতে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। পাশাপাশি স্বাক্ষরকারী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে শান্তি আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সত্যিকারের অগ্রগতি করতেও ব্যর্থ হয়েছেন।
সেনাবাহিনীও শান্তি আলোচনায় সহায়তা করছে না। সুচি সেনাবাহিনীকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে মিটমাট করে নিতে বাধ্য করার ক্ষমতা রাখেন না। মিয়ানমারের সংবিধান অনুসারে, সেনাবাহিনী বা তাতমাদাও দেশটির প্রতিরক্ষা, সীমান্ত ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ তাদের দখলে। সাংবিধানিক সংশোধনে তাদের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।
টিআই’র টম ক্রেমার বলেন, সেনাবাহিনী শান্তি প্রক্রিয়া চলাকালীন বিদ্রোহীদের সঙ্গে সত্যিকারের মিটমাটের চেশটা বা কোনো প্রতিশ্রুতি করেনি। উল্টো তারা ইচ্ছাকৃতভাবে শান্তি প্রক্রিয়া নস্যাৎ করতে চেয়েছে। যেমন, তারা আলোচনা চলাকালীন সময়ে দুটি এনসিএ স্বাক্ষরকারী গোষ্ঠী- কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) ও দ্য রিস্টোরেশন কাউন্সিল অব শান স্টেট (আরসিএসেস) এর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে উভয় দলই এনসিএ থেকে বেরিয়ে গেছে।
২০১৯ সালের শুরু থেকে আরাকান আর্মির সঙ্গেও সংঘাত তীব্র করেছে সেনাবাহিনী। ২০১৫ সালে দলটিকে এনসিএ’তে স্বাক্ষর করতে দেয়নি সেনাবাহিনী। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর ওই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত মিয়ানমারের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের সৃষ্টি করেছে।
আমেরিকান থিংকট্যাংক এশিয়া সোসাইটির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা প্রিসসিলা ক্ল্যাপ বলেন, সেনাবাহিনী শান্তির পেছনে নয়, সংঘাতের পেছনে ছুটছে। সেনাবাহিনীর প্রধান সুচিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করেন। সুচির রাজনৈতিক জয় যথাসম্ভব আটকে রাখার চেষ্টা করেন। উপরন্তু, তাতমাদাও সবসময়ই ফেডারেলিজমের বিরোধী ছিল। তারা মিয়ানমারকে একটি একক রাজ্য হিসেবে দেখতে চায়, যেটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘বামার’ জাতিগোষ্ঠীর আধিপত্য থাকবে। এই ভিশন তারা খুশি মনে সংখ্যালঘুদের ওপর চাপিয়ে দিতে ইচ্ছুক। কারেন ওমেন’স অর্গানাইজেশনের সাধারণ সম্পাদক নাও কে’নিয়াও পাও বলেন, আমার মনে হয় না তারা সত্যিকারের শান্তি চায়।
সুচিকে সরকার পরিচালনায় খুব কম সুযোগই দেয় তাতমাদাও। তা সত্ত্বেও সুচি বহু ভুল করেছেন। প্রথমে খুব উৎসাহ নিয়ে তিনি শান্তি আলোচনা শুরু করেন। আন্তর্জাতিক থিংকট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ অনুসারে, সুচি প্রত্যাশা করেছিলেন যে, সাংবিধানিক সংস্করণের সবচেয়ে দ্রুততম ও সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হ্রাস করার একমাত্র উপায় ছিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে চুক্তি করা। সুচি দীর্ঘদিন ধরে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কমাতে চাইছেন। সেনাবাহিনী বলেছে, সংস্কারের পূর্বশর্ত হচ্ছে শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব দূর করা। কিন্তু যখন শান্তি প্রক্রিয়ার মধ্যস্ততা করার ভার সুচির ওপর চেপে বসে, তার উদ্যম মলিন হয়ে যায়। তিনি তখন অন্যান্য ইস্যুতে মনোনিবেশ করেন। ক্র্যামার বলেন, এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, এনএলডি সরকারের অগ্রাধিকার হচ্ছে সেনাবাহীনির সঙ্গে মিটমাট করা, (জাতিগোষ্ঠীগুলোর) সঙ্গে নয়। প্রাথমিকভাবে সুচির সরকারের আশা ছিল যে, সেনাবাহিনী যদি বেসামরিক সরকারকে হুমকি মনে না করে তাহলে, তারা হয়তো সাংবিধানিক সংস্কারে অনুমোদন দিতে পারে। এর একটি পরিণতি হচ্ছে, সেনাবাহিনী শান্তি প্রক্রিয়ায় আধিপত্য করতে চেয়েছে।
সুচির সরকার একদিকে শান্তি আলোচনা অগ্রাহ্য করে গেছে , অন্যদিকে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে। চলতি বছরের মার্চে মিয়ানমার সরকার রাজ্য বিধানসভাগুলোকে নিজেদের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের অধিকার দিতে অস্বিকৃতী জানায়। উল্লেখ্য, রাজ্য বিধানসভাগুলোর কয়েকটি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এছাড়া, সংখ্যালঘুদের দীর্ঘদিন ধরে চলা নির্যাতনও স্বীকার করতে ব্যর্থ হয়েছেন সুচি। এনসিএ স্বাক্ষরিত গোষ্ঠীগুলো বহুবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, সেনাবাহিনী চুক্তিটি লঙ্ঘন করেছে। তাদের উদ্বেগে সাড়া দেয়নি সুচির সরকার। সংখ্যালঘুদের সঙ্গে মিলে ফেডারেল ইউনিয়ন গড়তেও ব্যর্থ হয়েছেন সুচি। ক্র্যামার বলেন, বহু সংখ্যালঘুদের দৃষ্টিতে সুচি তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। নাও কে’নিয়াও পাও বলেন, আমরা তার ওপর হতাশ।
বহু বছর ক্ষমতায় থেকেও কোনো ফল না নিয়ে ফের নির্বাচনে ভোটারদের সামনে দাঁড়ানোর চিন্তা থেকেই আবার কাজে নেমেছেন সুচি। এতে কিছু সম্ভাবনাময় ইঙ্গিত মিলেছে। জানুয়ারিতে কেএনইউ ও আরসিএসএস পুনরায় আলোচনার টেবিলে ফিরে এসেছে। সরকার তাদের কিছু উদ্বেগ নিয়ে কাজ করতে সাড়া দিয়েছে। তবে পাংলং সম্মেলনে সংবিধানের বাইরে কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। নাও কে’নিয়াও পাও বলেন, এই সম্মেলন দলগুলোকে নতুন কিছু উপহার দিচ্ছে না। যদি সকল সশস্ত্র দল এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত না হয় তাহলে আমরা আমাদের সময় নষ্ট করছি। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, সরকার কেবল ‘মুখ বাঁচাতে’ নির্বাচনের আগ দিয়ে এই সম্মেলনের আয়োজন করেছে। এতে করে দেশজুড়ে বিদ্যমান লড়াই থামবে না।
(দ্য ইকোনমিস্টের অনলাইন সংস্করণে ১৮ই আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিমার্জিত ভাবানুবাদ।)