এ এক অন্য বাংলাদেশ

0

নূরে আলম জিকু
বিশ্বজোড়া করোনার তাণ্ডব। দেশে দেশে মৃত্যুর মিছিল। মানুষের অসহায়ত্ব। আতঙ্ক। ভয়। কারওই যেন কিছু করার নেই। প্রেম ভালোবাসা ছিটকে পড়েছে বহু দূরে। মানবিকতা হারিয়ে গেছে সমাজ থেকে। এমনই এক সময় আশার আলো দেখায় কিছু মানুষ। তাদের দেখে মনে হয় এ এক অন্য বাংলাদেশ। মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এসব মানুষ। করোনা ভয় দূরে ঠেলে তারা এগিয়ে এসেছেন মানবিক হয়ে। মানবতার বার্তা নিয়ে হাজির হচ্ছেন মানুষের সামনে। করোনা মহামারীর মধ্যে নিজের জীবনের ঝুঁকি জেনেও কাজ করছেন অন্যের কল্যানে। দিন রাত নিজেকে নিয়োজিত রাখছেন মানব সেবায়। রাস্তায় ক্ষুধার্থ মানুষের মুখে তুলে দিচ্ছেন খাবার। দিচ্ছেন চিকিৎসা সেবা। করোনায় আক্রান্ত ব্যাক্তির লাশ করছেন সৎকার। এমনই একজন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। তিনি করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাহসিকতার সঙ্গে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নিজের যা আছে তা নিয়েই করছেন মানবসেবা। বিপদগ্রস্থ মানুষের কল্যানে ছুটে চলেন সব সময়। দল মত নির্বিশেষে সবার প্রশংসার জোয়ারে ভাসা এই মানুষটিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ বলছেন ‘করোনা বীর’, কেউ বলছেন মানবতার ফেরিওয়ালা। স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমানও তাকে ‘বীর বাহাদুর’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। করোনায় মৃত ব্যাক্তির লাশ কেউ সৎকার করতে আসছে না। পাড়া প্রতিবেশি, বন্ধু, বান্ধব সবার দরজা যখন বন্ধ হয়ে গেছে। তখনই খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান কাউন্সিলর খোরশেদ। মৃতের মুখাগ্নি করেন খোরশেদ। এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। শুধু তাই নয়, তার উদ্যোগে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন করোনা আক্রান্ত ও স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু হওয়া মানুষের দাফন ও সৎকারের কাজ তিনি করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী খোকন সাহা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কনোরার ভয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মত কেউ এগিয়ে আসেননি। পরে স্ত্রী ও ছোট দুই মেয়ে তাকে ধরে নিচে নামানোর সময় সিঁড়িতেই মারা যান তিনি। কেউ এগিয়ে আসেনি লাশ দাহ করতে। দীর্ঘক্ষণ মরদেহ পড়েছিল সিঁড়িতেই। বাবার মৃত্যুতে মেয়েদের কান্নায় কারও মন গলেনি সেদিন। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। লাশ নিয়ে যান দাহ করতে। পরিবারের অনুমতি নিয়ে খোকন সাহার মুখাগ্নির কাজটিও করেন কাউন্সিলর। এভাবেই করোনার দুঃসময়ে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪০টি লাশের সৎকার করেছেন। করোনার শুরুতে বিভিন্ন এলাকায় বেসিন ও পানির পাশাপাশি ক্ষারযুক্ত সাবানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেছেন মানুষের জন্য। যখন হ্যান্ড স্যানিটাইজারের সংকট ছিল তখন তিনি নিজেই হাজার হাজার বোতল হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুত করে বিলিয়েছেন। এরপর খাদ্য সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন। সড়কে নেমে সড়ক ও যানবাহন জীবাণুমুক্ত করতে কাজ করছেন তিনি। এলাকায় এলাকায় জনসচেতনতায় মাইকিং করছেন। ফোন পাওয়া মাত্র নিজের স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে কোয়ারেন্টিনে থাকা পরিবারগুলোর জন্য ওষুধ ও খাদ্য সামগ্রী দিন রাত সরবরাহ অব্যাহত রেখেছেন। এছাড়া করোনা প্রতিরোধে ও করোনা আক্রান্ত সন্দেহভাজন রোগীদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের লক্ষ্যে চালু করেছেন টেলি মেডিসিন সেবা। স্থানীয়রা ফোন করলেই বিনামূল্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎকের মাধ্যমে সেবা দেয় হচ্ছে। তিনি ৫ সদস্যের একটি চিকিৎসক টিমও গঠন করে দিয়েছেন। যারা প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে গিয়ে চিকিৎসা সেবা দেন। খোরশেদ আলমের মতো মানব সেবায় নিয়োজিত আছেন, মিলন হাসান ও জেবা হাসান দম্পতি। ভালোবেসে বিয়ে করেও জীবনের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করেছেন মানবসেবার মধ্য দিয়ে। স্বরণীয় এই দিনটিকে তারা উৎসব না করে অসহায় ২০টি পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তাদের ভালোবাসার উপহার সামগ্রী। দেশে করোনা শনাক্তের পর থেকেই গোপনে নিজ এলাকার মানবসেবায় নিয়োজিত আছেন অ্যাডভোকেট ও সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম। কার্যত লকডাউনের মধ্যেই মানুষের বাসায় চিকিৎসা সামগ্রী ও খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। নিজস্ব অর্থায়নে অনেকটা গোপনে গরীব ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। করোনার এই ভয়াল পরিস্থিতিতে দিন নেই- রাত নেই হরদম ছুটছেন তিনি। খোঁজ রাখছেন ভোলায় কষ্টে থাকা মানুষের হাড়ির খবর। যার উনুনে জ্বলছে না আগুন, যার ঘরে নাই দু’মুটো চাল-ডাল, দাঁড়াচ্ছেন তাদের পাশে। বাড়িয়ে দিচ্ছেন সহায়তার হাত। কথা হলে তিনি জানান, মানবসেবা করে প্রচার করতে চাই না। আমাদের ধর্মে তো আছে গোপনে দান করার । তাই গরীব ও অসহায়দের নিরবেই দান করছি। করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন আরেক মানবতার সৈনিক। বগুড়া পৌর এলাকার ২১ নং ওয়ার্ডে প্রায় ১৪ হাজার দুস্থ মানুষকে প্রতিদিন একবেলা খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নান আকন্দ। বন্ধুর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তার সঙ্গে যোগ দেন আরেক ব্যবসায়ী নাহারুল ইসলাম।
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার সুখিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য মো.এরশাদ উদ্দিন। সরকারিভাবে কয়েক দফায় ২৬ জন পরিবারের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেন। এতে মনে শান্তি মেলেনি। তিনি উপলব্ধি করেন সরকারি এ বরাদ্দে তার ওয়ার্ডের কিছুই হবেনা। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন করোনার এ দুর্যোগে অসহায় মানুষের পাশে যেভাবেই হোক দাঁড়াতে হবে। পরে নিজের শখের মোটরসাইকেলটি বিক্রি করে দেন। বিষয়টি তিনি তার স্ত্রীর সাথে শেয়ার করলে স্ত্রীও তার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান এবং নিজের গহনা বিক্রি করার কথা স্বামীকে জানান। পরে মোটরসাইকেল বিক্রি, স্ত্রী গহন বিক্রি ও আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে তিনি টাকা সংগ্রহ করেন। এ টাকা দিয়ে তিনি তার নির্বাচিত এলাকা কোষাকান্দা গ্রামসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের ৭’শ পরিবারের মাঝে খাদ্য সামগ্রী হিসেবে চাউল ও ডাল বিতরণ করেন। দেশে করোনার এই দু:সময়ে ক্ষুধার্থ মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন আরো অসংখ্য মানুষ। সংগঠন থেকে শুরু করে ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। সংগঠনের দিক থেকে একটি নাম বরাবরই উঠে এসেছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ ৫ লাখ শ্রমজীবী পরিবারের সদস্যদের কাছে খাবার পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের লক্ষ্য ৫’শ টন চাল-ডাল-লবন-তেল পৌঁছে দেয়া। এছাড়া চিকিৎসা সমগ্রীসহ চিকিৎসদের পিপিই প্রদান করা হচ্ছে। জনগণের কাছ থেকে অর্থ নিয়েই এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারা। অসহায়দের পাশে আরো এগিয়ে এসেছে পে ইট ফরওয়ার্ড বাংলাদেশ, শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশন, ডু সামথিং ফাউন্ডেশন, মজার স্কুল, হিউম্যান ইফোর্টস ফর লোকাল পিপল (হেল্প), একমুঠো চাল, অভিযাত্রিক ফাউন্ডেশন ইত্যাদি বহু সংগঠন। করোনায় দুর্গতদের জন্য ত্রাণ তহবিলে টাকা দান করেন নজির কেড়েছেন ভিক্ষুকও। স্কুলগামী শিক্ষার্থীরাও তাদের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে জমা দিয়েছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও তাদের বেতনের একটি অংশ দান করছেন এই তহবিলে। রাজধানীর কাজী পাড়ায় বসবাস করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বরাবরই দান করেন বিভিন্ন সংস্থায়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাসার কাজের মহিলাসহ আশপাশের ৮টি পরিবারের ডাল-ভাত খাওয়ার মতো সামগ্রী পৌঁছে দেন তিনি। তিনি বলেন, যখন জানতে পারি আমার বাসার কাজের লোকের বাসায় খাবার নাই। সেই মুহুর্তে আমার কাছে টাকা ছিল না। তখন ধার করে টাকা নিয়ে তাদেরকে উপহার পৌঁছে দিয়েছি। ডাকসু সদস্য তানভীর হাসান সৈকত। অসহায় ও ভাসমান মানুষের জন্য প্রতিদিন দু’বেলা খাবার দেয়ার লক্ষ্যে মাসখানেক ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এদিকে রংপুরের একটি বস্তির বয়স্ক মহিলা প্রায় ৪ দিন ধরে মুড়ি খেয়ে জীবন ধারণ করছেন। পরে তিনি অসুস্থ হয়ে বাসা থেকে বের হতে পারছেন না। এমন তথ্য ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লোকের সহযোগিতার কারণে তার ঘরে খাবার ভরে গেছে। পরে সেই খাবার থেকে তিনি বস্তির ছোট বাচ্চাদের জন্য খিচুড়ি রান্নার ব্যবস্থা করেন। এ তালিকায় আছেন রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান আসাদ। করোনা থাবা মেলার পরই তিনি মাঠে নামেন। দরিদ্র অসহায়দের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করেন নিজ উদ্যোগে। প্রতিদিন ৫০০ জনকে রান্না করা খাবার দেন। মানুষকে ঘরে রাখতে বিনামূল্যে সবজি নিয়ে হাজির হন দ্বারে দ্বারে।
সর্বশেষ আলোচনায় এসেছেন এক ডাক্তার। করোনাকালে যেখানে বহু ডাক্তার করোনা চিকিৎসা সেবা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে নানা ফন্দি করেন। কেউ ছুটি নিয়ে চলে গেছেন। কেউ হাসপাতালে গেলেও করোনা রোগীর ধারে কাছে যান না। করোনা সংক্রমনের ভয়ে যেখানে সরকারি হাসপাতালে পিপিই সংকটসহ নানা অজুহাত দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেক চিকিৎসক, চাকরিচ্যুত করার কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েও যেখানে অনেককে কর্মস্থলে ফেরানো যাচ্ছে না। এমনকি প্রাইভেট চেম্বারেও যেখানে রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক ডাক্তার। সেখানে শুধুমাত্র করোনা রোগীকে চিকিৎসা দেবার জন্য আবেদন করে সর্বাধিক করোনা আক্রান্ত এলাকায় স্বেচ্ছায় বদলি হয়েছেন ডা. মো. মশিউর রহমান। তিনি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু সেখানে করোনা রোগী না থাকায় সর্বাধিক করোনা আক্রান্ত এলাকায় গিয়ে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার সংকল্প নিয়ে নিজেই আবেদন করে নারায়ণগঞ্জ বদলি হন।
ডা. মশিউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় কর্মরত ছিলাম। কিন্তু সেখানে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত কোনো করোনা রোগী ছিল না। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে আমাদের চিকিৎসকরা করোনা রোগীদের চিকিৎসা করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু চিকিৎসক সবজায়গায় সীমিত। আমি ভেবে দেখলাম সিরাজগঞ্জে বসে থেকে কোনও লাভ নেই। তাই মনে মনে ইচ্ছা জন্মালো আমি যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সেবা করতে পারতাম। জাতির এইসময় যদি পাশে দাড়াতে পারি তাহলে আমার মেধা ও পরিশ্রম সার্থক হবে। তাই আমি নিজেই ২৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরে মহাপরিচালক বরাবর নারায়ণগঞ্জে বদলি হওয়ার আবেদন করলাম। দুদিন পর ২৭ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে চিকিৎসক মশিউর রহমানের নারায়ণগঞ্জে বদলির আদেশ জারি হয়। ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে বদলির অর্ডার হওয়ার পরপরই তিনি নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন। মশিউর রহমান বলেন, আমি মানুষের দুরবস্থা দেখে সেবার ইচ্ছা নিয়েই এখানে চলে এসেছি। আমি যখন আসি তখন এখানে আমাদের কয়েকজন সহকর্মী আক্রান্ত ছিলেন। তবে সবাই রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা করছেন।’