ইরাক কি টিকে থাকবে!

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ যুদ্ধে তামা তামা হয়ে গেছে ইরাক। তার ওপর তেলের মূল্য পতন ঘটেছে। আঘাত করেছে করোনা ভাইরাস। একের পর এক আঘাতের মোকাবিলা করে এই দেশটি কি আর কোনোদিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে! এসব সঙ্কট ক্রমশ অনাকাঙ্খিত এক সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে ইরাককে। দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারে রয়েছে শূন্যতা। রাশিয়া ও সৌদি আরবের মধ্যে তেলের মূল্য নিয়ে অঘোষিত লড়াই পরিস্থিতিকে আরো সঙ্গীন করে তুলেছে। তার ওপর করোনা মহামারী। এই মহামারী নিয়ন্ত্রণে আর্থিক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে এক রকম যুদ্ধ করছে অশোধিত তেল রপ্তানিকারক দেশটি।
বাণিজ্য, ব্যবসা, পর্যটন ও পরিবহন খাতে নেমে এসেছে ধস।
এ অবস্থায় ঐতিহাসিক কারবালা নগরীতে এক হোটেল মালিক থামির গারিব বলেছেন, আমাদের স্বাস্থ্যখাতে যে আঘাত হানছে করোনা মহামারী, তার চেয়ে বড় আঘাত করছে অর্থনীতিতে। কারবালা হলো ইরাকের দক্ষিণে শিয়াদের জন্য পবিত্র শহর। সেখানে সারা বছরই ধর্মীয় পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। কিন্তু এখন এই নগরী ভুতূড়ে রূপ নিয়েছে। ইরান, উপসাগরীয় দেশগুলো এবং ইউরোপ থেকে যাওয়া পর্যটকবাহী ডজনের পর ডজন বাস ছুটে যেতো ইমাম হোসেন (র.)-এর মাজার জিয়ারত করতে। তাদের ভিড়ে হোটেল রেস্তোরাঁগুলো উপচে পড়তো। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের মতে, ইরাকের মোট জাতীয় প্রবৃদ্ধির শতকরা প্রায় ৮ ভাগ আসে এসব পবিত্র স্থাপনায় যাওয়া পর্যটকদের রাজস্ব থেকে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী দেশটিকে থমকে দিয়েছে। ধর্মভিত্তিক পর্যটন বন্ধ রয়েছে। এ জন্য কারবালায় থামির গারিবের হোটেলের দরজা বন্ধ। একই অবস্থা কারবালা ও পার্শ্ববর্তী শহর নাজাফের শহরগুলোর।
মঙ্গলবার থেকে রাজধানী বাগদাদে এক সপ্তাহের কারফিউ দেয়া হয়েছে। এতে দেশটির অর্থনীতি ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা মুধের সালেহ বলেন, তেলের মূল্য পতনের সঙ্গে যদি আমরা ক্ষতির হিসাব করি তাহলে ইরাক প্রতিদিন কমপক্ষে ১২ থেকে ১৩ কোটি ডলারের লোকসান হচ্ছে। তাই সঙ্কট মোকাবিলা করতে স্বল্পকালীন একটি আর্থিক বাজেট জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু এসব আহ্বানের দিকে নজর দিতে তেমন আগ্রহ নেই কর্মকর্তাদের। কারণ, সেখানে কে হবেন আগামী প্রধানমন্ত্রী তা নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিভক্তি জোরালো হয়েছে। মঙ্গলবার নাজাফের সাবেক গভর্নর আদনাল আল জুরফিকে প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ তাকে সমর্থন করবে কিনা তা দেখার বিষয়।
গত ডিসেম্বরে গণ আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদুল মাহদি। তারপর থেকেই তিনি তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নাম করা হয়েছিল মোহাম্মদ আলাবিকে। কিন্তু তিনিও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন এ প্রক্রিয়ায় বিলম্ব ও রাজনৈতিক ক্ষেত্র কার্যকর না থাকায়। বাগদাদভিত্তিক বিশ্লেষক সাজাদ জিয়াদ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নিজেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তিনি ভারপ্রাপ্ত একজন প্রশাসক। রাজনৈতিকভাবে আমাদের কোনো নেতৃত্ব নেই। এ বিষয়ে ঐকমত্যও নেই। অন্য কর্মকর্তারা বলেছেন, তেলের মূল্য পতন এসব সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলবে। ইরাককে তার সেন্ট্রাল ব্যাংকের রিজার্ভে হাত দিতে হতে পারে। এই হিসাবে জমা আছে ৪৫০০ কোটি থেকে ৬০০০ কোটি ডলার।
বর্তমানে প্রতি ব্যারেল তেল বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২৬ ডলার দামে। প্রায় আঠার বছরের মধ্যে এটাই তেলের সর্বনি¤œ দাম। বার্ষিক বাজেটের অর্ধেক আসে এই তেল বিক্রির অর্থ থেকে। যদি এই অবস্থা প্রলম্বিত হয় তাহলে বাগদাদ সরকারি কর্মচারিদের বেতন দিতে সক্ষম হবে না। জনগণকে মৌলিক সেবা দিতে সক্ষম হবে না। ইরাক ঋণখেলাপি হয়ে পড়বে। বর্তমানে তারা ৪০০০ কোটি ডলারের ঋণে আছে। ইরাকি কর্মকর্তারা বলছেন, এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে এই ঋণের অংক দ্বিগুণ হবে।
রাষ্ট্রীয় রাজস্বের শতকরা ৯০ ভাগের বেশি আসে তেল রপ্তানি থেকে। ২০২০ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ধরা হয়েছে ৫৬ ডলার। কিন্তু এই প্রস্তাব পাস করা বিলম্বিত হয়েছে। কারণ, সেখানকার রাজনৈতিক অচলাবস্থা। এতে ইরাকের ভবিষ্যত আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। গত সপ্তাহে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাফর আলাবি বলেছেন, প্রতি মাসে করোনা ভাইরাস সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম কিনতে তাদের প্রয়োজন ১৫ কোটি ডলার। অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, এই চাহিদা পূরণ করতে তারা ব্যাংক, সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ডোনেশন নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে ১০০০ কোটি ডলার দিতে রাজি হয়েছে কুয়েত।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এরই মধ্যে করোনায় সেখানে মারা গেছেন ১৩ জন। আক্রান্ত হয়েছেন ১৯২ জন। পরিবহন, ব্যবসা, বাণিজ্য, পর্যটন সব কিছুতে ভয়াবহ এক প্রভাব পড়েছে। এতে ইরাকি কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে আছেন। স্থানীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। বাগদাদে মুদি দোকানি আহমেদ রহিম (২৫) বলেছেন, ইরান থেকে আমদানি করা পিয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। উত্তর ইরাকে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাজ বন্ধ হয়ে আছে। ফ্লাইট স্থগিত থাকায় আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো কর্মী আনা নেয়া করতে পারছে না।
(সূত্র: আরব নিউজ)