ভয়ঙ্কর যুদ্ধের দামামা : ইরাকে মার্কিন দূতাবাস ও বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে রকেট হামলা

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ ইরাকে শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় ইরানের কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সোলাইমানির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বার্তা সংস্থাগুলো জানায়, ইরাকের রাজধানী বাগদাদের মার্কিন দূতাবাস ও বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে গতকাল রকেট হামলা চালানো হয়েছে। জেনারেল কাসেম সোলাইমানি হত্যার জেরে এ হামলা চালানো হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইরাকের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, বাগদাদে মার্কিন দূতাবাস ও সালাহউদ্দিন প্রদেশের মার্কিন বিমানঘাঁটিতে একযোগে পাঁচটি রকেট হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় তৎক্ষণাৎ পাঁচজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসের কাছে দুটি রকেট ছোড়া হয়। এ ছাড়া বাগদাদের উত্তরে সালাহউদ্দিন প্রদেশে মার্কিন সেনাদের বালাদ বিমানঘাঁটিতে তিনটি রকেট ছোড়া হয়। একযোগে এসব রকেট ছোড়া হয়। কে বা কারা এসব হামলা চালিয়েছে রাত দেড়টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিস্তারিত জানা যায়নি।
এর আগে পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সকে লক্ষ্য করে মার্কিন বাহিনী ফের বিমান হামলা চালিয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম জানায়। এতে অন্তত ৬ জন নিহত হয়েছেন বলে খবর প্রকাশ করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। তবে পরে পেন্টাগন এ ঘটনা সত্য নয় উল্লেখ করে বিবৃতি দেয়। ইরাকের কর্মকর্তারাও এ ধরনের কোনো হামলার কথা অস্বীকার করেন।
জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ও আল মুহানদিসের জানাজায় গতকাল লাখ লাখ মানুষ অংশ নেয়। জানাজায় অংশগ্রহণকারীদের পরনে ছিল কালো পোশাক আর হাতে ছিল ইরাকের পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সের পতাকা। এ সময় তারা যুক্তরাষ্ট্রের ধ্বংস চেয়ে নানা ধরনের স্লোগান দেন। একটি স্লোগান ছিল ‘আমেরিকার মৃত্যু চাই।’ ইরানি জেনারেলকে হত্যা ঘটনায় জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সব পক্ষকে সর্বোচ্চ ধৈর্য ধরার আহ্বান জানালেও এই হত্যাকান্ডের নিন্দা জানাননি। মহাসচিব বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে আরেক যুদ্ধের ধকল সহ্য করার মতো অবস্থা বিশ্বের নেই। জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে এক টেলিফোনালাপে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ বলেন, ‘ইরানি শীর্ষ জেনারেলকে হত্যার যে কোনো পরিণতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেই দায়ী থাকতে হবে।’ মার্কিন সিনেটর টিম কেইন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য মার্কিন কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে আরও ৩ হাজার সেনা পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন ট্রাম্প। ফলে এ অঞ্চলে যে কোনো মুহূর্তে ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চলমান উত্তেজনার জেরে নিজেদের এয়ারলাইনসগুলোকে ইরানের আকাশসীমা এড়িয়ে চলার নির্দেশনা দিয়েছে ভারত। নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে গত শুক্রবার বাহরাইনের গালফ এয়ার, ন্যাশনাল এয়ারলাইন, জর্ডানের রয়্যাল জর্ডানিয়ান এয়ারলাইনস বাগদাদে নিজেদের ফ্লাইট বাতিল করেছে। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি এই হত্যাকান্ডের কঠোর প্রতিশোধের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, দেশের পশ্চিম আকাশে যুদ্ধবিমানের মহড়া চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশটির দুই বড় শহর নিউইয়র্ক ও লস অ্যাঞ্জেলেসে হামলার আশঙ্কায় সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
গত বছর মে মাসে পরমাণু-সংক্রান্ত এক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে আসার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের মধ্যে সংকট প্রকট হতে শুরু করে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়ে ইরান। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ ও স্থাপনায় বোমা হামলা, সরাসরি মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করার ঘটনাও ঘটে। সম্প্রতি ইরাকে বেশ কয়েকটি মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়েছিল। এক হামলায় নিহত হন এক মার্কিন বেসামরিক ঠিকাদার। এর প্রতিশোধ নিতেই যুক্তরাষ্ট্র কাতায়েব হিজবুল্লাহর ২৫ সেনাকে হত্যা করে। এর জের ধরে দুই দিন ধরে বাগদাদে মার্কিন দূতাবাস ঘিরে বিক্ষোভ হয় এবং দূতাবাসের ওপর আক্রমণ হয়। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই বাগদাদে সোলাইমানির গাড়িবহরে হামলা চালায় মার্কিন বাহিনী। জেনারেল সোলাইমানি সিআইএ ও মোসাদের হিটলিস্টে বহু আগে থেকেই ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখেন জেনারেল সোলাইমানি। লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেনের মতো দেশগুলোতে তেহরানপন্থি শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোকে পরাক্রমশালী করে তোলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের এই দ্বৈরথে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বৈশ্বিক জ্বালানি তেল সরবরাহের একটি বড় অংশ হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে, যার নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশেই ইরানের হাতে। ইরান এই রুট বন্ধ করে দিলে বড় ধরনের বিপাকে পড়বে গোটা বিশ্ব।
সোলাইমানির রাজত্ব শেষ হয়েছে- ট্রাম্প : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে নয়, আরেকটি যুদ্ধ ঠেকাতেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করেছে। তিনি ফ্লোরিডার অবকাশযাপন কেন্দ্র মার-আ-লগোতে এক সংবাদ সম্মেলনে গতকাল বলেন, শুক্রবার বাগদাদ বিমানবন্দরে হামলায় সোলাইমানির ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব শেষ হয়েছে’।
জানাজা পড়াবেন খামেনি : তেহরানে লাশ নেওয়া হলে সোলাইমানির জানাজা পড়াবেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। বিকালে কাসেম সোলাইমানিসহ পাঁচজনের মৃতদেহ ইরানে পৌঁছার কথা। এসব মৃতদেহ মাশহাদে ইমাম রেজা (আ.)’র মাজারে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে কিছু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে রবিবার তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জানাজা হবে। সোলাইমানিকে মঙ্গলবার কেরমানে দাফন করা হবে।
জাতিসংঘকে ইরানের হুঁশিয়ারি : ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ বলেছেন, সোলাইমানিকে হত্যার যে কোনো পরিণতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী থাকতে হবে। শুক্রবার রাতে তিনি জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে এক টেলিফোনালাপে এ কথা বলেন।
বাংলাদেশিদের সতর্ক থাকার পরামর্শ : ইরাকের চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিকদের সতর্ক থাকতে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস। গতকাল ইরাকে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রধান মো. অহিদুজ্জামান লিটন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘ইরাকের চলমান নিরাপদহীন অস্থিতিশীল পরিবেশের কথা বিবেচনা করে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ইরাকে বাংলাদেশি প্রবাসীদের বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত কর্মস্থল ও বাসস্থান ছাড়া যত্রতত্র যাতায়াত, সব সভা-সমাবেশ ও গোলযোগপূর্ণ পরিবেশ এড়িয়ে চলার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।’ এতে জানানো হয়, প্রবাসীদের কনস্যুলার সেবা প্রদানের জন্য সপ্তাহে সাত দিন ২৪ ঘণ্টা বাংলাদেশ দূতাবাস খোলা থাকবে।
ইদলিবে মিষ্টি বিতরণ : সোলাইমানি সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে যুদ্ধে আসাদ সরকারকে সহযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তার মৃত্যুতে সিরিয়ার ইদলিবের জনগণ উল্লসিত। তারা সোলাইমানির মৃত্যুতে মিষ্টি বিতরণ করে। ফুঁসছে ইরান : সোলাইমানিকে হারিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে ইরান। ‘উপযুক্ত সময়ে, যথাস্থানে’ এই হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে তারা। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানি সেনাবাহিনীর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হত্যার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ উসকে দিয়েছে ওয়াশিংটন। তাদের মতে, সোলাইমানিকে হারানোর পর ইরানি বাহিনীর সক্ষমতায় ভাটা পড়লেও যে কোনো উপায়ে বদলা নেওয়ার চেষ্টা করবে তেহরান। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানি নীতির অন্যতম বিশ্লেষক চার্লস লিস্টার সিএনএনকে বলেছেন, এই হামলা কৌশলগত তাৎপর্য ও প্রায়োগিক দিক থেকে আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন বা আইএস প্রতিষ্ঠাতা আল বাগদাদির হত্যার চেয়েও আলাদা। তিনি বলেন, কয়েক মাস ধরেই ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি পরিস্থিতি বিরাজ করছে আর এই হত্যাকা- সেই উত্তেজনাকে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেবে। ওয়াশিংটনের থিঙ্কট্যাঙ্ক ডিফেন্স প্রায়োরিটিজের পলিসি ডিরেক্টর বেন ফ্রাইডম্যান ওই হামলাকে ‘উল্লেখযোগ্য বেপরোয়া কর্মকা-’ আখ্যা দিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, সম্ভাব্য বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য ওই অঞ্চলে থাকা মার্কিন বাহিনীর সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়।