চেতনায় অমর একুশে

0

মহিউদ্দীন মোহাম্মদ॥ ‘ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। একটি মিনার গড়েছি আমরা/চারকোটি কারিগর/বেহালার সুরে,রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায়।’কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ যথার্থই উচ্চারণ করেছেন। সেদিন মিনার গড়তে যে ঐক্য হয়েছিল সেই বাস্তবতায় মনে রাখতে হবে ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষা আর সংস্কৃতির প্রশ্নেই ছিল না, এর সাথে জড়িয়ে ছিল আমাদের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন, বিভিন্ন ভাষাভাষী জনতার আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি,বাঙালির রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের প্রশ্নও। জাতিগত এবং আঞ্চলিক অত্যাচার ও শোষণের চিরাচরিত সাম্যাজ্যবাদি কায়দায় এই ষড়যন্ত্রকে রুখে দাঁড়াতে পূর্বপাকিস্তানের সকল শ্রেণির দেশপ্রেমিক মানুষ তাই কোনো ত্যাগ স্বীকারেই কুণ্ঠাবোধ করেনি সেদিন। আজকের বাংলাদেশে রাজনীতি ও সংস্কৃতির কথা নাই বললাম। অর্থনৈতিক যে মুক্তি তার কতটা হয়েছে একটু নজর দিই আসুন। জিডিপির প্রবৃদ্ধিই কিন্তু আসল প্রবৃদ্ধি নয়। সে কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। আজকে এতটা বছর বাদে দেশের ধনী গরীবের যে বৈষম্য লক্ষ্য করছি-তাতে একুশের যে চেতনা তা বোধ করি ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। তাই বায়ান্নোর একুশ এখন অমর না থেকে ঝাপসা হয়ে আসছে! গেল বছর ঢাকার একটি দৈনিক রিপোর্ট ছাপে। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ধনী-গরীবের মধ্যে বৈষম্য রেকর্ড হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৮ সালের প্রকাশিত প্রতিবেদনে ধনী-দরিদ্র্য বৈষম্যের েেত্র বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এই তালিকায় বাংলাদেশের সামনে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু ভারত রয়েছে। বাকি তিনটি দেশ হলো আফ্রিকার নাইজেরিয়া, কঙ্গো ও ইথিওপিয়া। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা দুই কোটি ৪১ লাখ। মোট ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে চরম দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের আয় দৈনিক ১.৯ ডলার (প্রায় দেড়শ টাকা) এর কম। যদিও বাংলাদেশে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দারিদ্যের পরিমান উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে দারিদ্যের হার ছিল ৪৪.২ শতাংশ। যা ২০১৬-১৭ সালে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ-এক্স এর প্রতিবেদনে বলা হয়ছে, ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের অবস্থান হবে বিশ্বে তৃতীয়। যাদের কাছে এক থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার আছে তাদেরকে ধনী হিসেবে ধরা হচ্ছে। ‘হাই নেট ওয়ার্থ হ্যান্ডবুক-২০১৯’ নামে এবারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল সময়ে দেশের সমন্বিত বার্ষিক জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়বে শতকরা ১১.৪ ভাগ। ধনী মানুষের সংখ্যার দিক থেকে আর মাত্র চারটি দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি দুই অংকে পৌঁছাবে। তালিকার শীর্ষে রয়েছে নাইজেরিয়া, সেখানে এই হার শতকরা ১৬.৩ ভাগ। এরপরই রয়েছে মিশর, সেখানে এই হার শতকরা ১২.৫ ভাগ। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেন, এটা সত্য বাংলাদেশ দুর্বল অর্থনীতি থেকে দ্রুত টেকসই অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে সম্পদের বণ্টন এখানে যথেষ্ট স্বচ্ছ নয় এবং বৈষম্য এখনো অনেক উচ্চমাত্রায়। এখানে অবৈধ এবং অনৈতিক উপায় গ্রহণ করে ধনী হওয়ার প্রবণতাও রয়েছে। তিনি আরও বলেন, শ্রমিক শ্রেণির জন্য ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক খাতে ব্যয় এবং কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে এখনও বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার একটি দীর্ঘ পথ রয়েছে। তিনি যোগ করেন, অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্পটি বৈষম্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়, যা বিপজ্জনক। যদি আমরা সম্পদের বৈষম্য কমাতে ব্যর্থ হই, তবে কোনও অগ্রগতি টেকসই হবে না। খুলনার ক্যাথলিক চ্যারিটি ক্যারিটাসের রিজিওনাল ডিরেক্টর জীবন ডি দাসও এমনটিই মনে করেন। তিনি বলেন, দুটি প্রতিবেদনেই বাংলাদেশের বাস্তবতার প্রতিফলন আছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে অপরাধমূলকভাবে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। যেখানে দরিদ্ররা বৈষম্যের মধ্যেই আছে। দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই একই অবস্থা। কিছু ধনী মানুষ যে সৎভাবেও অর্থ আয় করছে না, সেকথাও অবশ্য তিনি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, যারা বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করছে তারা দুর্নীতি, অনিয়ম, মাদকদ্রব্য ও চোরাচালান ইত্যাদি উপায়ে করে থাকে। তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে ধরাছোয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। এই রিপোর্ট আমাদের আশা কতটুকু জাগিয়েছে পাঠকই বিবেচনা করুন। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে সাথে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সবাই সেদিন যে স্বপ্ন দেখেছিল তা বাস্তবায়নে আমরা যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারছি না। তাই বলা যায় শহীদদের রক্তের সাথে বেইমানিই করছি প্রকারন্তরে।