হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসা সঙ্কটে গ্রামে ভরসা পল্লী চিকিৎসক!

0

আকরামুজ্জামান ॥ করোনা পরিস্থিতির কারণে যশোরে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জেলার সদর হাসপাতালসহ প্রাইভেট হাসপাতালগুলো খোলা থাকলেও বন্ধ রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বার। ইতোমধ্যে জেলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এসব কারণে ওই চিকিৎসক-নার্স এখন কোয়ারেন্টাইনে আছেন। ফলে যশোরের শহর থেকে গ্রামাঞ্চলের মানুষের একমাত্র ভরসা হয়ে পড়েছে ১৫ হাজার পল্লী চিকিৎসক। করোনা পরিস্থিতিতে চরম ঝুঁকি নিয়ে তারা মানুষের সেবা করে গেলেও এসব পল্লী চিকিৎসকদের খোঁজ কেউ নিচ্ছেন না। ফলে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন এ পেশার মানুষগুলো।
দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পরপরই যশোরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হতে থাকে। অঘোষিত লকডাউনের কারণে চারদিকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জেলা সদরসহ উপজেলা সদর ও বিভিন্ন স্থানে থাকা বেসরকারি হাসপাতালগুলো খোলা থাকলেও সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চেম্বার না বসার কারণে দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ রোগীরা। ফলে গত কয়েক মাস ধরে মৌসুমি নানান রোগে আক্রান্ত হওয়া সাধারণ রোগীরা কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা না পাওয়ায় গ্রামের পল্লী চিকিৎসকরাই তাদের একমাত্র ভরসা হয়ে দেখা দেয়।
শুক্রবার যশোর দড়াটানা হসপিটালে চিকিৎসা নিতে আসা আব্দুর রহমান নামে একজন রোগী জানান। তিনি এই হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আবুল ফজলের কাছে নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। গত দুই মাস ধরে তিনি চেম্বারে বসেন না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে জানিয়ে দিয়েছেন যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকার কারণে ঢাকা থেকে তিনি আসতে পারছেন না। তাই আরও কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসক না পেয়ে এলাকায় ফিরে যাচ্ছি। গত দুই মাস ধরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না পেয়ে কী অবস্থায় আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিরুপায় হয়ে এখন গ্রাম্য ডাক্তারের কাছ থেকে গত প্রায় দেড়মাস ধরে ওষুধ খাচ্ছি। এছাড়া আর উপায় কী।
জয়নাল গাজী নামে আরেকজন রোগী বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সামান্য জ্বর ও সর্দি-কাশির কথা শুনলেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রোগীদের। অথচ সেই রোগীকে গ্রামের পল্লী চিকিৎসকরাই সেবা দিয়েছেন। এর জ্বলন্ত প্রমাণ আমি নিজেই। আমার ১০ বছরের শিশু সন্তানের জ্বর-কাশি নিয়ে মনিরামপুর উপজেলা হাসপাতালে গিয়ে কোনো চিকিৎসা না পেয়ে স্থানীয় এক পল্লী চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি ওষুধ দিয়ে দেন। তারপর সে সুস্থ হয়ে ওঠে। জেলার বাঘারপাড়া বাজারের পল্লী চিকিৎসক হাফিজুর রহমান বলেন, করোনার এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। জ্বর- সর্দি, কাশি নিয়ে আসা মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় অনেক জটিল রোগীরাও আমাদের কাছে আসছেন। অথচ আমাদের কোনো খোঁজ-খবর নিচ্ছে না কেউ। তিনি বলেন, যশোর জেলায় এ পেশার সাথে অন্তত ১৫ হাজার মানুষ রয়েছে। এসব গ্রাম্য ডাক্তাররা এখন চরম মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। অথচ সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা প্রণোদনা বা সহযোগিতা অব্যাহত থাকলেও আমাদের কথা কেউই ভাবছেন না। চুড়ামনকাঠি বাজারের পল্লী চিকিৎসক অরবিন্দু নাথ বলেন, বৈশ্বিক এ করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা গ্রামের অসহায় মানুষের সেবা করে যাচ্ছি। গ্রামের অনেক হতদরিদ্র মানুষকে বিনা পয়সায় চিকিৎসাও দিয়ে আসছি। কোনো জটিল রোগী আসলে তাদেরকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিই। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে যদি আমরা না থাকতাম তাহলে গ্রামাঞ্চলের চিকিৎসা সেবার কী ভয়াবহ পরিস্থিতি হতো তা বলার কোনো উপায় থাকতো না। অথচ পরিতাপের বিষয় অনেকেই আমাদেরকে ডাক্তার হিসেবে স্বীকৃতি পর্যন্ত দিতে চান না।
আজিজুল ইসলাম নামে আরেক পল্লী চিকিৎসক বলেন, করোনা পরিস্থিতি জেলা উপজেলার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য পিপিইসহ নানা সহযোগিতা করা হলেও আমাদের বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই কারোর। আমরা এসব ক্ষেত্রে একেবারেই উপেক্ষিত। অথচ এই দুঃসময়ে আমরাই এখন সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসা। তিনি বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গ্রাম্য ডাক্তারের জন্য সরকারি সহযোগিতার প্রত্যাশা করেন।
বাংলাদেশ গ্রাম ডাক্তার কল্যাণ সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও যশোর জেলা শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কে এম মাসুদ পারভেজ বলেন, এ পরিস্থিতির মধ্যে গোটা যশোর জেলায় ১৫ হাজার পল্লী চিকিৎসক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। অথচ এসব পল্লী চিকিৎসকদের বিষয়ে কোনো সুযোগ সুবিধা রাখা হচ্ছে না সরকারি বিভিন্ন ঘোষণায়। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসক-নার্সসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে যেভাবে প্রণোদনার আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছেন ঠিক পল্লী চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও এমন সিদ্ধান্ত আসবে বলে প্রত্যাশা করছি। এ বিষয়ে যশোর জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. শেখ আবু শাহীন বলেন, সরকারিভাবে ট্রেনিং প্রাপ্ত যেসব পল্লী চিকিৎসকরা গ্রামের মানুষকে সেবা করছেন এটি খুবই ভালো দিক। তবে কেউ যদি কোনো ট্রেনিং ছাড়াই নিজেকে চিকিৎসক দাবি করে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন তা দুঃখজনক। তিনি বলেন, যশোরের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক-নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হলেও সরকারি হাসপাতালগুলোতে কোনো চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে না। হাসপাতালগুলোতে রোগীর উপস্থিতি কম থাকায় ডাক্তাররা নিয়মিতভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন বলে তিনি দাবি করেন।