কোতয়ালিতে ২৮ খুনসহ যশোরে যশোরে ৭৮ খুন বিদায়ী বছরে

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শেষ হতে যাওয়া বছরে (২০১৯) যশোরের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিলো না। তবে পরিস্থিতি যে খুব বেশি অস্বাভাবিক ছিল তাও নয়। খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, চুরি, ধর্ষণ, হামলা, মাদক কেনাবেচা, চোরাচালান, মারামারি, বোমাবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে যশোরে। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিলো একদম স্বাভাবিক বিশেষ করে কোতোয়ালি থানা এলাকায় এ বছর ২৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আর পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে পুরো যশোরে ৭৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
চলতি বছরের প্রথম সন্ধ্যা যশোরের পুলিশের কাছে ছিল অসহ্যের। ওই দিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারি যশোর ঈদগাহের সামনে খুন হয়েছিলেন আরএন রোডের মটরপার্টস ব্যবসায়ী মহিদুল ইসলাম শাফা। এই হত্যাকান্ডটি ছিল পরিকল্পিত। পরিবর্তিতে ডিবি পুলিশ এই হত্যা মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে হত্যাকারীদের আটক এবং মোটিভ উদ্ধার করে। শাফার এক সময়কার ব্যবসায়িক পার্টনার শহরের বেজপাড়া নলডাঙ্গা রোডের আনোয়ার হোসেন ওয়াশিংটন এই হত্যার মূল নায়ক বলে পুলিশ জানতে পারে। পরের মাসে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার দিকে শহরতলীর শেখহাটি ভাটার জোড়া পুকুর এলাকায় প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হন আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৪) নামে এক যুবক। তিনি বেজপাড়া পিয়ারী মোহন রোডের মৃত আব্দুর রউফের ছেলে। মারা যাওয়ার আগে ঘোপ নওয়াপাড়া রোডের রবিউল ইসলামের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। এ সময় ছুরিকাঘাতে জখম হয়েছিলেন আরিফ (২৬) ও শেফালী বেগম (৪২) নামে দুইজন।
বছরের আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী তৃষা (৮) ধর্ষণ ও হত্যা মামলা। ধর্মতলা গাজীপাড়া এলাকার ইজিবাইক চালক তরিকুল ইসলামের মেয়ে তৃষাকে প্রথমে হাত-পা বেঁধে ধর্ষণ ও হত্যার পর লাশ বস্তাবন্দি করে মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়েছিল। এই ঘটনার পর এলাকার মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিক্ষোভ মিছিল, সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন করে নিহতের পরিবার ও এলাকার লোকজন। অবশ্য পরে এই ধর্ষণ মামলার অন্যতম আসামি শামীম (৩০) নামে এক যুবক পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। অন্যান্য আসামিরা পালিয়ে যায়। গত ১৩ মার্চ যশোর শহরের বিমান অফিস মোড়ে সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি মারপিটে প্রথম জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ওই এলাকার নয়ন চৌধুরী সাজু (১৭)। পরদিন ১৪ মার্চ মারা যান সাজু। তিনি ওই এলাকার জয়নাল চৌধুরী ওরফে চাইনিজ স্বপনের ছেলে। এই ঘটনায় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছালছাবিল আহমেদ জিসানসহ ৪ জনের নামে একটি মামলা হয়।
গত ৮ এপ্রিল যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি সরদার বাগডাঙ্গা গ্রামের গৃহবধূ রিপা বেগমের (২২) মরদেহ পাওয়া যায় গ্রামের একটি বিলের ধানক্ষেতে। আগেরদিন ৭ এপ্রিল তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন। তিনি ওই গ্রামের ইমরান সরদারের প্রথম স্ত্রী ছিলেন। গত ২০ দুপুর আড়াইটার দিকে যশোর শহরতলীর বাহাদুর জেস গার্ডেন নামক পার্কের পাশে খুন হন শহিদ কাজী (২৮) নামে এক মিল শ্রমিক। তিনি মাগুরার সদর উপজেলার হাজরাপুর গ্রামের লোকমান কাজীর ছেলে। ওই এলাকার এক মিলের শ্রমিক ছাটাইকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিরোধে ছুরিকাঘাতে খুন হন তিনি। গত ১৩ জুন শহরের শংকরপুর সন্ন্যাসী দিঘির পাড়ে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হন নাজির শংকরপুর সাদেক গারোগার মোড়ের আজাদ হোসেনের ছেলে ফেরদৌস (২০)। পরবর্তীতে এই ঘটনায় ৯জনের নামে মামলা হয়। ১৯ জুন শংকরপুর কেন্ত্রীয় বাসটার্মিনাল এলাকায় সন্ত্রাসীদের দুই পক্ষের মধ্যে বোমা হামলা ও গণপিটুনিতে প্রাণ হারান সানি নামে এক সন্ত্রাসী। তিনি শংকরপুর এলাকার মৃত মশিয়ার রহমান ওরফে ধনু মিয়ার ছেলে। এই ঘটনায় কুখ্যাত সন্ত্রাসী ২০ মামলার আসামি হিটার নয়নসহ ৮জনের নামে মামলা হয়।
গত ২০ জুন সদর উপজেলার পাঁচবাড়িয়া গ্রামের তিতাস গ্যাসের ডিপোর পাশে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে খুন হন মাদ্রাসা ছাত্র সাজেদুর রহমান সম্রাট (১৬)। সে সদর উপজেলার ঝুমঝুমপুর বড় বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের তাজ উদ্দিনের ছেলে। এই ঘটনায় ৫জনের নামে থানায় মামলা হয়। সহপাঠির সাথে প্রেম সংক্রান্ত বিরোধে খুন হয়েছিলেন সম্রাট। এ দিন সকালে শহরতলীর খোলাডাঙ্গা গাজীর বাজার এলাকার সেতুর মটর গ্যারেজের পাশের একটি ড্রেন থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয় সিনবাদ (৩২) নামে এক যুবকের লাশ। তিনি পুরাতন কসবা মানিকতলা এলাকার আব্দুর রহমানের ছেলে। এই ঘটনায় ৮জনের নামে একটি মামলা হয়। চোরাই মোবাইল কেনাবেনা নিয়ে বিরোধে খুন হয়েছিলেন গ্যারেজ শ্রমিক সিনবাদ। গত ২৮ জুন সদর উপজেলার ভাতুড়িয়া এলাকার একটি ঘেরপাড়ে প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন ঘের ব্যবসায়ী ইমামুল ওরফে ইমারোজ আলম। এই ঘটনায় ১৩জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৬০ জনের নামে একটি মামলা হয়। এই মামলা প্রধান আসামি মাছ চাষে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত চাষি সেলিমস রেজা পান্নু (৪৬)। নিহত ইমারোজ ভাতুড়িয়া গ্রামের নুর ইসলাম ওরফে নুরু মহুরীর ছেলে। গত ১ আগস্ট সদর উপজেলার নওদাগা গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে রহস্যজনকভাবে মারা যান গৃহবধূ খুশি ওরফে খুশিলা (২২)। অভিযোগ ওঠে তাকে হত্যা করে শ্বশুরবাড়ির লোকজন গলায় রশি দিয়ে ঘরের ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রাখে। খুশি ওই গ্রামের ফারুক হোসেনের স্ত্রী ও মেহেরপুর সদর উপজেলার কন্দেপপুর গ্রামের দাউদ হোসেনের মেয়ে। এই ঘটনায় ৫জনের নাম উল্লেখ করে কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়।
গত ৬ আগস্ট রাতে পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যায় যশোরের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী ১৮ মামলার আসামি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত শিশির কুমার ঘোষ (৩২)। সে শহরের ষষ্টিতলা পাড়ার নিত্য ঘোঘের ছেলে। ১৪ আগস্ট রাতে যশোর সদর উপজেলার সালতা গ্রামে অজ্ঞাত দুর্বত্তদের হামলায় মিনারুল মোল্লা (৩২) নামে এক কৃষি শ্রমিক নিহত হন। তিনি ওই গ্রামের মৃত সদর মোল্লার ছেলে। পরবর্তীতে ওসমানপুর গ্রামের চাঁদ আলী মোল্লার ছেলে হাফিজুর রহমানকে (৪৮) এই হত্যা মামলায় আটক করা হয়। সে হত্যার কথা আদালতে স্বীকার করে। ১৫ বছর আগে সংসার ভাঙ্গার প্রতিশোধ নিতে মিনারুলকে খুন করা হয় বলে মিজানুর স্বীকার করেন। ২৮ আগস্ট ঝিনাইদহের এলজিইডি অফিসের গাড়িচালক হাসানুজ্জামান জগলুর (৫০) গলাকাটা মরদেহ যশোরের চুড়ামনকাটি-বারিনগর এলাকার সাকোর মাথা বালিক গর্ত নামক স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। ২৭ আগস্ট রাতে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ডিবি পুলিশ হত্যার মোটিভ উদ্ধার করে। নিহতের স্ত্রী পরকীয়া লিপ্ত হয়ে ভাড়াটি খুনি দিয়ে জগলুকে হত্যা করে।
গত ২৮ আগস্ট রাতে যশোর সদর উপজেলার লেবুতলা আগরাইল গ্রামে সৎ পিতার ছুরিকাঘাতে খুন হন প্রতিবন্ধী সুমি (২৬)। সৎ পিতা নাজমুল বাঘারপাড়া উপজেলার ভদ্রাডাঙ্গা গ্রামের কুবাদ আলীর ছেলে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর শহরের ডিসি বাংলোর পূর্ব পাশে চারতলা ভবনের একটি বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে মাথায় টেলিভিশন পড়ে নিহত হন শ্রমিক কুদ্দুস। তার বাড়ি খড়কী এলাকায়। এই ঘটনায় বাড়ির মালিক মিজানুর রহমানসহ দুই জনের নামে একটি মামলা হয়। গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতে মাছ চুরির অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় সদর উপজেলার কচুয়া গ্রামের শাহ আলম ওরফে সাইলামকে। এই ঘটনায় ৫জনের নামে একটি মামলা হয়।
গত ২১ অক্টোবর সকালে যশোর শহরের মোল্লাপাড়া মালোপাড়ায় ভৈরব নদের পাড় থেকে কলেজ শিক্ষার্থী সোহানুর রহমান সোহাগের (২০) গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি হামিদপুর আল হেরা ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র এবং মালোপাড়া এলাকার হাবিবুর রহমানের ছেলে। এই ঘটনায় ৪জনের নামে একটি মামলা হয়। ২ নভেম্বর রাতে যশোর সদর উপজেলার ডহেরপাড়া গ্রামের সোনিয়া বেগম (২০) নামে এক গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। তিনি ওই গ্রামের অ্যাডভোকেট আমির হোসেনের স্ত্রী এবং সদর উপজেলার লেবুতলা পূর্বপাড়ার সিরাজ উদ্দিনের মেয়ে। অভিযোগ আছে তাকে হত্যা করে লাশ ঘরের ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এই ঘটনা আটক আমির হোসেন জেল হাজতে বন্দি আছেন। ৬ নভেম্বর যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটির বাগডাঙ্গায় দুই ভাইয়ের বিবাদ মেটাতে গিয়ে এলোতাপাতাড়ি কোপে নিহত হন আরেক ভাই কাঠ মিস্ত্রি আকবর আলী (৩৫)। ৫ নভেম্বর মারপিটে তিনি আহত হলে ঢাকায় নেয়া হয়। সেখানে তার মৃত্যু হয়।
১৯ নভেম্বর রাতে ঘরের মধ্যে মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করা হয় কলেজ ছাত্র পল্লবের মরদেহ। ঘটনার মাসখানেক আগে তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন। প্রেম সংক্রান্ত ঘটনায় জেরে তার সহপাঠিরা তাকে হত্যা করে লাশ মাটি খুঁড়ে পুতে রাখে। পল্লব সদর উপজেলার বসুন্দিয়া ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামের বিকাশের ছেলে। ২৯ নভেম্বর রাতে যশোর সদর উপজেলার নরেন্দ্রপুর পোস্ট অফিস মোড়ে ভাইয়ের মারপিটে শিকার হয়ে নিহত হস এনজিও কর্মী মুক্তা খাতুন (৩৫)। ৩০ নভেম্বর সকালে প্রকাশ্যে দিবালোকে যশোর সদর উপজেলার হাশিমপুর বাজারে হত্যা করা হয় আনসার সদস্য হোসেন আলীকে। এই ঘটনায় অজ্ঞাত আসামি করে একটি মামলা হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে এই হত্যাকান্ডটি ছিল চাঞ্চল্যকর। এক সময়কার চরমপন্থী সংগঠন নিয়ে বিরোধে খুন হন হোসেন আলী তরফদার। ৯ ডিসেম্বর রাতে মাটি কেনাবেচা নিয়ে দ্বন্ধে যশোর সদর উপজেলার নরেন্দ্রপুর মোল্লাপাড়ায় খুন হন জানি (২৬) নামে এক যুবক। নিহত জনি (২৮) মণিরামপুর উপজেলার ঢাকুরিয়া ইউনিয়নের তারুয়াপাড়া গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে। এই ঘটনায় ২৬ জনের নামে একটি মামলা হয়।
১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে বেজপাড়া তালতলা মোড় বাইলেনের প্রবাসি ফিরোজ উদ্দিনের বাড়ির সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রমজান নামে এক যুবককে। নিহত রমজান গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া উপজেলার নীলফা রামচন্দ্রপুর গ্রামের রবিউল চাকলাদারের ছেলে। বতর্মানে যশোর শহরের পালবাড়ি আয়েশা পল্লীর জব্বারের বাড়িতে ভাড়া থাকেন। এই ঘটনায় নিহতের মা ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেন। গত ২১ ডিসেম্বর সকালে এ বছরের শেষ হত্যা কান্ডটি ঘটে শহরের বারান্দি মোল্লাপাড়া আমতলা টাউয়ার মোড়ে। ওই এলাকার প্রশাধন ব্যবসায়ী আব্দুর রহমানকে শাবলটি আঘাত করে হত্যা করে চিহ্নিত অপরাধীরা। এই ঘটনায় ৮জনের নামে কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা হয়। এছাড়া আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি। তার মধ্যে বেশ কয়েটি হত্যা মামলায় রুপ দিতে পারে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়া সাপেক্ষে। এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানায় ওসি মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন। সব হত্যার ঘটনার আসামিকে পুলিশ আটক করতে পেরেছে। হত্যাকাণ্ডগুলো আচমকা ঘটে। তবে পুলিশ মামলা ডিডেক্ট করতে পেরেছে। এমন নয় যে পুলিশ হত্যাকারীদের আটক বা সনাক্ত করতে পারেনি। পুলিশ সকল অপরাধীদের আইনের আওতায় আনবে।