সময় গেলে সাধন হবে না

0
আমিরুল আলম খান
মরমী কবি লালন শাহ’র এই বিখ্যাত চরণ শিরোনাম করে ভাবছি, আমরা এই মানব জাতি কি সত্যিই সময়ের মূল্য বুঝি? করোনাকালে কথাটা যেন খুব বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। আজ থেকে প্রায় বছর ষাটেক আগে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন “পৃথিবীর এখন গভীরতর অসুখ।” সে কথাও আমরা খুব বুঝেছি বলে মনে হয় না। তারও আগে কবিগুরু ‘সভ্যতার সংকট’ নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। সতর্ক করেছিলেন। আমরা কানে নিই নি। মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার প্রেক্ষিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কল্পনা করতে পারেন নি। কিন্তু চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধে মানুষের হাতের বাঁশের লাঠি ছাড়া অন্য অস্ত্র থাকবে না সেটা ঠিকই অনুমান করেছিলেন।
পৃথিবী যে গভীর অসুখে ভুগছে তা অনেক আগেই বোঝা যাচ্ছিল। জার্মান রাজনৈতিক দার্শনিক ফ্রেডারিক এঙ্গেলস তথ্যপ্রমাণ দিয়ে ১৮৭৫-৭৬ সালে “প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা” শিরোনামে প্রথম একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। প্রকৃতির ওপর মানুষের নির্বোধ অত্যাচার যে আখেরে মানুষের অস্তিত্বই বিপন্ন করবে তার রূপরেখা তিনি বর্ণনা করেছিলেন বৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্লেষণ করে। মানুষ কান দেয় নি। গত ত্রিশ বছর ধরে প্রকৃতিবাদীরা দুনিয়া জুড়ে আন্দোলন করছেন, পৃথিবীকে বাঁচানোর সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে। লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনিরোতে বসেছিল প্রথম ধরিত্রী সম্মেলন ১৯৯২ সালের জুন মাসে। সেখানে দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষের সাথে সাথে যোগ দিয়েছিল বিশ্বের আদিবাসীরাও। তুমুল আওয়াজ তুলেছিলেন উন্নয়নের ধ্বংসাত্মক সব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। সেই থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে বারবার মানুষ জড়ো হয়ে সভা, সমাবেশ, প্রতিবাদ করে চলেছে বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশেও মানুষ আন্দোলন করছে সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করতে, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প থামাতে। নদী, বন রক্ষা করতে। মাটি, বাতাস নির্মল রাখতে। যশোর-বেনাপোল রাস্তার গাছ বাঁচাতে। সড়ক যোগাযোগের বদলে রেল ও জল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। কেউ শুনছে না।
কোপেনহেগেন, প্যারিস সম্মেলনে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর ধমক শুনতে হয়েছে দুনিয়ার শান্তিপ্রত্যাশী মানুষদের। ট্রাম্প সাহেব বিশ্ব উষাবায়নের তত্ত্ব একেবারেই মিথ্যা বলে অভিযোগ তুলেই থামেন নি, মার্কিন অর্থের অপচয় বন্ধের অজুহাতে এই আন্দোলন থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়েছেন! এভাবে ক্ষমতাধরেরা শুধু ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছে, কখনো আবার ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করতে নির্মতার চূড়ান্ত রূপ দেখিয়েছে। উন্নয়নের ফুলঝুরি তাদের মুখে মুখে। জিডিপির ফিরিস্তি দিয়ে বিরুদ্ধ মত দমন করেছে। দুনিয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতা দেখানোর প্রতিযোগিতার লীলাভূমি। কার হাতে কত ভয়ংকর মারণাস্ত্র, কত দ্রুত তা কত বেশি ক্ষতি সাধন করতে পারে তাই নিয়ে বাগাড়ম্বর। প্রতিদিন টন টন বোমা ফেলছে আররবের উষর মরুভূমিতে, পাহাড়ে জনপদে। একুশ শতক শুরুর পর থেকে আফগানিস্তান ইরাক লিবিয়া সিরিয়া ইয়েমেন জুড়ে চলছে ধ্বংসযজ্ঞ। শুধু শক্তিধর, উন্নত ও ধনী দেশগুলোই নয় এ খেলায় মেতে উঠেছে গরিব অনেক দেশ। ক্ষমতার মসনদ ঠিক রাখতে জিডিপি বৃদ্ধিকে নিদান ভেবে দিনরাত তার গুণকীর্তন করে মিডিয়া মাত করে রেখেছে। উন্নয়নের পাহকাঘোড়ায় পায়ের তলে পিষে মেরেছে ভিন্নমত। এ এক অন্তহীন খেলা; ক্ষমতা ধরে রাখতে এর চেয়ে ধন্বন্তরী দ্বিতীয়টি যেন নেই।
শক্তি প্রদর্শনের এই উন্মত্ত খেলায় হঠাৎ ছন্দ পতন ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। চীনের উহান শহরে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস এখন সারা দুনিয়ার সব কিছু ওলটপালট করে দিচ্ছে। থেমে গেছে পৃথিবী। উন্নয়নের পাগলা ঘোড়া থেমে গেছে। অস্ত্রের ঝনঝনানি থেমে গেছে। কথার ফুলঝুরি থেমে গেছে। মুখে কুলুপ এঁটে হোতা মুখ ভোঁতা করে মুখ লুকাচ্ছে যাচ্ছে বাচালের পাল। তাদের ছা-বাচ্ছারাও লুকাচ্ছে অন্ধকার গুহায়।
মার্কিন টেলিভিশনগুলো খবর দিচ্ছে, তাদের ওয়াল স্ট্রিট নির্জন। নিউইয়র্ক শহরে এখন কবরের নীরবতা। এক সময়ে হু হু করে বেড়ে তেলের দাম ১৭০ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল ক’বছর আগে। চোখ রাঙাতো সারা দুনিয়াকে। সেই তেলের ব্যারেল প্রতি দাম এখন মাত্র ২০ ডলার! টাইমস স্কোয়ারে, ডিজনিল্যান্ডে মাতোয়ারা মানুষের উন্মত্ত কোলাহল নেই। প্রশান্ত মহাসাগর দাপিয়ে বেড়ানো থিওডর রুজভেল্ট নামের মার্কিন পারমাণবিক রণতরীতেও হানা দিয়েছে করোনা। গুয়ামে নোঙর করে ঠাঁই ভাসছে দুনিয়ার ত্রাস জাহাজখানা। মাটিতে নামার অনুমতি মিলছে না কোন যুদ্ধনাবিকের। কোন হোটেল ভাড়ায় মিলছে না। হাসপাতাল তাদের চিকিৎসা দিতে রাজি না। মার্কিন এ্যাডমিরাল নাবিকদের কোন মানবিক আবেদনেই সাড়া দিতে অস্বীকার করছেন। জাহাজ ভরা বহু শত মূল্যবান যুদ্ধবিমান। পারমাণবিক অস্ত্রের পাহাড়। দুনিয়া শাসন করার জন্য মানুষের বানানো আগ্নেয়গিরি, সাক্ষাৎ যমদূত! এখন কেউ তাদের উদ্ধার করতে এগিয়ে আসছে না। অথচ এ রণতরী পরিত্যাগ করাও সম্ভব নয়। ভয়ংকর পরিণতি হবে তার। হায়! শান্তি নষ্টের নাটের গুরুদের এ কী নিদারুণ দশা! আলো নিভে গেছে অহংকারের প্রতীক প্যারিসের আইফেল টাওয়ারে। নিউইয়র্কের সমুদ্রে স্ট্যাচু অব লিবার্টি মুক্তির দিশা দিতে ব্যর্থ। ভ্যাটিকানের অভয়বানী নির্বাক। ক্বাবা শরিফে তাওয়াব বন্ধ। মন্দিরে পূজায় নেই ভক্তের ভীড়। পুণ্যস্থান, পর্যটন কেন্দ্র, বার, ক্লাব নির্জন, নিস্তব্ধ। ভেনিস শহর জনশূন্য। ল্যুভরে মানুষের আনাগোনা নেই। টোকিও অলিম্পিক পিছিয়ে গেল এক বছর। মাদ্রিদের স্টেডিয়ামে উন্মাতাল তরুণীর দেহবল্লরীর প্রদর্শনী যেন ইতিহাস। থেমে গেছে আরব শেখদের হারেমে হারেমে উন্মাতাল যৌবনাদের বেলি ডান্স!
তবে কী থেমে যাবে পৃথিবী? মানুষের বিজয় রথ এগিয়ে যাবে না সম্মুখে? পৃথিবীর ইতিহাসের কী অবসান আসন্ন?
এসব প্রশ্নের জবাব কী সত্যিই অজানা? অতীত তা বলে না। এই সুন্দর পৃথিবী আবার সুন্দর হয়ে উঠবে। ব্যক্তিগত লোভের সাগরে ভেসে যাওয়া পৃথিবী আবার সকলের হয়ে ফিরে আসবে। অতীতে বারবার এসেছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার অবসান ঘটবে। নতুন এক সামষ্টিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
বিচ্ছিন্নতা মানব ধর্ম নয়। মানুষের ধর্মই যূথবদ্ধতা। একতাই বল মানব সমাজের। ঐক্যেই শক্তি। জাদরেল মার্কিন ভাইরোলোজিস্ট ফাউসি যখন কয়েক কোটি মানুষের মৃত্যুর দুঃসংবাদ শুনাচ্ছেন, ঠিক তখনই আশার বানী শুনিয়েছেন এ কালের ত্রিকালদর্শী নোয়াম চমস্কি। তিনি বলছেন, এক সামষ্টিক বিশ্বব্যবস্থা আসন্ন। এই মহা মৃত্যুর মিছিল পেরিয়ে মানুষের, মনুষ্যত্বের বিজয়গাথা আবার রচিত হবে।
কবি আল মাহমুদের ভাষায় বলি,
“সভ্যতার উগরে দেওয়া/
বর্জ্য ও উচ্ছিষ্টের ভাগাড় চাপা দিতে পৃথিবীতে চাষ হবে ফের।/
জ্যোতির্ময় রৌদ্রের নীচে লক্ষ লক্ষ মহিষের ঘামে ভেজা/
তেজস্ক্রিয় মাটির ভিতরে মিশরের মমির বাক্সে রেখে যাওয়া /
বীজ এনে পৃথিবীতে চাষ হবে ফের।”
কিন্তু সে জন্য চায় সময়োচিত সাধনা। মানবতার জয়গান। সময় থাকতেই সে সাধনা শুরু হোক। “সময় গেলে সাধন হবে না।”
আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]