শহীদ জিয়ার খননকৃত খালের হদিস নেই পাউবোতে

যশোরে খাল আছে নামে, বাস্তবে নেই

0

তহীদ মনি ॥ যশোরে অনেক খাল এখন শুধু নামেই টিকে আছে, বাস্তবে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। সরকারি নথিপত্রেও তাদের কোনো হদিস মেলে না। ‘খালধার রোড’ নামে রাস্তা থাকলেও, তার পাশের খালটি যে একসময় ভৈরব নদ থেকে মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হতো, তা যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও জেলা প্রশাসনের জানা নেই। পশ্চিম বারান্দিপাড়ার বরফকলের পাশ দিয়ে ভৈরব পর্যন্ত বিস্তৃত সেই বিশাল খালটি এখন নর্দমায় পরিণত হয়েছে, আর তার পাশের রাস্তাটিই কেবল সেই অতীতের স্মৃতি বহন করছে।

একইভাবে, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে খনন কর্মসূচি যশোর থেকে শুরু হয়েছিল। সেই সময় খননকৃত খালেরও কোনো খোঁজ নেই।

সরকারি নথিতে জেলার ২০টি নদ-নদীর তথ্য থাকলেও, খালের বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য জানাতে পারেননি জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সুজন সরকার এবং পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সুজন সরকার জানান, তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য এই মুহূর্তে দিতে পারছেন না। তথ্যটি পেতে তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তা নেবেন। তার মতে, খালগুলোর বর্তমান অবস্থাও তার ভালো জানা নেই।

অন্যদিকে, পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে যশোরে খালের একটি তালিকা করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তিনি জানান, এটি এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। সেই তালিকা অনুযায়ী, জেলার অভয়নগর ও বাঘারপাড়া উপজেলা ছাড়া অন্য ৬টি উপজেলায় ৬৩টি খাল রয়েছে। এই খালগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ১৯২.৪২৭ কিলোমিটার।

পরে অভয়নগর ও বাঘারপাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সেই দুই উপজেলার খালের তথ্য জানতে যোগাযোগ করা হয়। বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শোভন সরকার তার উপজেলার খালের সংখ্যা ও দৈর্ঘ্য জানাতে পারলেও, অভয়নগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পার্থ প্রতীম শীল দুই দিনের মধ্যেও কোনো তথ্য দিতে পারেননি।

বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উপজেলায় ৪১টি খাল রয়েছে, যার মোট দৈর্ঘ্য ৪১.৯৬ কিলোমিটার। এই উপজেলার প্রায় সব খালই খুবই ছোট। সবচেয়ে বড় খাল হলো রাখালগাছি ও তীরমুনি, যাদের প্রত্যেকের দৈর্ঘ্য ৩ কিলোমিটার।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জেলার সবচেয়ে বড় খালগুলো হলো কেশবপুরের নূরুনিয়া খাল (১২ কিলোমিটার), একই দৈর্ঘ্যের মণিরামপুরের ঝিকরা খাল এবং জিয়ালদার খাল। এ ছাড়া রয়েছে শার্শার মৌতাখাল (১০ কিলোমিটার), কেশবপুরের বিল খুকশিয়া খাল (৮.৫ কিলোমিটার), একই উপজেলার লস্কর খাল (৭ কিলোমিটার) এবং মণিরামপুরের গাবুখালি খাল (৬ কিলোমিটার)। জেলায় অনেক খালের দৈর্ঘ্য ২০০ মিটারেরও কম।
এদিকে, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সারাদেশে ফসল উৎপাদনের বিপ¬ব ঘটানোর লক্ষ্যে খাল খনন ও পুনঃখনন করেছিলেন। তিনি নিজ হাতে যশোরে খাল খনন করেছিলেন। তার স্মৃতিযুক্ত উলশী যদুনাথপুর সেচ প্রকল্পের সাথে যুক্ত খালের কোন খবর রাখে না জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড বা জেলা প্রশাসনের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম বলেন, শার্শার উলাশী খাল শহীদ জিয়াউর রহমান কেটেছিলেন বলে জেনেছি, কিন্তু এ বিষয়ে কোনো ফাইল আছে কিনা, তা জানা নেই।

জানা গেছে, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সারাদেশে ২৬ হাজার কিলোমিটার খাল খনন করিয়েছিলেন, যার মধ্যে যশোরের শার্শার উলাশী খালও রয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় পরিচালিত খাল খনন কর্মসূচির অংশ হিসেবে যশোর জেলায়ও উলে¬খযোগ্য কাজ হয়েছিল। সবচেয়ে সুপরিচিত এবং আলোচিত খালটি হলো শার্শা উপজেলার উলাশীর খাল।

এটি ‘উলাশী-যদুনাথপুরের বেতনা নদী সংযোগ প্রকল্প’ নামেও পরিচিত ছিল। ১৯৭৬ সালের ১ নভেম্বর জিয়াউর রহমান নিজেই এই খাল খনন কাজের উদ্বোধন করেন এবং এতে সশরীরে অংশ নেন। এই খালটি স্থানীয়ভাবে ‘জিয়া খাল’ নামেই পরিচিতি লাভ করে।

তার খাল খনন কর্মসূচি ছিল তার ১৯-দফা কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার মূল লক্ষ্য ছিল কৃষিতে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। এই কর্মসূচির মাধ্যমে সারাদেশে প্রায় ২৬ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি খাল খনন বা পুনঃখনন করা হয়েছিল। উলাশীর খাল ছিল এই কর্মসূচির একটি পাইলট প্রকল্প এবং এটি কৃষি বিপ্লবে বিশাল অবদান রেখেছিল।

বর্তমানে ৪.২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই খালটি জরাজীর্ণ দশায় পূর্ণ। জেলার প্রায় সব খালের মতো এটিও কোথাও অগভীর, কোথাও আবর্জনাপূর্ণ, কোথাও দখলের ঝুঁকিতে, আবার কোথাও পাটা ও বাঁধের কারণে মৃত এবং শেওলাপূর্ণ বলে স্থানীয় অধিবাসীরা জানান।

পাউবো সূত্র অনুযায়ী, গত বছর মণিরামপুর ও কেশবপুরের কয়েকটি খালের কিছু অংশ খনন বা পুনঃখননের মাধ্যমে ভবদহ এলাকার পানি নিষ্কাশনের কাজ করা হয়েছিল। বর্তমানে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ‘ক্লাইমেট স্মার্ট প্রজেক্ট’-এর আওতায় ঝিকরগাছা উপজেলার ৪টি খালের ১১.৫ কিলোমিটার পুনঃখনন চলছে। আগামী শুষ্ক মৌসুমে অভয়নগর, কেশবপুর, মণিরামপুর ও ঝিকরগাছা এই ৪টি উপজেলার ৩৬টি গুরুত্বপূর্ণ খালের ১১০ কিলোমিটার পুনঃখননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী জানান, স্থানীয় জনগণের অসচেতনতা এবং আকেন্দ্রিকতাই খাল হারানোর মূল কারণ। নদ-নদী দখল করে স্থাপনা নির্মাণ এখানকার নিত্যদিনের সমস্যা। শুকনো মৌসুমে অনেক খালে পানি থাকে না, আবার অনেক খাল সংস্কারের অভাবে মৃতপ্রায়। খালগুলো বর্ষায় পানি পেয়ে কিছুটা প্রাণ ফিরে পায়, তবে মানুষ যদি নিজেরা খাল রক্ষায় ভূমিকা না নেয়, তাহলে সেটি টিকিয়ে রাখা কঠিন।

তিনি আরও জানান, সম্প্রতি পানি উন্নয়ন বোর্ড গুরুত্বপূর্ণ অনেক খাল সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। গত বছর ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে কয়েকটি খাল খনন ও পুনঃখনন করা হয়েছিল। তিনি বলেন, যখন জানতে পেরেছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উলাশী খাল খনন করিয়েছিলেন, তখন সেটির বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে ওই খালটির সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাবনা পাঠাবেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, এই খাল সংক্রান্ত কোনো ফাইল আজ পর্যন্ত তিনি পাননি। সাধারণত কোনো প্রকল্প গৃহীত হলে এবং কাজ শেষ হলে নির্দিষ্ট সময় বা ১০/১৫/২০ বছর পর সেই ফাইলগুলো ধ্বংস করা হয়। এ ক্ষেত্রেও তেমন কিছু হয়ে থাকতে পারে।