পরামর্শ মানা হচ্ছে না বাস্তবায়নে ধীর গতি

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ দেশে করোনা সংক্রমণের লাগাম টানা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই তিন হাজারের উপরে করোনার রোগী শনাক্ত হচ্ছে। দেশে ইতিমধ্যেই আক্রান্ত এক লাখ ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। সংক্রমণ পরিস্থিতি সামনে আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এ অবস্থায় এলাকা ভিত্তিক বড় পরিসরে লকডাউন দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি কমিটি। করোনা নিয়ন্ত্রণে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির দফায় দফায় সুপারিশ দিয়েছে নানা বিষয়ে। কিন্তু এসব সুপারিশ কমই আমলে নিয়েছে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ। কমিটির কয়েকজন সদস্য তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন।
পরামর্শক কমিটির সুপারিশ কি পরিমাণ বাস্তবায়ন হয়েছে-জানতে চাইলে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য, দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়ন দেখছি না। হতাশ হয়েছি। সনু্তষ্ট হতে পারছি না। আমাদের দেয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে আরো কিছু সুপারিশ দিতাম। বড় কোন এলাকা লকডাইন দেয়া হচ্ছে না। টেস্টিং কিট সংকট। এ সপ্তাহে কমিটি আবারো মিটিংয়ে বসতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন চালু করতে হবে। মনিটর জোরদার করতে হবে। এসব বিষয়ে আগেই পরামর্শ দেয়া হয়েছে। প্রথমে এপ্রিল মাসের শেষদিকে পরামর্শ কমিটি আটটি সুপারিশ দিয়েছিল। সর্বশেষ ১০ই জুন ৫টি সুপারিশ দেয় এই কমিটি। পরামর্শ কমিটি তাদের সর্বশেষ সুপারিশে বলেছিল, করোনার রোগের বিস্তার বন্ধ করতে সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণ নিশ্চিত করার জন্য পূর্ণলকডাউন দিতে হবে। কমিটি জীবন এবং জীবিকার সামঞ্জস্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করে সারা দেশে আক্রান্ত ও ঝুঁকির মাত্রার ভিত্তিতে যতটা বড় এলাকায় সম্ভব জরুরিভাবে লকডাউনের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করে পরামর্শক কমিটি। কিন্তু দেশে বড় কোনো এলাকা এখন পর্যন্ত লকডাউন চোখে পড়েনি। এছাড়া পরামর্শক কমিটি অত্যন্ত জরুরিভিত্তিতে সব হাসপাতালে হাই- ফ্লো অক্সিজেন থেরাপির প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে চালু করার কথা বলে। হাই-ফ্লো অক্সিজেনসহ চিকিৎসার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদানসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জন্য আলাদা হাসপাতাল চালুর পরামর্শ দেয়া হয়।
সরকার টেস্টের মানোন্নয়ন ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরীক্ষার ফলাফল নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ দেয় কমিটি। যতদিন সময় কমানো সম্ভব না হয়, পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা না করে সন্দেহজনক রোগীর চিকিৎসা/আইসোলেশন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ কমিটি এর আগে ২৮শে এপ্রিল পরামর্শক কমিটির দ্বিতীয় সভায় কমিটি ৮টি পরামর্শ সুপারিশ করেছিল। হাসপাতাল সেবার মান বৃদ্ধির বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়। স্বয়ংসম্পূর্ণ ও প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালগুলোকে কোভিড-১৯ এর রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্বাচন করাই যুক্তিযুক্ত ও সমীচীন হবে বলে তারা মত দেন। হাসপাতালসমূহ মৃদু থেকে মাঝারিভাবে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য রাখা বাঞ্ছনীয়। কমিটি সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার অংশ হিসেবে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা পর্যায়ক্রমে শিথিল করার জন্য বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করার সুপারিশ করে কমিটি। কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য যে হাসপাতালগুলো নিয়োজিত আছে, সেখানে বিভিন্ন বিষয়ের যথেষ্ট জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ চিকিৎসক থাকতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার জন্য নিয়োজিত ওয়ার্ড বয় ও পরিচ্ছন্নকর্মীদের সংখ্যা বাড়িয়ে সেবার মান উন্নত করতে হবে। সুপারিশে বলা হয়, স্বাস্থ্য সেবাকর্মী, চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত মানসম্মত সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করতে হবে। বিশেষত যারা মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত ও সংক্রমিত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকেন তাদের জন্য রেসপারেটরি মাস্ক সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। সুরক্ষা সামগ্রীসমূহ যাতে মানসম্পন্ন হয় তা নিশ্চিত করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি থাকা দরকার। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত হাসপাতালসমূহে রোগী, চিকিৎসক ও অন্যান্য সকলের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এজন্য যথেষ্ট সংখ্যক পানি-ফিল্টার এর ব্যবস্থা করা দরকার বলে তারা মনে করেন। কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত হাসপাতালসমূহে রোগীদের চিকিৎসার জন্য অতিপ্রয়োজনীয় টেস্ট এর ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয় এবং এসব পরীক্ষাসমূহ নিশ্চিত করতে হবে। কোভিড পরীক্ষা ভর্তির পরও করা যেতে পারে। যে সমস্ত রোগীর উন্নতি হয়েছে এবং ছাড় পাওয়ার যোগ্য তারা পর পর দুইটি কোভিড টেস্ট নেগেটিভ না হওয়া পর্যন্ত ছাড়া পান না। সে কারণে হাসপাতালসমূহের একটা বিরাট অংশের বিছানায় এরা অবস্থান করছেন। যা এইসব হাসপাতালের বিছানার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এ জন্য যারা ছাড়া পাওয়ার যোগ্য কিন্তু এখনো দুইটি টেস্টের রিপোর্টে পাননি। তাদের জন্য আলাদা আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এটা বাড়িতে বা অন্যত্রও হতে পারে। অধিক সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যাতে বিঘ্নিত না হয় সে জন্য পূর্বপরিকল্পনা ও প্রস্তুতি থাকার পরামর্শ দিয়েছিল কমিটি। কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, রোগী সেবার মান বৃদ্ধির জন্য কয়েকটি কর্মপদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত মা, শিশু, নবজাতক, হৃদরোগ ও কিডনি ফেইলিওর রোগীদের চিকিৎসার জন্য আলাদা আলাদা সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে। চিকিৎসাকর্মী, রোগী ও রোগীদের স্বজন বিশেষভাবে মানসিক চাপে থাকেন এবং উদ্বেগ, হতাশা ও ভীতিতে ভোগেন, তাদের মানসিক সহায়তার জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি সহায়তা প্যানেল গঠন করা হয়েছে। এই বিশেষজ্ঞরা টেলিফোনে পরামর্শ দেবেন। তীব্রভাবে আক্রান্ত বা মুমূর্ষু রোগীদের জন্য নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন। এজন্য যথেষ্ট নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র সারা দেশের সব কোভিড রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত হাসপাতালে তৈরি করার সুপারিশ দেয়া হয়।
বর্তমানে শুধুমাত্র উপসর্গসহ যেসব রোগী কোভিড নির্ণয় কেন্দ্রসমূহে আসেন, তাদেরই পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কমিউনিটিতে যে সমস্ত মানুষের উপসর্গ আছে কিন্তু রোগনির্ণয় কেন্দ্রে আসছেন না, তাদের খুঁজে বের করে টেস্টের আওতায় আনার সুপারিশ করে পরামর্শক কমিটি। দফায় দফায় কমিটি এমন নানা সুপারিশ করলেও এ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়েছে অনেক কম। এছাড়া যেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে তা ধীর গতিতে। সর্বশেষ দেশে সংক্রমণের হার অনুযায়ী এলাকা ভিত্তিক লকডাউন করার যে পরামর্শ দিয়েছিল তাও পুরো বাস্তবায়ন হয়নি এ পর্যন্ত। সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা রাজধানীর রেড জোনগুলো এখনও চিহ্নিত হয়নি। এসব এলাকায় লকডাউন দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে কমিটি। এর আগে ৬৬ দিন সরকারি ছুটি শেষে অফিস ও গণপরিহন খুলে দেয়ার সময়ও কমিটি ভিন্ন মত দিয়েছিল। ওই সময় কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল আগে থেকে পরিকল্পনা না নিয়ে এভাবে খুলে দিলে সংক্রমণ বাড়তে পারে। পরে অবশ্য কমিটির এই আশঙ্কা অনেকটা প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালগুলোতে প্রস্তুতির যেসব পরামর্শ আগেই দেয়া হয়েছিল তারও অনেক এখন পর্যন্ত মানা হচ্ছে না। প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গত ১৭ই এপ্রিল ১৭ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় কারিগরি পরামশর্ক কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির কাজ হলো- করোনা বিস্তার রোধে সরকারকে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া।