ভরসা পাচ্ছেন না পাটকল শ্রমিক নেতারা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ হওয়ার পর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বা অন্য কোনোভাবে চালু হলে শ্রমিকদের সেখানে চাকরিতে নেওয়া হবে বলে যে আশ্বাস সরকারের মন্ত্রীরা দিচ্ছেন, তাতে ভরসা করতে পারছেন না পাটকল শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা।অতীতের অভিজ্ঞতার কারণে শঙ্কিত হচ্ছেন জানিয়ে তারা বলছেন, এর আগে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া মিলগুলোর মালিকরা নিজেদের পছন্দের লোক নিয়োগ করেছেন। আবার অনেকে জমি, যন্ত্রপাতি বিক্রি করে কারখানা বন্ধ করে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। তাই শ্রমিকদের পুনর্নিয়োগের আশা করা তাদের জন্য কঠিন। আর দেশে করোনাভাইরাসের এই মহামারীর মধ্যে কাজে ফিরতে না পারলে হাজার হাজার শ্রমিকের জীবন বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে তাদের আশঙ্কা।


তাছাড়া শ্রমিকদের পাওনা টাকার অর্ধেক নগদ এবং বাকি অর্ধেক মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র আকারে পরিশোধের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। তবে পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী তাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের ‘দায়িত্ব নিয়েছেন’, তারা নিরাপদে থাকবেন। আর শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলছেন, পাটকলগুলো সংস্কার করতে হলেও কয়েক মাস সময় লাগত, এখানেও তেমনটিই হবে বলেই তিনি আশা করছেন।


ধারাবাহিকভাবে লোকসানে থাকা দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকলের উৎপাদন ইতোমধ্যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিজিএমসির অধীন এসব পাটকলের ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী কর্মচারীকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসরে পাঠানো হচ্ছে। এসব কারখানায় আরও প্রায় ২৬ হাজার তালিকাভুক্ত ও দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক রয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে রাজশাহী জুট মিলসের সিবিএ সভাপতি জিল্লুর রহমান শুক্রবার বলেন, তাদের মিলে ১৭৫৭ জন শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে স্থায়ী ৭০৭ জন, অস্থায়ী (দৈনিক মজুরিভিত্তিক) ১০৫০ জন। “বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে গেলে সব শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। কারণ যারা কারখানা লিজ নেবেন, তারা তাদের পছন্দের লোক নিয়োগ করবেন। ফলে এই ১৮ শর বেশি শ্রমিক কাজ হারাবে।” চট্টগ্রামের হাফিজ জুট মিলসের শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা মাহবুবুল আলম এখন বাংলাদেশ পাটকল শ্রমিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেন, “সরকারি পাটকল আগেও বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেখা গেল, অনেক মালিক জমি বেচে, মেশিনারিজ বেচে বিদেশে চলে গেছে। শ্রমিকদের টাকা দেওয়ার কথা বলেছিল, কিন্তু পরে দেয়নি। আস্তে আস্তে অনেক পাটকল বন্ধই হয়ে গেছে। এখন আমাদের পাওনাগণ্ডা ঠিকমত পরিশোধ না করলে আমরা আমরণ অনশন করব।”


পাটকল শ্রমিকদের সংগঠনগুলোর নেতাদের মতই সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দিহান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শ্রমিক ফ্রন্টের নেতারা।এই মহামারীর মধ্যে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ও তাদের পরিবারকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে ঠেলে দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা তারা দেখছেন না। পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পাটকলগুলো বন্ধ না করে ১২০০ কোটি টাকা খরচ করে সেগুলোর বিএমআরআই (সমন্বয়, আধুনিকায়ন, পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ) করা গেলে উৎপাদন সমতা বাড়ানো যেত বলে মনে করেন তারা।
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, “এই যন্ত্রাংশগুলো আধুনিকায়ন করে উৎপাদন বাড়ানো হলে পাটকলগুলো লোকসানের মুখে পড়ত না। উৎপাদন বাড়ত তিন গুণ। আজকে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কোনো প্রয়োজন পড়ত না।” জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কামরুল আহসান বলেন, “পিপিপি প্রক্রিয়ায় পাটকল চালুর যে কথা এখন বলা হচ্ছে, তা শিশু ভোলানোর গল্প মাত্র। বস্তুত রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের এই শিল্পের বিপুল সম্পদ ব্যাক্তি মালিকানায় তুলে দেওয়ার বন্দোবস্ত মাত্র। “সরকারের প থেকে বলা হচ্ছে, গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য মজুরি বুঝে পাবেন। এখন দেখার পালা, এই প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ হয়।” বাংলাদেশ শ্রমিক দলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, “করোনা পরিস্থিতির মধ্যে হুট করে মিল বন্ধ করে দিলে শ্রমিকরা যে বিপদে পড়বেন, সে কথা সরকার চিন্তা করেনি। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে শ্রমিকদের ভাগ্য নিয়ে খেলছে সরকার। “যাদের চাকরির এক বছর বা ছয় মাস আছে, তারা এখন টাকাটা নিয়ে চলে গেল। কিন্তু যারা তরুণ বা বয়স কম, তারা এখন বিকল্প পেশা হিসেবে কোন পেশা বেছে নেবেন? পিপিপির মাধ্যমে নতুন ম্যানেজমেন্ট এলে কি পুরনো শ্রমিকরা চাকরি পাবেন? এ গ্যারান্টি কে দেবে?” পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন স্কপ নেতা ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি শহীদুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, “৫ হাজার কোটি টাকা দিয়ে সরকার গোল্ডেন হ্যান্ডশেক করতে পারে, কিন্তু ১২০০ কোটি টাকা দিয়ে বিএমআরই করতে পারে না। তাদের কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করা যায় যে, তারা শ্রমিকদের টাকা ঠিকমত দেবে?
“করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেই বিশাল সংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। আদমজী জুট মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে বিশাল সংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ল। এবার তো আরও বেশি হবে। দেখা যাক, সরকার যদি ঠিকমতো শ্রমিকদের পাওনা বুঝিয়ে না দেয় তাহলে আমরা বৃহৎ আন্দোলনে যাব।” মজুরি স্কেল-২০১৫ অনুযায়ী ওই বছরের ১ জুলাই থেকে পাটকল শ্রমিকদের মজুরি দ্বিগুণ করার কথা থাকলেও এখনও তার বাস্তবায়ন হয়নি। পরে ২০১৮ সালের মার্চে জাতীয় মজুরি কমিশন সরকারের কাছে পাটকল শ্রমিকদের বেতন ৮৫% বাড়ানোর জন্য আইন পাস করে প্রজ্ঞাপন জারির সুপারিশ করে।পাটকল শ্রমিকরা ২ হাজার ২০০ টাকা সাপ্তাহিক মজুরি পেতেন, সেখানে নতুন মজুরি কমিশন অনুযায়ী ৪ হাজার ৩০০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন। আর যারা আগে ২ হাজার ৩০০ টাকা মজুরি পেতেন তারা এখন থেকে ৪ হাজার ৪০০ টাকার উপরে পান। সরকার এখন সে অনুযায়ীই শ্রমিকদের ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের’ টাকা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। পাটকলগুলো বন্ধের ঘোষণা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে শুক্রবার রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় সংবাদ সম্মেলনে আসেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। শ্রমিকদের আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের ‘দায়িত্ব নিয়েছেন’। তারা ‘নিরাপদে, শান্তিতে থাকবেন’। পাটমন্ত্রী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এদের পুনর্বাসন করতেই হবে। এদের অধিকতরভাবে ট্রেনিং দেওয়া যায় কি না। অর্থ সচিবকে বলেছেন, তোমার যে সমস্ত ট্রেনিং ব্যবস্থা আছে তোমরা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা কর। তাদেরকে আমার দরকার। তাদেরকে আমরা হারাতে চাই না।
“একটি শ্রমিককেও তোমরা নেগলেক্ট করতে পারবে না, প্রত্যেককে দায়িত্ব নিয়ে পুনর্বাসন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েছেন, নিরাপদে থাকবেন, শান্তিতে থাকবেন আপনারা।” চাকরি অবসায়নের পর কাজে যে বিরতি ঘটবে, তা তিন মাসের বেশি স্থায়ী নাও হতে পারে বলে আশ্বাস দিয়েছেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। পাটমন্ত্রীর ওই সংবাদ সম্মেলনের আগে সেখানে উপস্থিত শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, “বলা হচ্ছে, অনেক মিল বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা আসলে তা না। তিন থেকে চার মাসের মধ্যে পিপিপিতে এটা নতুন করে আবার যাত্রা শুরু করবে। “পিপিপি বা লিজ দেওয়ার ভিত্তিতে এফডিআইয়ের মাধ্যমে চাহিদাপত্র নিয়ে যদি কেউ আসে, তবে সেটা সরকার গ্রহণ করে শ্রমিকদের স্বার্থ, পাটের স্বার্থ বিবেচনা করে আবার উৎপাদন শুরু করবে মিলগুলো। শ্রমিকরা কর্মহীন হচ্ছেন না। আমার দৃষ্টিতে এতেই শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ।” পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের পে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, “৬০ বছর আগের যে মেশিন ১০০ পারসেন্ট উৎপাদন দিত, আজকে তা দিচ্ছে না। পাটকলের উৎপাদন কমে গেলে সব ব্যয়ভার মেটানোর ব্যবস্থা সব কিছুই করতে হয়। এটা শ্রমিকদের বুঝতে হবে। পাটকল এখন বন্ধ করে দেওয়ার মানে এই না যে, চিরতরে ছাঁটাই করা হবে। বিএমআরই করতে গেলেও পাটকল বন্ধ করতে হত।” শ্রমিকদের পাওনা টাকা যেন বেহাত না হয় সেদিকে সরকারের নজর থাকবে বলেও আশ্বাস দেন পাটকল অধ্যুষিত খুলনার সংসদ সদস্য মন্নুজান সুফিয়ান। “প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে বলে দিয়েছেন, পাওনা-দেনা একসাথে দিয়ে দেবেন। টাকা যেন কোনো নেতা, প্রশাসনের কেউ মেরে খেতে না পারে, তার জন্য তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন,” বলেন তিনি।