যশোরে মদপানে একাধিক মৃত্যুর খবরে তোলপাড়া, এক কারবারি আটক

0

স্টাফ রিপোর্টার॥ ভেজাল অথবা বিষাক্ত মদে যশোর জেলার তিন উপজেলায় বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর পর প্রশাসনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। নজর পড়েছে যশোরের পতিতালয় এলাকার অবৈধ মদের দোকানগুলোর উপর। তবে প্রশাসন তাৎণিক ব্যবস্থা নিয়েছে এক স্থানের অবৈধ মদ ব্যবসায়ীদের উপর। মাড়–য়ারি মন্দির এলাকার মদের দোকানগুলোর উপর নজর দিলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বাবুবাজার পতিতালয় এলাকায়। বিষাক্ত মদে যশোর, মণিরামপুর ও ঝিকরগাছায় আট জনের মৃত্যুর খবরে শুক্রবার রাত থেকেই তৎপর হয়ে উঠেছে পুলিশও। ইতিমধ্যে আটক করা হয়েছে বেআইনি মদ বিক্রেতা হাসানকে। গতকাল শনিবার দুপুরের পর মাঠে নামেন ভ্রাম্যমাণ আদালতও। অভিযানে যুক্ত হন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও। গতকাল একাধিক সংবাদপত্রে মদপানে যশোরে চারজনে মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়। মৃতদের অধিকাংশই যশোর পতিতালয় এলাকার অবৈধ মদের দোকানগুলোর খরিদ্দার। মৃতদের অন্তত দুইজনকে ‘অ্যালকোহলজনিত বিষক্রিয়া’ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল বলে রিপোর্টটিতে উলেখ করা হয়। শনিবার দিনভর খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একই কারণে চিকিৎসা গ্রহণকারীর সংখ্যা আরো বেশি; যাদের মধ্যে একজন গতকাল হাসপাতালে মারাও গেছেন। বিষাক্ত অ্যালকোহল পানে মণিরামপুর থেকেও কয়েকজনের মৃত্যুর খবর এসেছে। যদিও ঠিক কী কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে, তা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি।
যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ যে ব্যক্তির মৃত্যু হয়, তার নাম শাহিন (৩৫)। এছাড়া একই হাসপাতালে মো.রুবেল নামে (৩০) নামে আরেকজনকে চিকিৎসারত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তিনিও মদের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। মৃত শাহিন যশোর শহরতলীর শেখহাটি এলাকার আশরাফ আলীর ছেলে। আর চিকিৎসাধীন রুবেল মণিরামপুর উপজেলার মোহনপুর অফিসপাড়ার নুর মোহাম্মদ গাজির ছেলে। যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ডাক্তার দেলোয়ার হোসেন বলেন, অ্যালকোহলজনিত বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত শাহিন হোসেন নামে এক যুবককে শুক্রবার দিনগত রাত পৌনে ১২টায় ভর্তি করা হয়। মো. রুবেলকেও একই কারণে একই রাতে একটা ৫০ মিনিটে ভর্তি করা হয়। জরুরি বিভাগ থেকে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে মেডিসিন ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। মেডিসিন ওয়ার্ডের চিকিৎসক আরাফাত আল-মামুন সকালে বলেছিলেন, অ্যালকোহলিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত শাহিন হোসেন এবং মো. রুবেল শঙ্কামুক্ত আছেন। ডাক্তার শঙ্কা না থাকার কথা বললেও এর অল্প সময় পর শাহিন মারা যান। দুপুর দুইটার দিকে শাহিনের ভাই বুলবুল একই বিভাগের এক ইন্টার্ন ডাক্তারের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, বেলা ১২টা ৩৫ মিনিটে তার ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। বুলবুল অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার ভাই ভেজাল ও বিষাক্ত মদ খাওয়ায় তাকে হারালাম।’ অসুস্থ অবস্থায় জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসারত রুবেলের কাছে তার বোন তহমিনা ছিলেন। তিনি বলেন, ‘শুক্রবার রাতে আমার ভাই রুবেল ভেজাল ও বিষাক্ত খায়। অনেক রাতে দেখি, সে (রুবেল) বার বার বমি করছে। মারা যায় যায় ভাব। তখনই তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসি।’ এই নারীর দেওয়া তথ্য মতে, মণিরামপুরে মুক্তার ও মমিনুজ্জামান মমিন নামে দুইজন বিষাক্ত বাংলা মদপানে মারা গেছেন। একই কারণে আরেকজনকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খুলনায় নেওয়া হয়েছে চিকিৎসার জন্য। এক প্রশ্নের জবাবে তহমিনা বলেন, ‘মুক্তার ও মমিনের লাশ কোথায়, তা আমার জানা নেই। তবে ওরা দুইজনই মণিরামপুর আলিয়া মাদরাসার পাশে মদ বিক্রি করতো।’ এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মণিরামপুর থানার ওসি রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার জানা মতে লিভারের সমস্যা নিয়ে মণিরামপুরের দুইজন যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। তাদের মৃত্যু বিষাক্ত মদপানের কারণে কি-না জানি না।’ তবে মদপানে রুবেল নামে মণিরামপুরের একজন হাসপাতালে চিকিসাধীন আছেন বলে জেনেছেন ওসি রফিকুল। মদপানে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে যশোর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা.এবিএম সাইফুল আলম বলেন, মদপানে মানুষের মৃত্যু হয় এমন নজির কম। তবে ভেজালযুক্ত মদ বা স্পিরিট পান করলে মানুষের মৃত্যু হয়। এদিকে, ভেজাল বা বিষাক্ত মদপানে মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর রাত থেকেই তৎপর হয়ে ওঠে প্রশাসন। আটক করা হয় মাড়োয়ারি মন্দির পতিতালয় এলাকার প্রধান মদ বিক্রেতা হাসানকে; যিনি বেআইনিভাবে মদ বিক্রি করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক বনে গেছেন। তবে পাওয়া যায়নি বাবুবাজার পতিতালয় এলাকার মদ বিক্রেতা মোতালেবকে। পুলিশ তার বাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, ভেজাল মদের অন্যতম কারবারি মোতালেব। যশোর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) তৌহিদুল ইসলাম অভিযুক্ত হাসানকে আটকের কথা নিশ্চিত করেছেন। কোতয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপরে সাথে আমিও বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখছি। ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ অন্যদিকে, গতকাল শনিবার বিকেলে ভ্রাম্যমাণ আদালত বহুল আলোচিত হাসানের মদের দোকানে অভিযান চালায়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও যশোরের আরডিসি কেএম আবু নওশাদের নেতৃত্বে অভিযানটিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশ কর্মকর্তারা অংশ নেন। অভিযানে দোকানটিতে রতি মদ সংগ্রহ করা হয়েছে। এই মদ বিষাক্ত কি-না তা জানতে ল্যাবে পাঠানো হবে পরীার জন্য। ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক কেএম আবু নওশাদ অভিযানের কথা নিশ্চিত করেছেন সাংবাদিকদের। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যশোরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক মো. বাহাউদ্দিন বলেন, ভেজাল ও বিষাক্ত মদপানে কয়েকজনের মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় মদের দোকানি হাসানকে আটক করা হয়েছে। ‘ভ্রাম্যমাণ আদালতের নেতৃত্বে হাসানের মদের দোকানের শাটারের তালা কেটে দোকানে ঢুকি আমরা। দোকানটি থেকে মদের স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়েছে। পরীার জন্য এই স্যাম্পল ল্যাবে পাঠানো হবে। পরীার ফলাফল পেলে বোঝা যাবে এই মদ বিষাক্ত নাকি ভেজাল,’ বলছিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা বাহাউদ্দিন। হাসান নামে অভিযুক্ত ব্যক্তির মদ বিক্রির কোনো বৈধ অনুমতি নেই বলে তিনি আজও জানান। তবে শুধুমাত্র মাড়োয়ারি মন্দির পতিতালয় এলাকায় অভিযান চালানোয় এবং বাবুবাজার পতিতালয় এলাকার মদের দোকানগুলোতে কোন অভিযান না চালানোয় স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলেছেন। এবিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যশোরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক মো. বাহাউদ্দিন বলেন, পর্যায়ক্রমে সকল স্থানে অভিযান হবে। যশোরে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির তৈরি মদ বিক্রির লাইসেন্স আছে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের। শুরু এই কোম্পানিগুলোই অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছে মদ বিক্রি করতে পারে। কিন্তু লাইসেন্সধারী কোম্পানির কাছে সরবরাহ করা মদ খুব সহজেই খোলাবাজারে চলে যায়; যাতে আরো স্পিরিট ও পানি মিশিয়ে বিক্রি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। অপরদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ডিপো থেকে অবৈধ পন্থায় গোপনে মদ পাচার হয়ে থাকে। যশোরের বিভিন্ন স্থানের অবৈধ মাদক ব্যবসায়ীরা ওই মদ সংগ্রহ করে তাতে কাঠে ব্যবহারের ডিনেচার স্পিরিট এবং পানি মিশিয়ে বিক্রি করে থাকে। এই ভেজাল মদ পানে হয়ত মাদকসেবীদের মৃত্যু হতে পারে।