যশোরে উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় সরকারি দফতরগুলোর অনিয়ম ও জনভোগান্তির চিত্র

0

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ যশোর জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মাসিক সভায় সরকারি দপ্তরগুলোর কার্যক্রমে ব্যাপক অনিয়ম, জনভোগান্তি এবং অবহেলার চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল রোববার সকালে জেলা কালেক্টরেট ভবনের অমিত্রাক্ষর সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এই সভায় জনস্বাস্থ্য বিভাগের অদ্ভুত ‘ঐতিহ্য’, অচল ‘লাল টেলিফোন’, সাপের উপদ্রব ও অ্যান্টিভেনামের অভাব, পৌরসভার উন্নয়ন কাজ ও সীমাবদ্ধতা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। স্বয়ং জেলা প্রশাসক অনেক দপ্তরের কার্যক্রমে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

সভায় জানানো হয়, যশোর জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সাবমার্সিবল পাম্প স্থাপন করতে গেলে পাম্প গ্রহীতাকে ৯ থেকে ১০ জন মিস্ত্রিকে ১০দিন বাড়িতে রেখে ৯০ ওয়াক্ত খাবার সরবরাহ করতে হয়। এ অভিযোগের বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিভাগ অকপটে স্বীকার করে বলেন এটি ‘ঐতিহ্য’। জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর তীব্র সমালোচনা করেন এবং ঠিকাদারের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।

যশোর সদর উপজেলা অফিস সংলগ্ন বিএডিসির কার্যালয় চত্বর থেকে গত এক সপ্তাহে ৯-১০টি বিষাক্ত সাপ মারা হয়েছে বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তার। এতে এলাকাবাসী ও সরকারি অফিসের কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা অমিতা মণ্ডল জানান, সাপ না মেরে তাড়িয়ে দিতে হবে এবং উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি জানানো হয়েছে, টিম এসে সাপ ধরে নিয়ে যাবে।

তবে, স্বাস্থ্য খাতের গুরুতর চিত্র উঠে আসে যখন জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সিভিল সার্জন ডা. মাসুদ রানা জানান, জেলায় সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় একটিও অ্যান্টিভেনাম নেই। সরকারিভাবে এটি পাওয়া যাচ্ছে না, স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিয়মিত সরবরাহ না পাওয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হুসাইন শাফায়াতও একই কথা বলেন এবং জানান যে তিনি স্থানীয়ভাবে চারটি সাপে কামড়ানো রোগীর জন্য অ্যান্টিভেনাম জোগাড় করে রেখেছেন।

এই সংকটে জেলা প্রশাসক উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, অনেক দানশীল ব্যক্তি আছেন, তাদের জানালে এসব সমস্যার সমাধান হয়। প্রতি মাসে ওষুধ কেনার জন্য যে টাকা পাওয়া যায়, তা থেকেও কিছু কিছু করে অ্যান্টিভেনাম সংগ্রহ করা যায়। এসব ছোটোখাটো বিষয় নিজেরা সমাধান না করে বড় আকারে তুলে ধরা হয়। তিনি স্বাস্থ্য বিভাগকে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখার নির্দেশ দেন।

জেলা প্রশাসকের ‘লাল টেলিফোন’ (রেড ফোন) সচল কিনা, তা টেলিফোন বিভাগ জানে না বলে জানান জেলা প্রশাসক নিজেই । টেলিফোন বিভাগের পক্ষ থেকে আসা জেলা সমন্বয় সভার সদস্যও বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেননি। এমনকি জেলা প্রশাসনের অন্যান্য টেলিফোনগুলোর অবস্থাও টিঅ্যান্ডটি বলতে পারেনি। জেলা প্রশাসক গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে যেকোনো মুহূর্তে রেড ফোন ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে, তাই এটি সর্বদা সচল থাকা জরুরি।

বিগত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে জেলায় স্বাস্থ্য কমিটির কোনো সভা হয়নি বলে একজন সদস্য অভিযোগ করেন। স্বাস্থ্য বিভাগের অনিয়ম ও ব্যর্থতার কারণেই এই মিটিং হয়নি বলেও দাবি করা হয়।

সভায় বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধি না থাকা, দপ্তর প্রধানের স্থলে প্রতিনিধি পাঠিয়ে দায়সারাভাবে সভায় হাজিরা দেওয়া, এবং বেশিরভাগ দপ্তরের পক্ষ থেকে ‘আমাদের দপ্তরে কাজকর্ম স্বাভাবিক চলছে’ এমন গতানুগতিক রিপোর্ট উপস্থাপন করাসহ নানা অসঙ্গতি ধরা পড়ে। সভাপতি আগামীতে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।

সমন্বয় সভায় একজন সদস্য বিএডিসির সারের ডিলার নওয়াপাড়ার একজন ব্যবসায়ীর ওপর চাঁদাবাজি ও বোমা হামলার ভয়াবহ অভিযোগ করেন। তিনি জানান, চাঁদা না পেয়ে মুখে কাপড় বেঁধে আসা ব্যক্তিরা ওই ব্যবসায়ীর ভবনে বোমা হামলা চালিয়েছে এবং ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। এ নিয়ে মামলা হলেও কোনো ফল হয়নি। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সময়মতো কৃষকদের কাছে সার পৌঁছানো সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

পৌরসভার প্রশাসক ও ডিডিএলজি রফিকুল হাসান জানান, অতিরিক্ত বর্ষায় শহরের অনেক সড়কের ক্ষতি হয়েছে, এবং মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। পৌরসভার নিজস্ব তহবিল থেকে কিছু কাজ সম্ভব হলেও, সব কাজ করা সম্ভব নয়। তিনি নীলগঞ্জ তাতীপাড়া সড়কে প্রায় ৬ কোটি টাকা এবং এমএম কলেজের সামনে পরীক্ষামূলকভাবে প্রায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে প্লাস্টিকের রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানান।

এছাড়া, ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চলমান ড্রেনের কাজ, ছোট রাস্তার কাজের জন্য ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ এবং ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৭টি রাস্তা সংস্কারের কাজ চলছে। স্ট্রিট লাইট নষ্ট হওয়ার সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে বলেও তিনি আশ্বস্ত করেন। তিনি আরও জানান, পৌরসভার পুকুরে ৩০ মণ মাছ ছাড়া হয়েছে, যা আগামীতে মৎস্য শিকারিরা ধরতে পারবেন।

সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান, জেলা পুলিশের প্রতিনিধি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূর-ই-আলম, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী, গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের জেলা প্রধান ডা. মো. রাশেদুল হক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আশরাফুল হক, প্রেসক্লাবের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন প্রমুখ।