যশোর করোনারি কেয়ার ইউনিটে এখনো প্রাথমিক চিকিৎসা!

হৃদরোগের ঝুঁকিমুক্ত চিকিৎসার লক্ষ্যে নির্মিত

0

বি এম আসাদ ॥ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হাজার হাজার হৃদরোগী আজও সেই স্বপ্নের অপেক্ষায় আছেন, যা ২০০৬ সালে যশোরে স্থাপিত একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল করোনারী কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল।

প্রয়াত মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম এই ইউনিটটি গড়ে তুলেছিলেন রোগীদের ঢাকায় না গিয়ে স্থানীয়ভাবে উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার জন্য। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা ও প্রশাসনিক উদাসীনতার কারণে দুই দশক পেরিয়ে গেলেও ইউনিটটি এখনও পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রমে আসতে পারেনি। বরং উন্নত চিকিৎসা সারঞ্জম অব্যবহৃত অবস্থায় অকেজোঁ হয়ে গেছে। সিসিইউ ভবনটি ব্যবহৃত হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন কাজে।

যশোরের প্রয়াত রাজনীতিক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম ২০০৫ সালে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট যশোর জেনারেল হাসপাতালের চত্বরেই করোনারি কেয়ার ইউনিট নামে ২৮ শয্যা বিশিষ্ট একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেন। এই প্রকল্পে মোট ১৭কোটি টাকা ব্যয় হয়, যার মধ্যে প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে ভবন নির্মাণ ও আনুষঙ্গিক কাজে, বাকি টাকা ব্যয় হয়েছে উন্নত চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ক্রয়ে। ওই সময় ইটিটি মেশিন, ইকো মেশিন, হোল্টার মনিটর, সি-আর্ম মেশিন, ডিফিব্রিলেটর, সিরিঞ্জ পাম্প, কার্ডিয়াক মনিটরসহ অন্যান্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়।

২০০৬ সালের ১২ অক্টোবর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকাকালীন তরিকুল ইসলাম ৬ বেড নিয়ে ইউনিটটি উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পরই রোগীরা চিকিৎসা নিতে শুরু করেন।

শুধু যশোর নয় ঝিনাইদহ, নড়াইল, মাগুরা, সাতক্ষীরা এমনকি বিভাগীয় শহর খুলনার রোগীরাও উন্নত কার্ডিয়াক সেবার জন্য এখানে আসা শুরু করেন। তখন চিকিৎসক ও রোগী উভয়েই মন্তব্য করতেন, ‘এটি হাসপাতাল নয়, যেন বেহেশতখানা।’

কিন্তু ২০০৭ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে সিসিইউর কার্যক্রম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়। তখনকার তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. হাসান আল মামুনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। অব্যবহৃত পড়ে থাকে সিসিইউ। এতে ধীরে ধীরে উন্নত চিকিৎসা যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যায়, কিছু অন্য ইউনিটে স্থানান্তরিত হয়। সি-আর্ম মেশিন অর্থোপেডিক বিভাগে চলে যায়, ইটিটি মেশিন অচল অবস্থায় পড়ে থাকে।

বিশেষায়িত হাসপাতালটি ২৫০ শয্যা হাসপাতালের কার্ডিয়াক ওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। এরও পরে এই ভবনে চালু হয় মেডিকেল কলেজ।

বর্তমানে সিসিইউ মূলত প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য সীমিত। এনজিওগ্রাম, উন্নত মনিটরিং ও হাই-টেক চিকিৎসা সুবিধা নেই। রোগীর অবস্থা খারাপ হলে তাদের প্রাইভেট হাসপাতালে বা ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পাঠাতে হয়, যা রোগীর ঝুঁকি বাড়ায় এবং অতিরিক্ত সময় ও অর্থ ব্যয় হয়।

তাছাড়া সিসিইউ ভবনটির একটি অংশ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের চেম্বার, বহির্বিভাগ, আইসিইউসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বর্তমান ২৮ শয্যা বিশিষ্ট সিসিইউতে প্রায়ই ৫০-৭০ জন রোগী ভর্তি থাকেন। হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রতি ১০০ রোগীর মধ্যে প্রায় ১ জন উন্নত চিকিৎসা না পাওয়ায় মারা যান। গত আগস্ট মাসে ৬৪৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছিলেন, যার মধ্যে ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল কাদের বলেন, ‘এখানে মূলত প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। উন্নত যন্ত্রপাতি নেই, নেই এনজিওগ্রাম সুবিধা। উন্নত চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও দক্ষ টেকনিশিয়ান থাকলে অনেক রোগী বাঁচানো যেত।’

চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী, সঠিক উদ্যোগ এবং সরকারি মনোযোগ থাকলে যশোরের সিসিইউ এখনো পূর্ণাঙ্গ বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে চালু করা সম্ভব।

ডা. মো. শওকত আলী ও ডা. খন্দকার রফিকুজ্জামান বলেন, ‘যদি পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, চিকিৎসক ও দক্ষ টেকনিশিয়ান বরাদ্দ করা হয়, সিসিইউতে সমস্ত কার্ডিয়াক রোগীর উন্নত চিকিৎসা করা সম্ভব।’

এখন সময় এসেছে, সরকার ও স্বাস্থ্য প্রশাসন এগিয়ে এসে যশোর সিসিইউকে তার প্রকৃত, বিশেষায়িত রূপে ফিরিয়ে আনুক, যাতে হৃদরোগীরা ঝুঁকি ও ব্যয় কমিয়ে উন্নত চিকিৎসা পায়।