জামিন দেবে সরকার, হুজুরের মতে অমত কার?

0
রুমিন ফারহানা
অভিযোগ গুরুতর। স্ট্যান্ড রিলিজ ছাড়া উপায় নাই। অভিযোগ এনেছে খোদ পিরোজপুর জেলা আইনজীবী সমিতি। আসামি পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আবদুল মান্নান। অভিযোগ কী? অভিযোগের বর্ণনা দেন আইনজীবী সমিতির সভাপতি এস এম বেলায়েত হোসেন- “ওই বিচারক সব সময় আদালতে আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এ ছাড়া তিনি জামায়াত-শিবিরের লোকদের সঙ্গে নিয়ে অনুষ্ঠান করেন। বাসায় নাচ, গান হয়। কিছু অবৈধ নিয়োগও দিয়েছেন তিনি”।
অভিযোগগুলো এতটাই বীভৎস, ভয়াবহ যে এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে যেখানে জেল-জরিমানা, এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারতো সেখানে সরকার বাহাদুর দয়াপরবশ হয়ে কেবলমাত্র স্ট্যান্ড রিলিজেই তার শাস্তি সীমাবদ্ধ রেখেছেন। মুশকিল হলো এই অভিযোগগুলোর কোনোটিই হঠাৎ করে ওঠার মতো নয়। তাহলে এই ‘ভয়াবহ অপরাধী’কে আইনজীবী সমিতি এতদিন বিচারক হিসেবে মেনে নিলো কেন? আর কেনই বা হঠাৎ করে এক বিশেষ দিনে, এক বিশেষ মামলায়, এক বিশেষ ব্যক্তির, বিশেষ জামিন আবেদন নামঞ্জুর করার সঙ্গে সঙ্গেই তার বিরুদ্ধে রেজ্যুলুশন আনা হলো?
এই বিষয়ের একটা ব্যাখ্যাও তাৎক্ষণিক হাজির করেছেন আইনজীবী সমিতির সভাপতি। তিনি দাবি করেন, “জামিন না দেয়ার সঙ্গে আমাদের রেজ্যুলুশন পাসের কোনো সম্পর্ক নাই। আমরা সকাল ১০টায় বসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তখন বসতে পারিনি। আমরা দুপুর একটার পর বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেই”। যে ঘটনা নিয়ে আলোচনা তা হলো, গত মঙ্গলবার পিরোজপুরের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সস্ত্রীক দুদকের একটি মামলায় জেলা ও দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করলে শুনানি শেষে বিচারক জামিন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। যদিও তাদের রেখে চিকিৎসা ও ডিভিশন দেয়ার আবেদন বিচারক মঞ্জুর করেন। অদ্ভুত বিষয় হলো এর মাত্র কিছুক্ষণ পরেই এই বিচারককে বদলির চিঠি পাঠানো হয়। তার স্থলে দায়িত্ব নেন যুগ্ম ও জেলা জজ নাহিদ নাসরিন যিনি আর কোনো রকম ভুল না করে নিমিষে আসামিদের জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। জামিনে বের হয়েই সাবেক এই সংসদ সদস্য সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিচারক জামিন নামঞ্জুর করেন। শ. ম. রেজাউল করিম অবশ্য এই অভিযোগ উড়িয়ে দেন।
পুরো ঘটনাটির মধ্যে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ছিল আইনমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার। প্রথমত তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন সাংবাদিকদের এড়িয়ে যেতে। শেষে না পেরে বলেন ‘রূঢ় এবং অশালীন আচরণ করায়’ বিচারককে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তিনি আরো যুক্ত করেন, জামিন বাতিলের ঘটনায় বারের সকলে আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। এই পরিস্থিতিতে গণ্ডগোল চলছিলো, রাস্তায় লোকজন বেরিয়ে পড়েছিল সেটাকে কন্ট্রোল করার জন্যই বিচারককে স্ট্যান্ড রিলিজ করে আদেশ দেয়া হয় আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে। মজা এখানেই শেষ না। মন্ত্রীর ভাষ্য মেনে নিয়ে না হয় ধরেই নিলাম ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে’ বিচারক বদল জায়েজ ছিল। তাহলে প্রশ্ন থাকে নতুন বিচারক এজলাসে উঠেই আলোচিত মামলায় আসামিদ্বয়কে জামিন দিয়ে বউনি করলেন কেন? এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আইনমন্ত্রী জানান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই এই জামিনের আদেশ। এতে আইনের শাসনের কোনো ব্যত্যয় হয়নি।
এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে কতগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়।
১) জামিন নামঞ্জুর করা কি কোনো অপরাধ? বিচারক কি জামিন দিতে বাধ্য?
২) আমরা দেখলাম জামিন না হলে ‘দলীয় গুণ্ডাবাহিনী যদি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে’ তাহলে হুকুম তো হুকুম, হাকিম পর্যন্ত নড়ে যায়। তাহলে কি এখন থেকে জামিন পাওয়ার গ্রাউন্ডগুলোর ওপর জোর না দিয়ে রাস্তায় কী করে আগুন জ্বালানো যায় সে বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে জামিন লাভের জন্য? এজন্যই কি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জামিনের প্রশ্ন উঠলেই সরকারের তরফ থেকে অবলীলায় আন্দোলনে ব্যর্থতার কথা তোলা হয়?
৩) আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে যদি জামিন আর বিচারকের বদলি অত্যাবশ্যক হয় তাহলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের টাকায় পুষছি কেন?
৪) যে অভিযোগগুলো আইনমন্ত্রী এবং জেলা আইনজীবী সমিতি বিচারকের বিরুদ্ধে নিয়ে এসেছে, সেগুলো তো হঠাৎ আসা কোনো অভিযোগ হতে পারে না। তাহলে এতদিন কোনো রেজ্যুলুশন না নিয়ে এক বিশেষ দিনে এক বিশেষ মামলায় এক বিশেষ ব্যক্তির বিশেষ জামিন আবেদন নামঞ্জুর করার সঙ্গে সঙ্গেই তার বিরুদ্ধে রেজ্যুলুশন আনা হলো কেন?
৫) আইনজীবী সমিতির বিশেষ ক্ষণে নেয়া এই রেজ্যুলুশন কি এটাই প্রমাণ করে না, এই সকল সমিতি সরকারের অঙ্গুলি হেলনে তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, এবং তাদের স্বাধীন কোনো সত্ত্বা আর অবশিষ্ট নাই?
৬) আসামির ভাষ্য মতে মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিমের নির্দেশেই এই জামিন আবেদন নামঞ্জুর করা হয়। এই অভিযোগ যদি সত্যি হয় তাহলে একজন মন্ত্রী বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখেন। সেই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এখন সরকার তাহলে কী ব্যবস্থা নেবে?
৭) একজন বিচারক যার পক্ষে মিডিয়ায় এসে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ নেই তার বিরুদ্ধে আইনজীবী সমিতির বক্তব্য অনুসরণ করে স্বয়ং আইনমন্ত্রীর এমন অভিযোগ কি শিষ্টাচারের চরম লঙ্ঘন নয়?
বহুদিন ধরে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এবং এর স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নানা মহল থেকে। এই প্রশ্নগুলোর এক জ্বলন্ত উত্তর হয়ে দাঁড়ালো পিরোজপুরের এই ঘটনা। সংবিধানের ১১৫ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ যে সংবিধানেরই ২২ অনুচ্ছেদ এবং মাসদার হোসেন মামলার রায়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক এ কথা আইনজ্ঞ, সংবিধান বিশেষজ্ঞরা অসংখ্যবার বলে এসেছেন। এই দুই অনুচ্ছেদ বর্তমান অবস্থায় রেখে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে বিচার কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ, (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরি সহ) ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপরে ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে উদ্ভূত বিতর্ক সরিয়ে রাখলেও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার সঙ্গে সাবেক প্রধান বিচারপতির যে বিষয়টি ঘিরে দীর্ঘদিন বিতর্ক হয়েছিলো তা হলো মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির নিয়োগ ও শৃঙ্খলাবিধি সরকারের প্রভাবমুক্ত রেখে পুরোপুরি বিচার বিভাগের হাতে ন্যস্ত করা। অ্যাটর্নি জেনারেল বার বারই সরকারের হাতে মূল নিয়ন্ত্রণ রেখে এই বিধিমালা তৈরি করছিলেন, আর যৌক্তিক কারণেই সেটা গ্রহণ করছিলেন না জনাব সিনহা। তার মূল্য সিনহাকে কড়ায়-গণ্ডায় চুকাতে হয়েছে শুধু পদ হারানো নয়, দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে। তিনি সরে যাবার পরে যিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেন তিনি সরকারের ফরমায়েশ সম্পূর্ণ পালন করেই উক্ত বিধিমালা গ্রহণ করেন।
অধস্তন আদালতের ওপরে সরকার কেন পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায় তার অসংখ্য উদাহরণের সঙ্গে যুক্ত হলো আলোচ্য ঘটনাটি। পিরোজপুরের এই ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দীর্ঘদিন ধরে বিচার বিভাগে যা নীরবে ঘটে এসেছে এটা তারই একটি নগ্ন বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এই ঘটনাটি তাদেরকেই বিস্মিত করবে যারা বাংলাদেশে বাস করেও ঘুমাচ্ছিলেন ‘আসহাবে কাহাফ’দের মতো।
দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে মামলায় আজ দু’বছর কারাগারে বন্দি একই ধরনের মামলায় অতীতে অসংখ্য লোকের জামিন হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। কেবল বন্দি আছেন বেগম খালেদা জিয়া, যদিও আদালতে নজির খুব গুরুত্বপূর্ণ। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে বিচারপতিরা বলেছিলেন, বিচার বিভাগ প্রায় ডুবে গেছে, উচ্চ আদালত কোনোমতে নাক উঁচু করে টিকে আছে। পিরোজপুরের ঘটনাটি নিম্ন আদালতের, কিন্তু বেগম জিয়ার ঘটনাটি প্রমাণ করে পানির উপরে থাকা উচ্চ আদালতের নাকটিও এখন পানির নিচে। আদালতের এই পরিস্থিতি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একটা রাষ্ট্রের সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ যখন এককেন্দ্রমুখী হয়ে পড়ে তখন রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়তে থাকে, এর বাইরে থাকে না বিচার বিভাগও। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ার প্রমাণ দেখছি আমরা নিয়মিত। ভেঙে পড়েছে আর সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও। পিরোজপুরের ঘটনা এই ভাঙনেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।