পাপিয়ার ১২ রাশিয়ান মডেল নিয়ে যা ঘটেছিল বিমানবন্দরে

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ বিদেশ থেকে মডেল কন্যাদের ঢাকায় নিয়ে আসতো শামীমা নূর পাপিয়া। অভিজাত ব্যক্তিদের চাহিদা মেটাতে প্রায়ই রাশিয়ান মডেল-তরুণীরা তার ডেরায় উপস্থিত থাকতো। কিছুদিন অবস্থান করে তারা আবার চলে যেত নিজ দেশে। বড় অঙ্কের বাণিজ্যের জন্য বিদেশি মডেলদের ব্যবহার করা হতো। মাসখানেক আগে এক সঙ্গে ১২ রাশিয়ান মডেলকে আনতে গিয়ে বিমানবন্দরে বিপত্তি বাধে। তারা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলে ইমিগ্রেশনে আটকা পড়েন। কেন কি কারণে তারা বাংলাদেশে এসেছেন। কোন অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন এমন কোন ঘোষণা ছিল না তাদের কাছে।
এজন্য ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ঢাকায় প্রবেশে তাদের অনুমতি না দিয়ে আটকে রাখে। এ নিয়ে দীর্ঘ সময় দেন দরবার চলে। পাপিয়া তার নিজস্ব চ্যানেলে উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সুপারিশে শেষ পর্যন্ত তাদের ছাড়িয়ে আনে। সূত্র জানায় ওই দিনের ঘটনাটি বিভিন্ন গোয়েন্দা মারফতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্তৃপক্ষ অবগত হন। এরপরই ওই মডেলদের কারা কেন দেশে এনেছে তার খোঁজ-খবর শুরু হয়। ওই সূত্র ধরেই পাপিয়ার পাপের জগতের সন্ধান মিলে বলে গোয়েন্দা সূত্রের দাবি। এদিকে রিমাণ্ডে চালঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছেন অপরাধ কন্যা পাপিয়া। জিজ্ঞাসাবাদে তার অপরাধ জগতের আদ্যোপান্ত উঠে আসছে। তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে মদতদাতাদের নাম। যাদের ছত্রছায়ায় সে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলো। পাপিয়া তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে যুব মহিলা লীগের তিন নারী নেত্রীর নাম স্বীকার করেছে। যারা তাকে রাজনীনিতে প্রবেশ ও বড় পদ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন। নরসিংদীর নেতৃবৃন্দের নারাজি থাকা সত্বেও পাপিয়া কেন্দ্রীয় নেত্রীদের হাত করে সাধারণ সম্পাদকের পদ ভাগিয়ে নিয়েছিল। এছাড়া এই নেত্রীদের হাত ধরেই অনেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে উঠেছিলো। এই নেত্রীদের একজনের সঙ্গে তার ব্যবসায়ীক সম্পর্কও ছিল। এছাড়া পাপিয়ার কললিস্টের সূত্র ধরে তদন্ত আরো গভীর হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তার কললিস্টে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, শিল্পপতি, অভিনেতা, অভিনেত্রী ও প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের তথ্য পাওয়া গেছে। এখন যাচাইবাছাই করে দেখা হচ্ছে তাদের সঙ্গে মূলত কি ধরনের যোগাযোগ ছিল।
তদন্ত সংশ্লিষ্টসূত্র অনলাইন ক্যাসিনোর সঙ্গে পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান সুমনের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হয়েছেন। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার অনলাইন ক্যাসিনো ডন সেলিম প্রধানের বাসায় ও আরো কিছু স্থানে পাপিয়া ও তার স্বামীর নিয়মিত যাতায়াতের তথ্য পেয়েছেন। সেলিম প্রধানের অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমে প্রভাবশালী অনেকের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। যাদের পরবর্তীতে পাপিয়া এস্কট সার্ভিস দিতো। সূত্র বলছে, সেলিম প্রধান গ্রেপ্তার হওয়ার পরেও অনলাইন ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত অনেকের সঙ্গে পাপিয়া ও তার স্বামীর যোগাযোগ ছিল। তারা হোটেল ওয়েস্টিন ও আরো কিছু বিশেষ স্থানে পাপিয়ার ডেরায় এসে মনোরঞ্জন করতো। যাদের জন্য পাপিয়া ওয়েস্টিনের একটি বার ভাড়া করে রাখতেন। ওয়েস্টিনের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে আগে থেকেই রেডি থাকতো দেশি বিদেশি তরুণীরা। অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য কলেজ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে দেশি ও বিদেশি মডেলদের সেখানে আগে থেকেই প্রস্তুত রাখতেন পাপিয়া। সূত্র বলছে, অভিজাত ব্যক্তিরাই পাপিয়ার ক্লায়েন্ট ছিলেন। যাদের কাছ বড় অংকের টাকার পাশপাশি ভাগিয়ে নিতেন বড় বড় কাজ। এছাড়া অন্তত অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আছেন যারা তার কাজ ভাগিয়ে নেয়ার জন্য পাপিয়াকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতেন। রিমাণ্ডে পাপিয়া তার বিলাসী জীবনের বিষয়গুলো এড়িয়ে যাচ্ছে। পাপিয়া দাবি করছে, সে কোনো অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল না। তার স্বামী ও তার গাড়ির ব্যবসা থেকে আসা আয় দিয়েই এসব করতো। অথচ তাদের এত টাকা খরচ করার মত দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা বা চাকরি নাই। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা পাপিয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে কত টাকা আয় হতো তার হিসেব সংগ্রহ করছেন। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন বিভিন্ন দেশে পাপিয়ার যাতায়াত ছিল কিনা এসব বিষয়ে তদন্ত চলছে। সে কেনো দেশের বাইরে যেত এসব বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। দেশের বাইরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তবে ঠিক কোন দেশে কি ধরনের ব্যবসা আছে এই বিষযে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
প্রাথমিকভাবে থাইল্যান্ডে তার স্বামীর বার ও স্পা সেন্টার থাকার খবর পাওয়া গেছে। বিমান বন্দর থানা সূত্র বলছে, র‌্যাবের হাতে আটকের সময় পাপিয়ার ব্যাগ থেকে জাল টাকা, বিদেশি মুদ্রা পাওয়া গেছে। এত জাল টাকা সে কেনো তার কাছে রেখেছিলো এটি সন্দেহের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। অজ্ঞাতবশত ২/৩ টি জাল নোট থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু বড় অংকের জাল টাকা ব্যবসায়িক উদ্দেশে রাখা। তাই পাপিয়া ও তার স্বামী জাল নোটের কারবারে জড়িত কিনা এই বিষয়ে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। প্রাথমিকভাবে সে বলেছে এই জাল টাকা সে বহন করেনি। অবৈধ অস্ত্রের বিষয়ে তাদেরকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। র‌্যাব তাদের আটকের পরের দিন তার ইন্দিরা রোডের দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে গিয়ে অভিযান চালিয়ে বিদেশি মদ ও অবৈধ অস্ত্র পেয়েছে। অস্ত্রের গায়ের কোড তারা ধাতব পদার্থ দিয়ে ঘষে তুলেছিলো। যার কারণে এই অস্ত্রের কোনো তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে না। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, পাপিয়ার সঙ্গে অস্ত্র কারবারি কয়েকজনের যোগাযোগ ছিল। যাদেরকে দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের কারবার দিব্যি করছিলো। সীমান্ত দিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে চোরা কারবারিরা তার কাছে অস্ত্র পাঠিয়ে দিত। পরে সেই অস্ত্র পাপিয়া বিক্রি করতো। এর বাইরে অর্থপাচারের সঙ্গে পাপিয়ার সম্পৃক্ততা আছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, অবৈধভাবে আয় করে বিপুল পরিমাণ টাকা দেশের বাইরে পাঠিয়েছে পাপিয়া ও তার স্বামী। বিদেশের ব্যাংকে তাদের নামে হিসাব আছে। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সূত্র জানায়, পাপিয়া ও তার স্বামী একটি ক্যাডার বাহিনীর লালন করতেন। কিউ এন্ড সি নামের ক্যাডার বহিনীর অনেকের কাছে অস্ত্র থাকতো। তিন বছর আগে তাদের ওপর হামলার পরপরই তার ক্যাডার বাহিনী গঠন করেন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এই বাহিনী সবসময় প্রস্তুত থাকতো। তাদেরকে মাসে মাসে অনেক টাকা বেতন দিতে হতো। স্থানীয়রা এই ক্যাডার বাহিনীকে দেখলে পাপিয়ার বাহিনী হিসেবে চিনতো। এদেরকে দিয়ে অনেক অনৈতিক কাজ করাতো তারা। বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কায়কোবাদ কাজী মানবজমিনকে বলেন, অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছে পাপিয়া। তার বিরুদ্ধে আসা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কিন্তু সে অনেক কিছুই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা এখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ সংগ্রহ করছি। হোটেল ওয়েস্টিনেই থেকেই সে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করতো। তাই আমরা হোটেলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করছি। এছাড়া তার কললিস্টের সূত্র ধরে তার সঙ্গে কার কার যোগাযোগ ছিল সেগুলো বের করা হচ্ছে।