যশোরে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে চলছে নীরব বিপ্লব

0

তহীদ মনি ॥ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক শান্ত শহর যশোর, যার বুকে লুকিয়ে আছে এক নীরব শিল্প বিপ্লবের বীজ। সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা, প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ, এমনকি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ বা গ্যাসের মতো মৌলিক সুবিধা ছাড়াই এই শহরের প্রায় এক হাজার লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।

এখানে তৈরি হচ্ছে এমন সব যন্ত্রাংশ যা দেশের ভারী শিল্পগুলোকে সচল রাখছে। তৈরি হচ্ছে জাহাজের পাখা, পাম্প, রেলের যন্ত্রাংশ এবং কৃষি যন্ত্রপাতি। এই শিল্প শুধু দেশের চাহিদা মেটাচ্ছে না, বরং বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এটি বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে এবং হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

যশোরের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো এখানকার ৫০ হাজার দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক। তাদের হাতে কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নেই, নেই কোনো সনদ। তাদের দক্ষতা অর্জিত হয়েছে কারখানার কাজে হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা থেকে। এই অপ্রথাগত কারিগররাই তাদের অদম্য মনোবল আর উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে তৈরি করছেন দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন।

এই শ্রমিকদের তৈরি রেলের প্রায় ৮ থেকে ১০ ধরনের যন্ত্রাংশ, যেমন ব্রেক হোল্ডার, ক্রসিংয়ের যন্ত্রাংশ, ব্রেক সিলিন্ডার, এক্সেল ক্যাপ ও হুকপা পাঠানো হচ্ছে সুদূর পার্বতীপুরে অবস্থিত রেল কোম্পানির কাছে। রেল কর্তৃপক্ষ নিজেরাই এই যন্ত্রাংশগুলোর মান দেখে মুগ্ধ হয়ে অর্ডার দিচ্ছে। একইভাবে, ছোট-বড় জাহাজের পাখা, পাম্প এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশ তৈরি করে তা সরবরাহ করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন শিপইয়ার্ডে।

এখানকার তৈরি কৃষি যন্ত্রপাতি, ইট ভাঙার ও খোয়া ভাঙার মেশিন কৃষক শ্রমিকদের কাজ সহজ করেছে এবং উৎপাদন খরচ কমিয়ে এনেছে। মিলন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ম্যানেজার মো. আল-আমিন বলেন, ‘আমরা এখানে বসে রেল ও জাহাজের যন্ত্রাংশ তৈরি করি, যা দেশের অর্থ সাশ্রয় করে। সরকারি সহায়তা পেলে আমরা আরও নতুন নতুন মেশিন ও তার যন্ত্রাংশ তৈরি করতে পারব।’ রিপন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফোরম্যান এনায়েত করিম জানান, তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে তৈরি ইট ও পাথর ভাঙার মেশিন ভারতেও রপ্তানি হচ্ছে, যা দেশের জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।

যশোরের এই লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের সম্ভাবনা অসীম হলেও এর বিকাশে কিছু মৌলিক বাধা রয়েছে। এই শিল্পের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গ্যাস ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের অভাব। উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য গ্যাস সুবিধা অপরিহার্য। বিদ্যুৎ চলে গেলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, যা উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মো. আব্দুল হামিদ বলেন, ‘উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সুবিধা জরুরি।’

নতুন উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে পারছেন না এবং বিদ্যমান কারখানাগুলো আধুনিকীকরণ করতে পারছে না শুধুমাত্র সহজ শর্তে ঋণ ও সরকারি প্রণোদনার অভাবে। সিরাজ খান, যিনি বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় পরিচালক এবং যশোর জেলার সিনিয়র সহসভাপতি, জানান, এই প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সহজ শর্তে ঋণ পায়, প্রয়োজনীয় জমি বরাদ্দ ও প্রণোদনা পায়, তবে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে।

সব কারখানা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের সমস্যা হয়। সিরাজ খান বলেন, ‘যশোরে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানাগুলো যদি সরকারি উদ্যোগে এক ছাতার নিচে এনে একটি শিল্প পার্ক গড়ে তোলা যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক মানের উৎপাদন করানো সম্ভব হবে। শিল্প পার্কে আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন উৎপাদন সুবিধা, গবেষণা কেন্দ্র ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট থাকবে।’ তার মতে, এর ফলে উৎপাদন, দক্ষতা ও মান সবই বাড়বে।

যশোরের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের সম্ভাবনাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে যশোর বিসিক কর্তৃপক্ষ। বিসিকের চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত উপমহাব্যবস্থাপক ও প্রমোশন অফিসার ওবায়দুর রহমান এই শিল্প বিকাশের সম্ভাবনাকে বড় করে দেখেন। তিনি জানান, বিসিকের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবে তারা ব্যাংকের ঋণের জন্য সুপারিশ করতে পারবে এবং শিল্পগুলোকে এক ছাতার নিচে আনার জন্য সরকারের কাছেও সুপারিশ করবে।

তিনি আরও জানান, একটি শিল্প নগরী করার প্রস্তাব ইতোমধ্যে সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে এবং তা সবুজ তালিকাভুক্ত আছে। গ্যাস সরবরাহের বিষয়েও আশার কথা শোনালেন তিনি। সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি বিসিকের কাছে গ্যাসের চাহিদা জানতে চেয়েছিল এবং বিসিক তাদের চাহিদা জানিয়েছে। তিনি আশা করেন, হয়তো দুই-এক বছরের মধ্যে গ্যাস সমস্যার সমাধান হবে এবং এই শিল্প ইউনিটগুলো দেশের জন্য ব্যাপকভাবে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

যদি সরকার এই শিল্পের প্রতি মনোযোগ দেয় এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করে, তবে যশোর শুধু একটি জেলা শহর নয়, বরং দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। বিদেশ থেকে কোটি টাকার যন্ত্রপাতি আমদানির বদলে দেশেই তৈরি হবে মানসম্মত যন্ত্রাংশ, সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা এবং দেশের অর্থনীতি হবে আরও শক্তিশালী। এই নীরব বিপ্লবকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে এখনই দরকার সাহসী সরকারি পদক্ষেপ।