অতিথি কলাম : দুনিয়া কোন ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে? 

0

আমিরুল আলম খান
সোশ্যাল মিডিয়া এখন তোলপাড়। দুনিয়া জুড়ে ঘোষিত, অঘোষিত লকডাউন চলছে। সব কিছু স্থাণূর মত দাঁড়িয়ে। অফিস আদালত বন্ধ। কারখানার ঘুরছে না। ব্যবসা বাণিজ্য স্থবির। হাজার হাজার বিমানপোত ঘুমুচ্ছে। লোকোশেডে ঝিমুচ্ছে বুলেট ট্রেন, কিংবা বিলাসবহুল ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেল। বন্দরে বন্দরে নোঙর করে ভাসছে বিশাল বিশাল জাহাজ; কী মাল টানার, কী প্রমোদের। পারমাণবিক যুদ্ধজাহাজে করোনা আতংক। ভিড়তে দিচ্ছে না কোন বন্দর। এক মুহূর্ত একস্থানে বসে সময় যাদের হাতে ছিল না তারাও এখন আঙুল চুষচেন।
না, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যায় নি। বরং যুদ্ধের দামামা এখন বাজিভহেই কম। দুনিয়া থামিয়ে দিয়েছে অতি ুদ্র এক অণুজীব। করোনা বা শিরমুকুট তার নাম! মুকুট এখন সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রু মানব জাতির। গত তিন মাসে করোনা কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৬০ হাজার প্রাণ। আক্রান্ত ১১ লাখের বেশি। এ শুধু স্বীকার করা সরকারি হিসেব। মানুষের বিশ্বাস প্রকৃত সংখ্যা হয় অনেক অনেক বেশি।
দুনিয়া যখন থেমে গেছে তখন সক্রিয় সাইবার জগত। যার যত কেদ্দানি আছে সব নিয়ে সাইবার জগতে কাজের কুল নেই। বুঝা গেল, মানুষ এক মুহূর্ত বসে থাকার জন্য জন্মায় নি। মিডিয়ার ঘুম হারাম। বিজ্ঞানীরা চোখ তুলছেন না কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে। সত্যি, আধা-সত্যি আর গুজবে দুনিয়া এতই জেরবার আসল সত্যি জানে সাধ্যি কার!
ব্রিটেনের রানী বাকিংহাম প্যালেস থেকে পালিয়ে গেছেন। তাতেও রেহাই মিলছে না রাজপরিবারের। সত্তরোর্ধ রাজপুত্র চার্লসকেও ঠেসে ধরেছে করোনা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী সবাই একঘরে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্ত্রীসহ একঘরে। কিন্তু সবাই টেক্কা দিয়েছেন বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে মতাধর রাষ্ট্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহেব। তাকে কেদারায় বসিয়ে আরবি ভাষায় ঝাড়ফুঁক দিচ্ছেন এমন এক ভিডিও এখন ছড়িয়ে পড়েছে তামাম দুনিয়ায়।
বর্তমান দুনিয়ায় মুসলিম বিদ্বেষে ট্রাম্প, নেতানিয়াহু আর মোদির জুড়ি নেই। ওভাল অফিসে ট্রাম্প সাহেব বসলেন ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি। বসার ছ’ দিনের দিন তিনি ফরমান জারি করেন কোন কোন মুসলিম দেশের লোক দুনিয়ায় ‘সাদ্দাতের বেহেস্ত আমেরিকা’ মুলুকে ঢুকতে পারবে না। তা দেখে অন্য সব মুসলমান দেশ তো ট্রাম্প সাহেবের পা ধরে কী কান্নাই না শুরু করেছিল। সে সুযোগ ট্রাম্প ষোলো আনা কাজে লাগান। ট্রাম্প জাত বেনিয়া। পয়লা উড়ালেই গিয়ে নামেন সৌদি বাদশাহের হারেম খানায়। সেখানে গিয়ে সৌদি রাজভাণ্ডার ফতুর করে অস্ত্র বিক্রি করে এসে পেন্টাগনের জেনারেলদের বুঝালেন তিনিই জানেন ব্যবসা কী করে করতে হয়! তারপর হম্বিতম্বি তার লেগেই আছে। ইরানকে শাসাতে লাগলেন। চীনকে হুঁশিয়ারি দিলেন। কিন্তু দরবার করতে গেলেন উত্তর কোরিয়ার ‘ছোট্ট ইঁদুর’টার সাথে। কিন্তু নিজেই ফেঁসে গিয়ে ফিরে এলেন। মুখ বাঁচাতে বললেন, মশা মেরে হাত কালো করার মানুষ তিনি নন। আসলে তাঁর উপায় ছিল না। এশিয় বুদ্ধির কাছে হার মেনে লজ্জায় শরমে ট্রাম্প সাহেবের সে চেহারা যারা টিভি পর্দায় দেখেছেন, তারা জীবনে ভুলবেন না।
‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগান তুলে মার্কিন ভোটারদের মাথা খারাপ করেন ট্রাম্প। মেক্সিকান মোলাটোরা এসে মার্কিন সাদাদের বাড়া ভাতে ছাই দেবার অেিভ্যাগে তিনি মেক্সিকো সীমান্ত জুড়ে প্রাচীর তুলতে চান। আর সে প্রাচীরের খরচাও আদায় করতে চান গরিব মেক্সিকানদের কাছ থেকেই!
ইরানের ওপর শাসানি বজায় রেখেই ট্রাম্প ভাবলেন, সিরিয়া ঠান্ডা করে আসি। পুতিন তার জানের দোস্ত। তাঁর কেরামতিতেই নাকি ট্রাম্পের ওভাল অফিস জাঁকিয়ে বসা। কিন্তু ট্রাম্প বেনিয়া; আর পুতিন সাবেক সোভিয়েতের গোয়েন্দা প্রধান। অনেক দেশের অনেক হিসেব তার ট্যাবেই থাকে। বোতাম নিজেই টিপতে জানেন। ব্যাখ্যাও করতে জানেন। ট্রাম্পকে খানিক এগুতে দিতেই তিনি তো খুসিতে বাগবাগ। ঠিক উপযুক্ত সময়ে দুনিয়ার হিসেব উলটে দিয়ে আসরে নামলেন পুতিন। ট্রাম্প সাহেবের পাগলা ঘোড়া গেল সিরিয়ার পাহাড় আর মরুভূমিতে আটকে।
কিন্তু ততদিনে ল ল সিরিয় ঘরবাড়ি ফেলে পাহাড়ে মরুতে ঘুরছে। অনাহারে জীবন যাচ্ছে তাদের। ইউরোপ দরজা বন্ধ করে দিল। কোন মুসলমানকে তার তাদের দেশে ঢুকতে দেবে না। কেবল জার্মান চ্যাঞ্চেলর মার্কেলই তাদের দু.খে সাড়া দিলেন। কিন্তু তাতে তাঁর নিজের গদিই যায় যায়।
ব্রিটেনে উত্থান হয়েছে এক পাগল গোষ্ঠীর। তাদের নেতা নাইজেল ফারাজে(ঘরমবষ চধঁষ ঋধৎধমব)।তিনি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনকে বের করে নিতে চান। একসাথে থাকলে নাকি এশিয়া, আফ্রিকা তো বটেই ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে লাখে লাখে ব্রিটেন ঢুকে তাদের রুটিরুজি মেরে খাচ্ছে।
এদিকে মাওয়ের পর চীনে সবচেয়ে মতাধর ব্যক্তি শি জিন পিং। তার স্বপ্ন অনেক বড়। তিনি নতুন সিল্ক রোড বানাতে চান। সারা দুনিয়ায় লাল পতাকা উড়ানোর স্বপ্ন তার। নামে কমিউনিস্ট পার্টি, আসলে সর্বসাম্প্রতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মোড়ল। ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ তার আকাশস্পর্শী স্বপ্নের নাম। ত্রিভুবনে তিনিই সেরা হতে চান। নিজেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশের প্রেসিডেন্ট পদে বহাল রাখতে সংবিধান জুড়ে দেওয়া হয়েছে সব বিধিবিধান।
পুতিনকে থুয়ে ট্রাম্প ঘাড়ে চাপলেন চীনের। চীনের খুব বেড়েছে। আমেরিকার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। তামাম দুনিয়া বলছে, আমেরিকার দিন শেষ। ১৯২৯ থেকে প্রায় এক শ বছর আমেরিকা দুনিয়ার কলকাটি নেড়েছে। এবার সে তলোয়ার চীনের নাগালে। চীনের জিনিস না হলে দুনিয়া অচল। ব্রিটিশরা তাদের ফাইভ-জি’র ঠিকেদারি দিয়েছে টেলিকম জায়ান্ট হুয়াওয়ে কোম্পানিকে। আপেল, স্যামসং তার কাছে মার খাচ্ছে। হুয়াওয়েকে থামাতে হবে। ট্রাম্প ব্রিটিশদের গায়ে পড়ে খবরদারি করতে গেলেন ও কন্ট্রাক্ট বাতিল করতে হবে। ব্রিটিশরা নানা হিসেবনিকেশ কষে দেখল, সেটা সম্ভব নয়। ট্রাম্প নিজেই হুয়াওয়েকে আমেরিকায় নিষিদ্ধ করে দিলেন।
অনেক দিন ধরেই তার খায়েশ চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য অবরোধ করা। হাজার হাজার পণ্যের এক বিশাল তালিকা করে তা জরিও করলেন ট্রাম্প। তামাম দুনিয়া আঁতকে উঠল। কিন্তু ট্রাম্প তার ইউরোপীয় বন্ধু কিংবা দেশের কারো কথা শোনা ভীষণ অপছন্দ করেন। তুড়ি মেরে সব উড়িয়ে দিলেন।
এবার নজর দিলেন ইরানের দিকে। ১৯৭৮ সালে রেজা শাহ উৎখাতের পর থেকেই ইরানের ওপর আমেরিকার ক্রোধ। কিন্তু ইরানও মাথা নোয়ানোর নয়। ইরান সিরিয়ার ঘনিষ্ট বন্ধু। আমেরিকার জানের জান ইসরায়েলের জানি দুশমন। সৌদির সাথেও তাদের খটরমটর বহু যুগের। ট্রাম্প ইসরায়েল আর সৌদি নেতৃত্বে ইরানকে ঘায়েল করার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠলেন। কিন্তু আফগানিস্তান আর ইরাকে তার সৈন্যদের নাজেহাল অবস্থা। তার পূর্বসূরী বড় বুশ আফগানিস্তানে আর ছোট বুশ ইরাকে গিয়ে সেই যে আটকে গেছেন তা থেকে উদ্ধারের পথ অজানা। আফগানিস্তানের গিরিখাতে আর ইরাকের মরুভূমিতে দলাইমলাই হচ্ছে মার্কিনিরা। পাত্তাড়ি না গুটিয়ে উপায় নেই। এর মাঝে উড়ে গেলেন মোদি বাবুর নেমতন্ন খেতে। তাজমহল দেখে ট্রাম্পের বউ তো পাগলপারা। মোদি স্বপ্নে বিভোর চীন থেকে আমেরিকার বড় বড় কোম্পানিকে যদি হিন্দুস্তানে এনে বসানো যায় তাহলেই কেল্লা ফতে। তার আগেই মোদি কাশ্মীরে সংবিধানের দুটো সুবিধা তুলে নিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টকে দিয়ে রাম জন্মভূমির ফয়সালা করেছেন রাম মন্দির নির্মাণের পে আর বাবরি মসজিদ উচ্ছেদে। ভারত থেকে মুসলমান তাড়ানোর সব আইনি অস্ত্র শানিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর আফগানিস্থানকে ধমকাচ্ছেন দিনরাত। দেশে একচ্ছত্র শাসন তাঁর। ভারতবর্ষে এমন অগণতান্ত্রিক শাসন গত সত্তর বছরে কেউ দেখে নি। সেই ভারত জুড়ে ২১ দিনের লকডাউন। ভারতের মহাপ্রাজ্ঞ কাসিকাল প্রধানমন্ত্রী নরেন মোদি রাত ৯টায় ৯মিনিট মোমবাতি জ্বালানোর অনুশাসন জারি করেছেন!
গত কয়েক দশক ধরে তামাম দুনিয়ার শাসন মতায় এক দল পাগল আর অর্বাচীনের অধিষ্ঠান দেখে দেখে হতবাক দুনিয়ার বিবেকবান মানুষ। গণতন্ত্রের এমন অধঃপতন দুনিয়া আগে কখনো দেখে নি। দুনিয়ার বাদশাহীতে তাদের দম্ভের সীমা নেই। সত্যি মিথ্যের বয়ান লিখতে বসি নি। ভাবছি, দুনিয়ার পরাক্রমশালীদের করুন অবস্থা। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক পেণাস্ত্র ঠাই বসিয়ে দিল অতি ুদ্র এক ভাইরাস! নমরুদকে নাকি অসীম যন্ত্রণা ভোগ করে মরতে হয়েছিল। তিনি ছিলেন এতই অহংকারী যে স্বয়ং আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষোণা করেছিলেন। কিন্তু সামান্য এক মশা নাকি তার নাক দিয়ে দিয়ে সোজা গিয়ে হামলে পড়ে মগজে। সেই মশার যন্ত্রণায় নমরুদ যে নরক যন্ত্রণা ভোগ কর তার নাকি আর কোনি নজির দুনিয়ায় নেই! মিশরীয় এ কাহিনি শোনে নি এমন মানুষও তামাম দুনিয়ায় নেই। কাল এক ভিডিও দেখলাম, মার্কিন সংসদে আল কোরান পাঠ হচ্ছে। আজ দেখি ট্রাম্প সাহেবের ঝাড়ফুঁক চলছে আরবি বয়ানে। সেখানে হাজির মাঋন তাবড় তাবড় নেতারা। এসব হয়ত স্রেফ বানানো। কিন্তু দুনিয়া জুড়ে গত কয়েক দশকে যে মুসলিম বিদ্বেষ তেঁতে উঠছিল তাতে বোধহয় একটু শীতল হাওয়া বইছে। ভারত, চীন কিংবা ইউরোপ থেকে কী মুসলিম বিদ্বেষ কিছুটা কমবে? কনবে সকল রকম বর্ণবাদ?
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পত থেকে বিশ্বব্যাপী বর্ণবাদ নতুন করে মাথা চাড়া দেয়। জাতিতে জাতিতে হানাহানি বাড়তেই থাকে। একুশ শতকে পা দিয়েই যেন সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়ায়। যেখানেই যারা সংখ্যালঘু সেখানেই তারা সংখ্যা গরিষ্ঠের নির্মম অত্যাচারের শিকার হতে থাকে। চীনের উইঘর কিংবা মিয়ানমারের আরাকানে একই চিত্র। হিন্দু-মুসলমানে বিরোধ, ইহুদি-মুসলমানে বিরোধ, খ্রিস্টান-মুসলমানে, মায়ানমারে বৌদ্ধ-মুসলমানে বিরোধ। শিয়া-সুন্নি, সুন্নি-কুর্দি, ব্রাহ্মণ-দলিত বিরোধ। সাদা-কালো-পীত-মোলাটো সংঘাত এখন দুনিয়ার সাধারণ ছবি। কিন্তু এসব ধর্মের বিরোধ সংঘাত আড়াল করছে ধনী-গরিবে চিরন্তন লড়াইকে। দুনিয়ার সম্পদ লুট করতে সব জাতের, সব ধর্মের ধনীরা একাট্টা!
মেক্সিকানদের ঠেকাতে ট্রাম্প সাহেবের প্রাচীর নির্মাণ করা আর বোধহয় দরকার হবে না। ভারত থেকে মুসলমান বিতাড়নেও এখন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মোদিকে ভিন্ন চিন্তা করতে হবে। সিরীয় কিংবা এশীয়দের ইউরোপে প্রবেশের দিন বোধহয় ফুরিয়ে আসছে। করোনা বা কোভিড-১৯ তামাম উন্নত দুনিয়ায় যে আঘাত হেনেছে তার ধকলে তারা সবাই এখন ধরাশায়ী। তুলনায় এশিয়া, আফ্রিকা বা দণি আমেরিকার অনুন্নত গরিব দুনিয়া এখনো অনেক ভালো আছে।
কে জানে, এই সর্বনাশা করোনা এক সুন্দর প্রথিবী নির্মাণের মজবুত ভিত হতে যাচ্ছে কি না? কিন্তু ততদিনে হয়ত মানব জাতিকে অশেষ কেশ ভোগ করতে হবে। রাত যত গভীর হয় সুপ্রভাত তত কাছে আসে। আমরা এখন নজরুলের মতই সমস্বরে গাইতে পারি,
“ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত/
আমরা আনিব রাঙা প্রভাত/
আমরা টুটাবো তিমির রাত/
বাঁধার বিন্দাচল।।”
আমিরুল আলম খান, যশোর বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান