রাজনীতি ২০১৯

0

লুৎফর রহমান ॥ নির্বাচনী ঝঞ্ঝাবহুল বছর শেষে ২০১৯ হাজির হয়েছিল অনেক পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে। ঘটনাবহুল নির্বাচনের পর বছরের শুরুতেই নতুন সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। অতীতের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন কিছু করার অঙ্গীকার করা হয় সরকারি দলের তরফে। এমন প্রত্যাশা থেকে মন্ত্রিসভায়ও আসে পরিবর্তন। আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার গঠন করায় মন্ত্রিসভায় স্থান হয়নি মহাজোটের শরিক দলের নেতাদের। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের কার্যক্রম ছিল অনেকটা রুটিন ওয়ার্কের মতো। এদিকে বৃহত্তর ঐক্যের ডাক দিয়ে নির্বাচনী জোট করা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের পর সামনে এগিয়েছে গতানুগতিক কর্মসূচি দিয়ে। বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র ২০ দলীয় জোটের কার্যক্রমও চলেছে নানা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে।
বছর শেষে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা হিসাব মিলাচ্ছেন বিদায়ী বছরের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির। তারা বলছেন, রাজনীতির দুই শিবিরেই খুব একটা নড়চড় দেখা যায়নি। গতানুগতিক কর্মসূচি আর পুরনো ধারায়ই চলেছে দলগুলো। কর্মসূচিতে যেমন কোন নতুনত্ব ছিল না, তেমনি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নতিরও কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। অনেকটা স্থবির অবস্থার মধ্য দিয়ে যাওয়া রাজনীতি নতুন বছরে মানুষকে কতোটা আশাবাদী করতে পারে, মানুষের প্রত্যাশা পূরণে কতোটা ভুমিকা রাখতে পারে এটাই এখন দেখার বিষয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, বিদায়ী বছরে দেশে মূলত রাজনীতিই ছিল না। সরকারি দল পাকাপোক্তভাবে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে। বিরোধী মহল বিএনপি ঘর গোছাতেও পারেনি, কোন লক্ষ্যও অর্জন করতে পারেনি। তাদের নেতৃত্ব নেই, তাদের সংগঠন নেই। এমনকি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে তৃণমুলের নেতৃত্বের কোন যোগাযোগও নেই। তাই বলা যায় বিদায়ী বছর রাজনীতিতে কোন ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের নানা অপরাধের কারণে পরবর্তীতে আমরা আরও নানা অনিয়ম দেখতে পেয়েছি বিভিন্ন সেক্টরে। তিনি বলেন, সবকিছু সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে রাজনীতিতে কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি।
স্বস্তির পরিবেশেও কিছু অস্বস্তি ছিল আওয়ামী লীগে: টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর অনেকটা স্বস্তির পরিবেশেই সময় পার করেছে আওয়ামী লীগ। শুরু থেকে বিরোধী জোট আন্দোলনের হুমকি দিলেও মাঠে বড় কোন কর্মসূচি দিতে পারেনি তারা। এতে স্বস্তিতেই বছর পার করেছে ক্ষমতাসীন দল। এছাড়া বছর শেষে মূল সংগঠন ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কাউন্সিল সফলভাবে সম্পন্ন করাকে দলের বড় সাফল্য বলে মনে করছেন নেতারা। অন্যদিকে ক্যাসিনোকাণ্ডে যুবলীগ, আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম আসা, চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি, রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম আসা, ডেঙ্গু পরিস্থিতি ও পিয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রণালয় বিভাগের ব্যর্থতায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে ক্ষমতাসীন দলকে। এছাড়া ফেনীর আলোচিত নুসরাত হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের জড়িত থাকা, বুয়েটে মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার ঘটনা ক্ষমতাসীন দলের জন্য বড় অস্বস্তি তৈরি করে। যদিও এসব ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। একই সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়। বছর শেষে আলোচিত ক্যাসিনো ও দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে একের পর এক আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের নাম আসায় বিরোধীদের মুখে সমালোচনার নতুন রসদ যোগায়। এই অভিযান চলমান থাকলেও কার্যক্রম এখন অনেকটা স্থবির। অভিযোগ আসায় কাউন্সিলে দল ও সহযোগী সংগঠনের অভিযুক্ত নেতাদের বাদ দেয়া হয়েছে। যুক্ত করা হয়েছে বিতর্কমুক্ত নেতাদের। এতে ঘরে বাইরে সাধুবাদ মিলেছে। তবে সর্বশেষ দলীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে যে নতুন নেতৃত্ব এসেছে তাতে বেশির ভাগই পুরনো মুখ। অনেকে বলছেন, যতোটা পরিবর্তনের প্রত্যাশা ছিল ততোটা হয়নি। বছর শেষে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। দুই সিটিতে ইতোমধ্যে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। সমর্থন দেয়া হয়েছে কাউন্সিলর প্রার্থীদের। এক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। অভিযুক্ত কেউ কেউ দলীয় সমর্থণ পেয়েছেন এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।
এদিকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র জোট ১৪ দলের কার্যক্রমে তেমন একটা গতি ছিল না বছরজুড়ে। রুটিন কার্যক্রমের মধ্যেই ছিল এ জোটের কর্মসূচি। গত নির্বাচনের পর জোটের নেতাদের মন্ত্রিসভার বাইরে রাখায় তাদের কাউকে কাউকে সরকারের সমালোচনায় মুখর হতে দেখা যায়। বিশেষ করে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের একটি বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দেয়। ‘নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারে নাই’ মেননের এমন বক্তব্যের কড়া সমালোচনা আসে ক্ষমতাসীন দলের তরফে।
হতাশায় বছর পার বিরোধীদের: একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই সরকার বিরোধী আন্দোলনের ছক কষে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। নানা সময়ে কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এসব কর্মসূচিতে খুব একটা সফলতার মুখ দেখেনি দলগুলো। তাদের দাবি এবং আন্দোলনেও খুব একটা সাড়া দেয়নি সরকার। নির্বাচনের পর নতুন নির্বাচনের দাবি তোলা বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা এপ্রিলে সংসদে যোগ দেন। এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন দলটির শুভাকাঙ্ক্ষীরাও। আলোচিত ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচন বাতিলের দাবিতে ওই নির্বাচনের বার্ষিকীর দিন গতকাল কর্মসূচি ঘোষণা করেও তা পালন করতে পারেনি দলটি। পুলিশের অনুমতি পাওয়া যায়নি বলে গতকালের সমাবেশ কর্মসূচি বাতিল করা হয়। যদিও এ দিন গণতন্ত্র উদ্ধার আন্দোলনের ব্যানারে জোটের কয়েকটি দল সমাবেশ কর্মসূচি করে। এছাড়া যে লক্ষ্য নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিল বিএনপি তারও সুফল গড়ে তোলা যায়নি বলে নেতারা মনে করছেন। তারা বলছেন, দল হিসেবে বিএনপি সক্রিয় না হলে জোট বা ফ্রন্ট গঠন কাজে আসবে না। বছরের শেষদিকে পরপর দুই সিনিয়র নেতার পদত্যাগ, ২০ দলীয় জোট থেকে আন্দালিভ রহমান পার্থের বেরিয়ে যাওয়া এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সরে যাওয়া অস্বস্থির কারণ হয় বিরোধী শিবিরে। এছাড়া জোটে জামায়াতের অবস্থান নিয়ে বছর জুড়েই অস্বস্থি ছিল বিএনপিতে। সর্বশেষ জামায়াতকে নিয়ে ২০-দলীয় জোটের শরিক দল এলডিপির জাতীয় মুক্তিমঞ্চ গঠন নিয়েও বিএনপির ভিতরে-বাইরে নানা আলোচনা আছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত এক বছরে সাংগঠনিকভাবেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি। দলের ৮১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে প্রায় অর্ধেক জেলায় আহ্বায়ক কমিটি করলেও যথাসময়ে হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি। দলের সহযোগী সংগঠনগুলো চলছে আংশিক কমিটি নিয়ে। এমন অবস্থার মধ্যেই ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। মেয়র পদে দুই তরুণকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। প্রক্রিয়া চলছে কাউন্সিলর পদে দলীয় প্রার্থী সমর্থন দেয়ার। দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, বিদায়ী বছর হতাশায় পার হলেও নতুন বছর ঢাকা সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করার মাধ্যমে প্রাণ ফিরতে পারে নেতাকর্মীদের মাঝে। তবে দলের হাইকমান্ড এক্ষেত্রে কতোটা সফল হবেন তা কারও কাছেই স্পষ্ট নয়। দলীয় নেতাকর্মীরাই বলছেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে সফলতা না আসা এবং মানুষের সমস্যা নিয়ে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির ‘নরম’ অবস্থান দলীয় দুর্বলতাকেই প্রকাশ করেছে।