কোভিড-১৯ বাংলাদেশের ক্ষতি কত, বিশ্বের ক্ষতি কত

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ শুধু জীবনের ওপরে নয়, সমাজের এমন কোনো বিষয় বা খাত নেই, যেখানে আঘাত হানেনি নতুন করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। হয়তো আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যেই ভাইরাসটির সংক্রমণ কমে যাবে। কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাব থাকবে অনেক বছর। কত বছর—তার কোনো সঠিক অনুমান এখনই করা সম্ভব নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে ১৯২৯ সালের বিশ্বমন্দার প্রভাব ছিল টানা ১০ বছর।
করোনাভাইরাসের খারাপ প্রভাবে বৈশ্বিক আর্থিক ক্ষতি কত হতে পারে তা অনুমান করাও এই মুহূর্তে কঠিন। চূড়ান্ত ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করবে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস কত লম্বা সময় ধরে থাকবে, তার ওপর। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গবেষণা করে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা গত মার্চে বৈশ্বিক ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করেছিল দুই লাখ ৭০ লাখ কোটি মার্কিন ডলার (দুই দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার)। এই পরিমাণটি যে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির মোট আকারের সমান, তাও বলা হয়েছিল। হিসাবটি অবশ্য গত মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত।
এক মাস পার হওয়ার পর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে বিশ্বব্যাংক হিসাব করে বলেছে, ক্ষতির পরিমাণ হবে ৯ লাখ কোটি ডলার (৯ ট্রিলিয়ন ডলার)। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপিনাথ অঙ্ক করে দেখিয়েছেন পরিমাণটি জাপান ও জার্মানির অর্থনীতির আকারের সমান।
দেখা যাচ্ছে, দিন গড়াচ্ছে আর ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। অর্থাৎ এক মাসেই বৈশ্বিক ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করা হয়েছে তিন গুণ বেশি। ধরে নেওয়া যায়, চলতি মে মাসের মাঝামাঝি নাগাদ ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে অন্তত ১৫ লাখ কোটি ডলারের সমান।
যৌথভাবে জাপান ও জার্মানির অর্থনীতির আকার হচ্ছে ৯ লাখ কোটি ডলারের কাছাকাছি। এভাবে শুধু অঙ্ক দিয়ে অবশ্য বৈশ্বিক ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে ভালো কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। বোঝার জন্য বা পরিস্কার হওয়ার জন্য আমরা এখন বাংলাদেশের বাজেটের দিকে তাকাতে পারি। এমনকি এক বছরের রাজস্ব আয়কেও সামনে আনা যায়। যেমন-চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ৩ লাখ ২৫হাজার ৬০০ কোটি টাকা আয় করবে বলে ধরা হয়েছিল। এ আয় এখন আড়াই লাখ কোটি টাকা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। ডলারে রূপান্তরিত করলে এই অর্থ হয় ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলারের সমান। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল কয়েক মাস আগে জানিয়েছিলেন আগামী ২০৩৪ সালে বাংলাদেশের বাজেটের আকার হবে ১ লাখ কোটি ডলার। অর্থাৎ বর্তমান বাজেটের তুলনায় অন্তত ১৬ গুণ বড়।
নয় লাখ কোটি ডলারের হিসাব মিলিয়ে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে চলতি অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের যে বাজেট, এ রকম ১৪৫টি বাজেটের সমান অর্থ। এটি যেহেতু বৈশ্বিক অর্থনীতির হিসাব, এর মধ্যে বাংলাদেশের হিসাবও আছে। আর ১৫ লাখ কোটি ডলার বিবেচনায় নিলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে বাংলাদেশের বতর্মান বাজেটের সমান অন্তত ২৫০টি বাজেটের আকারের সমান।
বাংলাদেশের ক্ষতি নিয়ে আলাদা কোনো হিসাব বা অনুমান এখন পর্যন্ত বড় কেনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান করেনি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদের নেতৃত্বাধীন একটি দল এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রভাবে আর্থিক ক্ষতি নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত এক মাসের জন্য দলটি অর্থনীতির প্রধান তিন খাত অর্থাৎ কৃষি,শিল্প ও সেবা খাতের সম্ভাব্য ক্ষতিগুলো চিহ্নিত করেছে।
খাতগুলোর মধ্যে যে আবার অনেক উপ খাত রয়েছে, তাও উল্লেখ করা হয়েছে দলটির প্রতিবেদনে। গবেষণায় এসেছে, প্রধান তিন খাতে প্রতি দিনের ক্ষতি গড়ে তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সে হিসেবে ৩১ দিনের ক্ষতি হয় এক লাখ ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। তবে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত হিসাব করলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা।
চীন, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার উদাহরণ টেনে সৈয়দ আবদুল হামিদের নেতৃত্বাধীন দলটির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে লকডাউন বা অবরুদ্ধ পরিস্থিতি চলতি মে এমনকি আগামী জুন মাস পর্যন্তও চলতে পারে। পুরো মে মাস হিসাবে আনলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে তাঁর গবেষণা বলছে। এ অঙ্ক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৯ শতাংশ এবং চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কমর্সূচির (এডিপি) আকারের চেয়েও বেশি।
এ ক্ষতি কতগুলো প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে আমাদের। নিশ্চিতভাবেই বোঝা যাচ্ছে বাজেটে ঘাটতি বাড়বে। চলতি অর্থবছরে তো বটেই, আগামী অর্থবছরেও বাড়বে বাজেট ঘাটতি। ঘাটতি পূরণে সরকার সাধারণত ঋণ নিয়ে থাকে। কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, স্বল্প সুদের বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে আমাদের। ফলে ঘুরে ফিরে ওই ব্যাংক ঋণ। সরকার ব্যাংক ঋণ বেশি নিলে বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যায় ব্যাংকগুলোর। অথচ বাংলাদেশের অর্থনীতিই হচ্ছে বেসরকারি খাত নির্ভর।
দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মন্দেরও ভালো দিক আছে, যদি তা থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়। করোনাভাইরাস এক অর্থে আমাদের চোখও খুলে দিয়েছে। শুধু স্বাস্থ্য খাতের দুর্বল চিত্র উন্মোচন করে দেয়নি; নামকাওয়াস্তের সুরক্ষা, প্রশাসনিক দুর্বলতা, বাস্তবায়ন সমস্যা, বণ্টন দুর্বলতা, আর্থিক তথা রাজস্ব খাতের অব্যবস্থাপনা, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার অদক্ষতা ইত্যাদি চোখের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শুধু স্বাস্থ্য নয়, প্রায় সব খাতেই যে সংস্কার দরকার, সরকার এখন তা বুঝলেই হয়।