চৌগাছা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার প্রাচীনতম ঐতিহ্য ঘাইন

0

স্টাফ রিপোর্টার, চৌগাছা (যশোর) ॥ আজ থেকে দুই দশক আগেও দেশের গ্রামাঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী গরুর ঘাইন’র মাধ্যমে সরিষা ভাঙিয়ে তেল তৈরি করা হত। ঘাইনের মালিকরা ঘাইন বা শাহাজি নামে পরিচিত ছিলেন। ঘাইনে ভাঙানো তেল এবং খৈল নিয়ে ঘাইন/শাহাজিরা বাঁকের ছিকা কাঁধে বহন করে গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজরে এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করতেন। আর এই তেল দিয়ে মানুষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সরিষার খৈল গরুর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হত।
সূত্র জানায়, ভারত সীমান্তের গাঁ ঘেঁষে গড়ে ওঠা যশোরের চৌগাছা উপজেলায় নানা ধর্ম ও পেশার মানুষের বসবাস। এ সকল পেশার মধ্যে কলু (শাহাজি) একটি অন্যতম পেশা। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এক সময়ে এই পেশার মানুষের বসবাস চোখে পড়ার মত ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে শাহজি পেশার মানুষ বহুলাংশে কমে গেছে। নানা প্রতিকূলতার মাধ্যমে ওই পেশা পরিবর্তন করতে তারা বাধ্য হয়েছেন বলে জানা গেছে।
উপজেলার জগদীশপুর, স্বরুপদাহসহ অধিকাংশ ইউনিয়নে কলু সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস ছিল। গরু ও গাছের সমন্বয়ে সরিষা, তিল এবং ভ্যান্না থেকে তেল তৈরি করে তা বাজারে বিক্রি করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। ঘাইনে তৈরি করা তেলে রান্না করা খাবার যেমন সুস্বাদু তেমনি উপকারী। কিন্তু ঘাইনে তৈরি করা তেলের স্থান দখল করে নিয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে তৈরি করা তেলে। ডিজিটাল প্রযুক্তিতে তৈরি তেলের বাজার মূল্য কম থাকায় মানুষ ওই তেলের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েছেন। আর ঘাইনে তৈরি তেলের বাজার দর কিছুটা বেশি, সে কারণে ক্রেতা কমে গেছে। বিনিয়োগ ও পরিশ্রম বেশি কিন্তু বাজার মূল্য কম থাকায় দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে ঘাইনের সংখ্যা।
শুক্রবার উপজেলার স্বরুপদাহ ইউনিয়নের খড়িঞ্চা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কয়েকটি ঘাইন এখনও অবশিষ্ট আছে। প্রতিটি ঘাইনে চলছে তেল তৈরির কাজ। এমন এক সময় ছিল খড়িঞ্চার ওই মহল্লায় ঘরে ঘরে ছিল ঘাইন। যে কারণে মহল্লাটি কলুপাড়া হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু এখন হাতে গোনা ৫ থেকে ৬ টি ঘাইন গ্রামটিতে অবশিষ্ট আছে। ঘাইনে তেল প্রস্তুতে ব্যস্ত শাহজি হারুন অর রশিদ (৭৫) জানান, তিনি বাপ-দাদারা এই পেশায় নিয়োজিত। তিনি বলেন, ’পৈত্রিক সূত্রে আমি এই পেশা পেয়েছি। বাপ-দাদারা ঘাইন থেকে রোজগার করা অর্থে আমাদের বড় করেছেন, আমি এখান থেকে রোজগার করে সংসার চালায়। কিন্তু এখন আর সে ভাবে কাজ হয় না। সরিষার মৌসুম এলে কিছুটা কাজ বেশি হয়। বছরের বাকি সময় নিজে সরিষা ক্রয় করে তেল বিক্রি করে সংসার চালায়। তিনি বলেন, ১ কেজি সরিষা মাড়াই করতে ২০ টাকা নেয়া হয়। দিনে ২০ থেকে ২৫ কেজি সরিষা মাড়াই করা যায়। ভালমানের সরিষা হলে ১০ কেজি সরিষা থেকে ৩ কেজি তেল হয়। আর খৈল হয় ৬ কেজি। প্রতিকেজি তেল বাজারে ২২০ টাকা দরে বিক্রি করেন’। গ্রামটিতে বর্তমানে ৬ টি ঘাইন আছে। এর মলিক হলেন রবিউল ইসলাম, রহিম বক্স, খাইরুল ইসলাম, শওকত আলী ও শফিকুল ইসলাম। ঘাইনের মালিকরা জানান, একটি ঘাইন তৈরি করতে জাইত, ওড়া, গাছ, কাতারি এবং ২টি প্রাপ্ত বয়স্ক গরুর প্রয়োজন হয়। জাইত বাবলা কাঠের তৈরি, লম্বা ৩ ফুট, ওড়া তৈরি করতে হয় কড়াই কাঠ দিয়ে, তার উচ্চতা ১ ফুট, কাতারি তৈরি হয় কাঁঠাল কাঠ দিয়ে যার উচ্চতা ৬ ফুট আর মূল গাছটি তৈরি হয় চটকা কড়াই কাঠ দিয়ে। এর উচ্চতা হচ্ছে ১০ ফুট। এ সবের সমন্বয়ে প্রস্তুত হয় একটি ঘাইন। ঘাইনে যে গরুটি কাজ করে তার দুই চোখ বেঁধে দেয়া হয়। চোখ বাঁধার উপকার হচ্ছে ওই গরু ঘাইনের কাজে লাগানোর পর তার সাথে কোন লোকজন থাকার প্রয়োজন হয় না। চোখ বাঁধার কারণে গরু মনে করে তার সাথে লোক আছে যে কারণে সে অবিরাম ঘুরতে থাকে। ঘাইনের মালিকরা জানান, নিঃসন্দেহে এটি একটি ঐতিহ্য। নানা কারণে আজ ঘাইন হারাতে বসেছে। উপজেলার সচেতন মহল প্রাচীনতম এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।